হংকংয়ে বাংলাদেশিদের মানবেতর জীবন


আন্তর্জাতিক ডেস্ক: সমৃদ্ধি ও আর্থ-সামাজিক দিক বিবেচনায় বিশ্ব দরবারে বেশ পরিচিতি রয়েছে হংকংয়ের। কিন্তু সৃমদ্ধির আঁচল পড়ে থাকা এই অঞ্চলের ভেতরটা অনেক বেশি জরাজীর্ণ। চীনের মূল ভূ-খণ্ড থেকে বাইরে ‘পিং চে’ নামে স্বায়ত্তশাসিত এই অঞ্চলের একটি গ্রাম রয়েছে। গ্রামটি যেন ‘দেয়ালহীন কারাগার’। আর এই কারাগারের বাসিন্দা বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পালিয়ে আসা হতভাগ্য নাগরিকরা।
গত ২৫ জুন সরেজমিনে গ্রামটি পরিদর্শনে যায় প্রখ্যাত মার্কিন সংবাদ মাধ্যম সিএনএন’র একটি প্রতিনিধি দল। এখানকার বাসিন্দা বিশেষ করে বাংলাদেশি নাগরিকদের জীবন-যাপন নিয়ে রোববার নিজেদের অনলাইন সংস্করণে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংবাদ মাধ্যমটি। প্রতিবেদনে হংকং কর্তৃপক্ষের অমানবিক পদক্ষেপে ও ইচ্ছেকৃত অবহেলায় বাংলাদেশি নাগরিকদের মানবেতর জীবন-যাপনের কথা তুলে ধরা হয়। পিং চে গ্রামের বস্তিবাসী ৪২ বছর বয়সী বাংলাদেশি মুজিবুর। তার চার মাস বয়সী একটি শিশু সন্তান রয়েছে। তিনি জানান, তার মতো অনেকেই এখানে প্রশাসনিক আইন অনুযায়ী চাকরি বা যেকোনো উপার্জনভিত্তিক কাজে নিষিদ্ধ। তারা বস্তির একটি জরাজীর্ণ বাড়িতে বসবাস করছেন এবং শরণার্থী হিসেবে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে স্বীকৃতি ও সহায়তা পেতে অপেক্ষা করছেন অনেক বছর ধরে। বাংলাদেশের আরেক নাগরিক সাইদুর রহমান। সংবাদকর্মীরা যখন তার ঘরে প্রবেশ করছিলেন তখন তিনি বস্তির একটি অপরিষ্কার ট্যাপ থেকে পানি পান করছিলেন।

সাইদুর জানান, তিনি এবং তার মতো অন্য শরণার্থীরা অধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে প্রতিমাসে আবাসন ভাতা বাবদ ১২০০ হংকং ডলার পান (১২ হাজার টাকা) পান। এতো অল্প পরিমাণ ভাতা একেবারে জরাজীর্ণ বাসা ভাড়াতেই শেষ হয়ে যায়।
৪৩ বছর বয়সী আরেক বাংলাদেশি নাগরিক সেলিম বস্তিতে নিজের পারিবারিক ছবি দেখে সময় কাটাচ্ছিলেন। দেশে থাকতে ব্যবসা করতেন বলে জানান তিনি। সন্ত্রাসীরা হত্যা করার হুমকি দেওয়ার পর হংকং পালিয়ে সেলিম বলেন, সন্ত্রাসীরা তার পরিবার ও সন্তানকে এখনও হত্যার হুমকি দিচ্ছে।
নিজ দেশ থেকে পালিয়ে আসা বাংলাদেশি নাগরিক জহির জাহাজের স্তূপকৃত ময়লা ডাস্টবিনের পেছনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন সিএনএন টিমের সঙ্গে। এখানে শরণার্থীদের টাকা উপার্জনের পথ রুদ্ধ বলে আবর্জনা স্তুপ থেকে জামা-কাপড় ও গৃহ সামগ্রী যোগাড় করতে হয় বলে জানান তিনি।
দেলোয়ার নামের আরেক বাংলাদেশি নাগরিক পিং চে গ্রামের আবাসিক এলাকার প্রবেশপথে মান্দারিন ভাষায় লেখা একটি লেখা পড়ে শোনান, ‘যারা (দেশে) প্রবেশ করে এবং (দেশ) ত্যাগ করে তাদের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তা।’ ২৬ বছর বয়সী বাংলাদেশি নাগরিক আরিফ ভেষজবিজ্ঞানে পড়া শেষ করার পর ব্যবসায় নেমেছিলেন। কিন্তু ২০০৯ সালে সন্ত্রাসীরা হত্যা করার হুমকি দেওয়ার পর তিনি পালিয়ে হংকং চলে আসেন।
কয়েকটি নড়বড়ে বিমের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে আরিফের জরাজীর্ণ ঘর। সদ্য নির্মিত শৌচাগার মনে হচ্ছে এক্ষুণি ভেঙে পড়বে। রান্নাঘরের মাঝখানে একটি বিশাল গর্ত আর তাতে নোংরা পানি দেখে যে কারও বমির উদ্রেক হতে পারে।
আরিফ বলেন, একদিন রাতে তিনি যখন ঘুমাচ্ছিলেন তখন ঘরের ছাদ মাথার ওপর ভেঙে পড়ে। সেদিন মৃত্যু ঘরের দরজায় এসেছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি। খুলনা জেলার বাসিন্দা আরিফ বলেন, ‘আমরা প্রায় সবাই এখানে এসেছি জীবন বাঁচানোর জন্য। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে মৃত্যুই ভাল ছিল। এভাবে বাঁচার চেয়ে মৃত্যুই ভাল। আমরা যেভাবে আছি এটাকে 
