লায়লাতুল কদর: মহিমান্বিত এক রজনী

হাফেজ মাওলানা রিদওয়ানুল কাদির উখিয়াভী: 
অবতরণিকা:- রমজানের শেষ দশকে এমন এক রাত আছে, যাকে কুরআনের ভাষায় লায়লাতুল কদর এবং লায়লাতুন মুবারকাহ বলে অবহিত করা হয়েছে এবং তাকে এক হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম বলা হয়েছে। লায়লাতুন অর্থ, রাত্রি, রজনী। কদরের দুটি অর্থ রয়েছে।

 ১. কদর অথর্, মাহাত্ম ও সম্মান। এর মাহাত্ম ও সম্মানের কারণে একে লায়লাতুল কদর তথা মহিমান্বিত রাত বলা হয়। হজরত আবু বকর ওয়াররাক রহ বলেন, এ রাত্রিকে লায়লাতুল কদর বলার কারণ এই যে, আমল না করার কারণে এর পূর্বে যার কোন সম্মান ও মূল্য ছিলো না, সে এ রাত্রিতে তওবা-ইস্তেগফার ও ইবাদতের মাধ্যমে সম্মানীত হয়ে যায়। 
২. কদর অর্থ নির্দিষ্ট করা ও সিদ্ধান্ত করা। অর্থাৎ, লায়লাতুল কদর এমন এক রাত, যে রাতে আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক বস্তুর সঠিক পরিমাণ নিধারণ করেন। তার সময় নির্দিষ্ট করেন ও প্রত্যেক বস্তুর ভাগ্য নির্ধারণ করেন। 
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, ঐ রাতে সকল বিষয়ের সুষ্ঠ ও দৃঢ়  সিদ্ধান্ত আমার নির্দেশক্রমে ঘোষণা করা হয়। (সূরা আদ-দূখান)
লায়লাতুল কদরের ফজীলত: এ রাতের মর্যাদা ও মাহাত্মের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, আল্লাহ তাআলা এ রাত সম্পর্কে একটি পূর্ণ সূরা (সূরা আল-কদর ) অবতীর্ণ করেছেন, যা কিয়ামত পর্যন্ত পঠিত থাকবে। 
লায়লাতুল কদরের ফজীলতের অন্যতম কারণ হচ্ছে, আল্লাহ তাআলা এ রাতে মানবজাতির পথপ্রদর্শনের জন্য পবিত্র কুরআনের মতো বিরাট নেয়ামত নাযিল করেছেন। এর চেয়ে বৃহত্তর কোনো নেয়ামত না মানুষ ধারণা করতে পারে, না কামনা করতে পারে। এ মঙ্গল ও বরকত এবং মহত্ব ও ফজীলতের ভিত্তিতেই পবিত্র কুরআন তাকে এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর বলে ঘোষণা করেছে। মহান আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন, লায়লাতুল কদর হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। (অর্থাৎ, তিরাশি বছরের চেয়েও এর মূল্য বেশী) (সূরা আল-কদর)
হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল করীম সা. ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কদরের রাতে ঈমানের সাথে এবং আল্লাহর কাছে প্রতিদানের আশায় ইবাদতের জন্য দাঁড়াবে, তার পেছনের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফ)
 মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বলে বর্ণিত হাদীস শরীফে পেছনের গুনাহের সাথে-সাথে আগের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়ার কথাও উল্লেখ রয়েছে। 
একটি হাদীসে আছে, নবী করীম সা. ইরশাদ করেন, যখন লায়লাতুল কদর আসে, তখন জিবরাঈল আ. অন্যান্য ফেরেশতাগণের সাথে যমীনে নেমে আসেন এবং প্রত্যেক ঐ বান্দাহর জন্যে রহমত ও মাগফেরাতের দোআ করেন, যারা দাঁড়িয়ে, বসে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীতে রত রয়েছেন। (বায়হাকীশরীফ) 
অন্য একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম সা. ইরশাদ করেন, হে লোকসকল! তোমাদের মধ্যে এমন এক রাত এসেছে, যা হাজার মাস থেকেও উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত রইলো, সে সকল প্রকার কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত রয়ে গেলো। (সুনানে ইবনে মাজাহ শরীফ)
