কোটি টাকার খোঁজ নেই গণজাগরণ মঞ্চের, বলা অসম্ভব বললেন ইমরান

এম এ আহাদ শাহীন : কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদন্ডের রায়কে প্রত্যাখান করে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গত ৫ ফে শাহবাগে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিলো তাতে অসংখ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক সহায়তা পায় গণজাগরণ মঞ্চের নেতা-কর্মীরা।

কিন্তু সে সময় সর্বমোট কি পরিমাণ অর্থ সহায়তা পাওয়া গিয়েছিলো, কিভাবেই বা তা খরচ হয়েছিলো তার কোনো হিসাব মেলেনি আজো। এ নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই এজন্য আঙ্গুল তুলছেন মঞ্চের মুখপাত্র হয়ে ওঠা ডা. ইমরান এইচ সরকারের দিকে।

কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদন্ডের রায়কে প্রত্যাখানকে করে ৫ ফেব্র“য়ারি বিকেলে শাহবাগে আন্দোলন শুরু হয়। ওই আন্দোলনে যোগ দেয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সর্বস্তরের জনতা। ৬ ফেব্র“য়ারি সকাল থেকেই শাহবাগ হয়ে ওঠে জনসমুদ্র।

এরপর বাংলাদেশের মন্ত্রী-সাংসদ-রাজনৈতিক কর্মী থেকে শুরু করে ব্যাবসায়ী, চাকুরিজীবী, ব্যাংকারসহ সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষ ওই আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করেন। এই আন্দোলন চালিয়ে নেওয়ার জন্য খাবার, পানি, মোমবাতি, মাইক, সাউন্ড সিস্টেম, ব্যানার, মঞ্চের জন্য ট্রাকসহ নানা আনুষঙ্গিক খরচের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন হয়।

এই আন্দোলনকে নিজেদের মনে করে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যাবসায়ীসহ বিত্তবান অনেকে মানুষ যে যেভাবে পেরেছেন অর্থ সহায়তা করেছেন। অধিকাংশ টাকাই নানাজনের মাধ্যমে গেছে ইমরান এইচ সরকারের হাতে। আন্দোলনের প্রথম দুদিন ইমরান মাইকে কি পরিমাণ টাকা উঠেছে সেই ঘোষণা দিলেও পরে আর কখনোই তা নিয়ে উচ্চবাচ্চ্য করেননি ইমরান।

কোন্ খাতে এসব টাকা খরচ হয়েছে সে বিষয়েও আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত নেতাদেরও তা জানানো হয়নি। এ নিয়ে নানা কথাবার্তা ছড়িয়ে যায়। একপর্যায়ে এ নিয়ে লিফলেটও ছাড়ানো হয়। সেসব লিফলেটে কোন প্রতিষ্ঠান কি পরিমান টাকা দিয়েছে তারও উল্লেখ করা হয়।
তবে এসব অর্থ প্রাপ্তির উৎসের কথা বরাবরই ভ্রান্ত এবং অপপ্রচার বলে উড়িয়ে দিয়েছেন গণজাগরণ মঞ্চের ডা. ইমরান এইচ সরকার এবং অন্যান্য নেতা-কর্মীরা।

আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত একজন ছাত্রনেতা বলেন, যে যেভাবেই যার পরিচিতজনের মাধ্যমেই টাকা দিতেন না কেন সেই টাকা তুলে দেওয়া হতো ইমরানের হাতে। এরপর যখন যে খাতে টাকা লাগতো তা তার কাছ থেকে নিতো সংগঠকরা। কিন্তু আন্দোলন শুরুর পর খুব দ্রুতই ইমরানের পুরোনো মোবাইল বদলে হাতে উঠে দামী মোবাইল ও ট্যাব। আন্দোলনের দুই মাসে প্রতিদিনই তিনি একটি করে নতুন পাঞ্জাবি পরে আসতেন। এ নিয়েও শুরু হয় নানা প্রশ্ন-এমনটাই সংবাদ প্রকাশ করেছে অনেক সংবাদ মাধ্যম।

তারা কিছু লিফলেট সংগ্রহ করেছে। বিষয়টি নিয়ে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অনেকের সঙ্গে কথাও হয়েছে। তাতে জানা গেছে, এফবিসিসিআই চেয়ারম্যান কাজী আকরাম উদ্দিন ৬০ লক্ষ টাকা, বসুন্ধরা গ্র“প ২০ লক্ষ টাকা, ইস্পাহানি গ্র“প ১০ লক্ষ টাকা, হামীম গ্র“প ২০ লক্ষ টাকা, অটবি ১০ লক্ষ টাকা, বেস্টওয়ে গ্র“প ৫ লক্ষ টাকা, ওয়ালটন কোম্পানি ১০ লক্ষ টাকা, বায়োফার্মা ৫ লক্ষ টাকা, একটি শীর্ষ দৈনিক পত্রিকা চার লাখ টাকা, সাবেক এসপি মাহবুবের কাছ থেকে ৪ লক্ষ টাকা, ইনসেপ্টা কোম্পানী ৫ লক্ষ টাকা, ফরিদুর রেজা সাগরের কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকা, সাংবাদিক আবেদ খানের কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকা, এডভোকেট আনিসুল হক থেকে ১০ হাজার টাকা, কানিজ সুলতানা থেকে ১০ হাজার টাকাসহ বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রায় দুই কোটি টাকা পেয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ। এর বাইরে পানি, খাবার, ল্যাপটপসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র দিয়েও সহায়তা করেছেন অনেকে।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর মাধ্যমেও অনেক টাকা এসেছে। এছাড়া আন্দোলেনর সঙ্গে যুক্ত অনেকের পরিচিতরাই টাকা দিয়েছেন। তবে সবাই একটি বিষয় বলেছেন, সব টাকাই ঘুরেফিরে ইমরানের হাতে দেয়া হয়েছে। এছাড়া প্রবাসীরাও বিপুল পরিমাণ টাকা পাঠিয়েছেন।

অভিযোগ উঠেছে, আন্দোলনের পেছনে সামান্য টাকা খরচ হলেও একটি বড় অংকের টাকাই ইমরান এবং তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন নিজেদের কাছেই রেখেছেন। ইমরান তার প্রবাসী এক বান্ধবীর কাছে অনেক টাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন এমন কথাও অনেকে বলেছেন। তবে টাকা ভাগাভাগি করে নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে ব্লগার মারুফ রসূল বলেন, এটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত তথ্য। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের কোনো আর্থিক লেনদেন গণজাগরণ মঞ্চ করেনি। তবে কেউ কেউ আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারীদের খাবার সরবরাহের জন্য টাকা দিয়েছিলেন যার পরিমাণ দশ থেকে পনের হাজার টাকার বেশি নয়।

বিদেশী প্রবাসীদের সাথে ভিডিও চ্যাটের সময় যে আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল সেই অর্থ কিভাবে খরচ হয়েছে এসব প্রশ্নের জবাবে মারুফ বলেন, বিদেশের বাঙালিদেরকে আমরা টাকার চেয়ে বেশি অনুরোধ করেছিলাম যাতে তারা এই আন্দোলনের কথা বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করে বিদেশিদের কাছে প্রচার করে জনমত সৃষ্টিতে সহায়তা করে। কিন্তু বিদেশ থেকে সেভাবে কোনো অর্থ সহায়তা আসে নি।

ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসু বলেন, এসব লিস্ট তো নতুন নয়। গত মে মাস থেকে বিভিন্ন হাত ঘুরছে। এটি জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। তবে এসপি মাহবুব এর কাছ থেকে প্রাপ্ত সহায়তার কথা আমি জানি। শুরু থেকেই তিনি সহায়তা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমরা নেইনি। পরে মহাসমাবেশ করতে টাকার দরকার ছিল তাই তিনি ইমরান এইচ সরকারকে আমার সামনে প্রায় চার লক্ষ টাকা দেন।
বাপ্পা বলেন, এটি ঠিক এতো বড় একটা আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাবার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন ছিল। তবে কোনো ছাত্র সংগঠনের হাত থেকে কোনো টাকার লেনদেন হয়নি। আন্দোলনের সব খরচ ইমরান এইচ সরকারের হাত দিয়ে হয়েছে।

টাকার হিসেব নিয়ে ডা. ইমরান এইচ সরকার বলেন, যখন টাকা দরকার ছিল তখনই আমরা টাকা উঠিয়ে ফেলতাম। একেক জন একেকভাবে টাকা দিয়েছে তাই এটিকে সঠিকভাবে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। তাবু, পিকআপ, মাইক ইত্যাদির ভাড়া মিটাতে আমাদের প্রচুর অর্থের প্রয়োজন পড়েছিল।

বিদেশী প্রবাসীদের অনেকেই অর্থের সহায়তা দিয়েছে এমন অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, আমরা যখন ভিডিও চ্যাট করেছি তখন বিভিন্ন চ্যানেল লাইভ দেখিয়েছে। এই সময় যারা অর্থের সহায়তা দিতে চেয়েছিল আমি তাদের কে বলেছিলাম যে প্রতিনিধির মাধ্যমে গণজাগরণ মঞ্চের মিডিয়া সেলে এসে দিয়ে যেতে হবে। এভাবে কিছু সহায়তা এসেছে। এর মধ্যে নিউয়র্ক থেকে ‘অণু’ নামের একটা গ্র“প কিছু পরিমাণ টাকা দিতে চেয়েছিল যা আনিসুল হকের মাধ্যমে আমাদের হস্তান্তর করা হয়েছিল। এই টাকার পরিমাণটা চার লক্ষ টাকার উপরে ছিল। সেই খবর প্রথম আলোতে প্রকাশিতও হয়েছিল। এরকম অনেকের কাছ থেকে নিতে হইছে। তখন আমাদের অনেক টাকার দরকার ছিল। তবে আন্দোলনকে বিতর্কিত করার জন্য জামায়াতে ইসলামী এবং ছাত্রশিবির শুরু থেকেই বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করেছে। তারা বিভিন্নভাবে আমাকে আক্রমণ করেছে। এখনও করছে। এসব অভিযোগ তারই অংশ।

কি পরিমান টাকা উঠেছে প্রশ্ন করা হলে ইমরান বলেন, আমি এর আগে পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছি যে কেউ যদি পাঠাতে চায় তাহলে প্রতিনিধির মাধ্যমে গণজাগরণ মঞ্চের মিডিয়া সেলে দিয়ে যেতে হবে। যারা টাকা দিয়েছেন তারা সবাই এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দিয়েছেন। তবে কি পরিমাণ টাকা উঠেছে সেটা নির্দিষ্ট করে বলা অসম্ভব।