জীবন বলে না। আরিফ জানান, সন্ত্রাসীরা হত্যা করার হুমকি দেওয়ার পর মৃত্যু থেকে স্বপ্নের দেশ আয়ারল্যান্ডে পাড়ি দিতে এক দালালের সহযোগিতা নেন। কিন্তু দালাল তার কাছে আয়ারল্যান্ডে পৌঁছানোর অঙ্গীকার করলেও টাকা হাতিয়ে প্রতারণা করে হংকংয়ের শরণার্থী এলাকায় রেখে যায়। আরিফ বলেন, ‘আমি সব হারিয়ে ফেলেছি, যখন শুনেছি আমি হংকংয়ে আছি তখন অনেক কষ্ট পেয়েছি।’
আরিফের সঙ্গে থাকেন ৪৩ বছর বয়সী সেলিম। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করে হত্যার হুমকি দেওয়ার পর তিনিও হংকংয়ে চলে আসেন। সেলিমও আরিফের সঙ্গে একাÍ হয়ে বলেন, ‘এভাবে বাঁচার চেয়ে মরাও অনেক ভাল।’
উল্লেখ্য, নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে শরণার্থী কিংবা উদ্বাস্তুকে যেকোনো ধরনের চাকরি বা উপার্জনভিত্তিক কাজে নিষিদ্ধ করে রেখেছে হংকং সরকার। চাকরিরত কোনো শরণার্থীকে আটক করতে পারলে সঙ্গে সঙ্গেই ২২ মাস কারাদণ্ড দিয়ে দেয় কর্তৃপক্ষ। এছাড়া, প্রায় সব শরণার্থীকেই আন্তর্জাতিক অধিকার সংগঠনগুলোর কাছে হাত পাততে চাপ দেয় কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশি নাগরিক আরিফ জানান, আন্তর্জাতিক সামাজিক সেবা প্রতিষ্ঠান আইএসএস’র পক্ষ থেকে প্রতিমাসে ১২০০ হংকং ডলার পান তিনি। কিন্তু এই স্বল্প পরিমাণ অনুদান কেবল পিং চে’র বস্তিভাড়া দিতেই ব্যয় হয়ে যায়। এছাড়া, মাত্র ৯০০ ডলার মূল্যমানের খাবার পেলেও অন্যান্য মৌলিক সুবিধাগুলোর  কথা ভুলে থাকতে হয়।
এ ব্যাপারে শরণার্থী তহবিল সংস্থা ‘ভিশন ফার্স্ট’ এর নির্বাহী পরিচালক কসমো বিটসন বলেন, ‘উদ্বাস্তুদের এমন জীবন-যাপনে আমরা ব্যথিত।’ ইচ্ছাকৃতভাবে শরণার্থীদের এ ধরনের মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য করা হচ্ছে ইঙ্গিত দিয়ে বিটসন বলেন, ‘এটা মানবিক নয়। বিটসন বলেন, হংকংয়ে ২০০৬ সালে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেওয়ার পর থেকে এ ধরনের মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে শরণার্থীদের। তিনি বলেন, যাদের খাবার লাগত ৭ কেজি চাল তাদের মাত্র ৩ কেজিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। পিং চে’র শরনার্থীদের সঙ্গে কাজ করা বিটসন বলেন, ‘এখানকার অধিবাসীদের ক্ষুধা কিছুতেই কমছে না। তবে পিং চে গ্রামসহ অন্যান্য শরণার্থী কেন্দ্রে সাধ্যমত সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে আইএসএস’র মতো তহবিল সংস্থাগুলো।
এ ব্যাপারে হংকংয়ের সমাজ কল্যাণ বিভাগ থেকে সিএনএনে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বহিরাগত লোকদের কারণে যাতে দেশের সামাজিক সেবায় কোনো প্রভাব না পড়ে সেজন্য পদক্ষেপ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তবে একজন মানুষ যাতে নিঃস্ব না হয়ে যায় এজন্য মানবিক সহায়তার দেওয়া হচ্ছে।’ হংকং কর্তৃপক্ষের এ বিবৃতির ব্যাপারে বাংলাদেশি নাগরিক আরিফ বলেন, ‘হংকং সরকার এগুলো নিয়ে মাথা ঘামায় না। কারণ আমরা তাদের দেশের জনগণ নই।’
মানবাধিকার বিষয়ে কাজ করা আইনজীবীরা বলছেন, ‘হংকং সরকারের এ ধরনের নীতি শরণার্থীদের ‘জীবন্ত নরকে’ বাস করতে বাধ্য করছে। কাজ করতে না দেওয়া, নিুমানের বাসস্থান, অপর্যাপ্ত খাবার এবং চিকিৎসার অভাব শরণার্থীদের জীবনকে আরও বেশি অসহনীয় করে তুলছে। শরণার্থী হিসেবে নথিভুক্ত হয়ে সুযোগ-সুবিধা পেতে বহু বছর ধরে অপেক্ষা করেও কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বরাবর প্রত্যাখ্যাত হয়ে আসা ভাল ইঙ্গিত বহন করে না।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এ ধরনের আভ্যন্তরীণ সংকীর্ণতা সমৃদ্ধ অঞ্চল খ্যাত হংকংয়ের সুনাম নষ্ট করবে।