লাইলাতুল কদর নির্ধারণ:- হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত আছে, নবী করীম সা. ইরশাদ করেন, তোমরা রমজানের শেষ দশ রাতের বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে লায়লাতুল কদর তালাশ কর। (সহীহ বুখারী শরীফ) 
শবে কদর কোন রাত্রে হবে, তা কুরআন-হাদীসে স্পষ্ট বর্ণিত হয়নি। তবে এটুকু বুঝা যায়, রমজান মাসের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাত গুলোর মধ্যে কোনো একটি, অর্থাৎ, ২১শে, ২৩শে, ২৫শে, ২৭শে, ও ২৯শে রাত। 
এ রাতকে সুস্পষ্ট করে চিহিৃত না করার তাৎপর্য এই যে, রমজানের এ শেষ দশ দিনে যাতে করে শবে কদর প্রাপ্তির আশায় নামাজ, জিকির-আজকার, দোয়া-দরুদ ও ইবাদাত-বন্দেগীর বেশী করে ব্যাবস্থাপনা করা যায়। মহান আল্লাহ এ রাতকে গোপন করে আমাদের উপর রহম করেছেন। তিনি দেখতে চান, এর বরকত ও ফজীলত লাভের জন্য কে কত প্রচেষ্টা চালাতে পারে। 
এরপরও উলামায়ে কেরাম কুরআন-হাদীস থেকে শবে কদর চেনার কিছু আলামত বর্ণনা করেছেন। 
১. কদরের রাতান্তে যখল সকাল হবে, সেদিনকার সূর্যোদয় হবে সাদা হয়ে কিরণহীয় অবস্থায় । (সহীহ মুসলিম শরীফ) অবশ্যই এ আলামতটিও কদরের রাত অতিক্রান্ত  হওয়ার পর সকালবেলায় জানা যাবে। 
২. সত্য স্বপ্নের মাধ্যমেও শবে কদর কবে, তার জ্ঞান লাভ করা যেতে পারে। যেমন রাসূল সা. এর বেলায়ও এমনটি হয়েছিলো, রাসুল সা. কে স্বপ্নের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিলো, শবে কদর কোন রাত্রে হবে। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফ) 
অধিকতর সম্ভাবনার দিক দিয়ে প্রথম হল সাতাশ তারিখ, এরপর পঁচিশ তারিখ, এরপর উনত্রিশ তারিখ, এরপর একুশ তারিখ, এরপর তেইশ তারিখ। শবে কদর কেন ২৭ শে রমজানে পালিত হয়? এ সম্পর্কে হজরত ইমাম আজম আবু হানীফা রহ. এর মতে, পবিত্র কুরআনে কদরের রাতের ফজীলত সম্পর্কে যে সূরা কদর নাজিল হয়েছে, তাতে লায়লাতুল কদরে ৯টি অক্ষর আছে। সে হিসেবে ৩*৯=২৭ রমজানকেই আমরা শবে কদর পালন করি। 
শবে কদরে আমাদের করণীয়:-
এ রাতে বেশী-বেশী দোআ করা। হাদীস শরীফে আছে, হযরত আয়েশা রা. নবী করীম সা. কে জিজ্ঞেস করলেন. শবে কদরে আমি কী দোআ করতে পারি? রাসূল সা. বললেন, তুমি এই দোআ পড়বে. আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুয়ুন, তুহিব্বুল আফওয়া, ফা’অফু আন্নি, 
অর্থ, হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালবাসেন, অবএব, আমাকে ক্ষমা করুন (তিরমিজী শরীফ)
২. বেশী-বেশী কুরআন তেলাওয়াত করা। ৩. তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলূল্লাহ ) বেশী-বেশী করে পড়া। ৪. তাসবীহ (সুবহানাল্লাহি ওয়াবিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আজীম ) বেশী বেশী পড়া । ৫. দরুদ শরীফ পড়া। ৬. নফল নামাজ বেশী-বেশী আদ-ায় করা। যথা তাহাজ্জুদের নামাজ, সলাতুত তাসবীহ, সলাতুল হাজত। 
এ রজনীতে আল্লাহপ্রেমিক বান্দাগণ নিজেদের অতীত অপরাধসমূহের জন্য অনুতাপ ও আত্মসমালোচনার  মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের প্রচেষ্টা করে থাকেন। 
মহান রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে এই অতুলনীয়, মর্যাদাময় রজনীর ফায়দা লাভের মাধ্যমে নিজেদের অতীত জীবনের ভুল-ক্রুটি ক্ষমা ও নেকীর ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করার তাওফীক দান করুন। আমীন। 

হাফেজ মাওলানা রিদওয়ানুল কাদির উখিয়াভী
বিশিষ্ট ইসলামী কলামিস্ট ও
সেক্রেটারী, পালং ইসলামী ছাত্র সংস্থা,
বৃহত্তর পালং, কক্সবাজার।
মোবা:-০১৮১২৭৬৬৮৯৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন