চার সিটি নির্বাচনের ফলাফল

 তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে নাকি বিপক্ষে  ?

বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের আমলে এবং নির্বাচন কমিশনের অধীনে ১৫ জুন রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়ে গেল, এতে সব কয়টা মেয়র ও অধিকাংশ কাউন্সেলর পদে বি,এন,পি তথা ১৮-দলের সমর্থিত প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছে।
সরকার তথা মহাজোট সমর্থিত প্রার্থীরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে। এ ফলাফলের পর বিরোধী দল বলছে সরকারের বিভিন্ন অপকর্ম, দু:শাসন, দেশ চালাতে ব্যর্থতার পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবীর প্রতিই ভোটের মাধ্যমে জনগন তাদের সুস্পষ্ট রায় দিয়েছে। আপরদিকে সরকারী দল বলছে এ নির্বাচনই প্রমান করেছে বর্তমান সরকারের আমলে এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে দেশে সব নির্বাচনই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব, কাজেই আগামী সংসদ নির্বাচনও বর্তমান দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। কিন্তু বিরোধী দল আশংকা প্রকাশ করছে এ নির্বাচনের ফলাফল দেখে সরকার আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেতার জন্য সর্বাত্মক কারচুপি’র আশ্রয় নিবে, কাজেই এ সরকারকে ক্ষমতায় রেখে বা এ সরকারের নির্বাচিত সদস্যদের দ্বারা গঠিত কোন অন্তবর্তিকালীন সরকারেরর অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দল অংশগ্রহন করবেনা। বিরোধী দল বলছে ৪ সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে সরকার টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছে যাতে বর্তমান সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বিরোধী দল অংশগ্রহন করে। উল্লেখ্য, দেশে আর কয়েক মাস পরেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের ৫ বছরের মেয়াদ শেষ হবে, নিয়ম অনুযায়ী বা সংবিধান মেতাবেক ২০১৪ সালের জানুয়ারী মাসের মধ্যে পরবর্তি সংসদ নির্বাচন করতে হবে। গনতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে এবং সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুসরন করতে হলে নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতেই হবে। পৃথিবীর সকল গনতান্ত্রিক দেশেই নির্বাচনের এ ধারা অনুসরন করা হয় এবং অন্য সব গনতান্ত্রিক দেশেই একটা স্থায়ী সাংবিধানিক ব্যবস্থার অধীনে নির্দিষ্ট সময়ে নির্বিঘেœ এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বি দলগুলোর মধ্যে কোন রকম সংঘাত বা সহিংসতা বর্জিত ( উল্লেখ করার মত নয় এমন নেহায়েত ছোট-খাটো ঘটনা ছাড়া ) শান্তিপূর্নভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে যে দল হেরে যায় তারা প্রকৃত গনতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী বিধায় এবং জনগনের মতামতের প্রতি আস্থা/শ্রদ্ধাশীল বলে নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়ে বিজিত দলকে স্বাগত জানিয়ে দেশ ও জাতির স্বার্থে গঠনমূলক সমালোচনা করা ছাড়া নির্বাচন পরবর্তি সরকারকে তার পূর্ন মেয়াদ পর্যন্ত সর্বাত্মক সহায়তা করে থাকে, যে কারণে সেসব দেশে সরকারী দল পরাজিত বা বিরোধী দল থেকেও গুরুত্বপূর্ন দায়িত্বে মন্ত্রী নিয়োগ দিয়ে থাকে। গনতন্ত্রের এমন নজীর কি আমাদের দেশে আছে ?
গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৯০ সালে তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে কথিত ( আজকের বাস্তবতায় ) স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারকে অপসারনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বি রাজনৈতিক দলগুলোর ( মূলত আওয়ামী লীগ ও বি,এন,পি ) মধ্যে কোন সহিংসতা হয়নি,। বলা যায় শান্তিপূর্নভাবেই ঐ নির্বাচনটা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু তবুও ঐ নির্বাচনে যে দল ( আওয়ামী লীগ ) হেরে গিয়েছিল তারা তাৎক্ষনিকভাবে ও সহজেই নির্বাচনের ফলাফলকে মেনে নেয়নি, নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি এবং নির্বাচনে সূক্ষ কারচুপি হয়েছে বলে অভিযোগ করেছিল। পরবর্তিতে আওয়ামী লীগ বিরোধী দল হিসেবে অন্যান্য গনতান্ত্রিক দেশের বিরোধী দলের মত প্রকৃত গনতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির আলোকে ১৯৯১ - ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত  বি,এন,পি সরকারকে গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে সহায়তা বা সহযোগিতার পরিবর্তে হরতালসহ বিভিন্ন আন্দোলনে অস্থির রেখেছিল।
এরশাদকে সরানোর পর কথিত গনতান্ত্রিক যুগের প্রথম ৫ বছর পর যখন ১৯৯৬ সালে পরবর্তি নির্বাচন হওয়ার কথা তার আগেই আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলাম ও অন্যান্য দল বি,এন,পি সরকারের বিভিন্ন অগনতান্ত্রিক কার্যকলাপ, নির্বাচন কমিশনসহ প্রশাসন দলীয়করন ও কারচুপির উপনির্বাচনের কারণে পরবর্তি ( ১৯৯৬ সালের ) নির্বাচন বি,এন,পি সরকারের অধীনে না করে একটা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের দাবীতে দেশব্যাপী রাজপথে হরতালসহ ভয়াবহ ও সহিংস আন্দোলন শুরু করে। ফলে বি,এন,পি সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মানতে বাধ্য হয় এবং সংশ্লিষ্ট দলগুলোর মধ্যে এ ব্যাপারে একটা সমঝোতা চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। অর্থাৎ বিগত ৫ বছরে ক্ষমতাসীন বি,এন,পি সরকারের কথিত গনতান্ত্রিক আচরন ও কার্যকলাপ বিরোধী দলকে একটা দলীয় ( বি,এন,পি ) সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহন করতে কোনভাবেই আশ্বস্ত করতে পারেনি, তাই তখন নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য একটা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার রূপরেখা চুড়ান্ত করে তাকে সংবিধানে সংযুক্ত করা হয়। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনেই ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, উক্ত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট জয়লাভ করে সরকার গঠন করে, এ নির্বাচনকে বি,এন,পি মেনে নিলেও ফলাফল ঘোষণার পর নির্বাচন স্বচ্ছ হয়নি এবং নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে বলে অভিযোগ করেছিল। ১৯৯১ এর নির্বাচনের পর বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ অন্যান্য গনতান্ত্রিক দেশের বিরোধী দলের মত সরকারকে গঠনমূলক সমালোচনা ও সহযোগিতার পরিবর্তে দূর্নীতি, দলীয়করন, বিরোধীদল নির্যাতন ও বিভিন্ন অভিযোগে সংসদ বর্জনসহ হরতাল ও সহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে বি,এন,পি সরকারকে যেভাবে অস্থির রেখেছিল বিরোধী দল হিসেবে বি,এন,পিও ১৯৯৬ - ২০০১ সাল পর্যন্ত (৫ বছর) আওয়ামী লীগ সরকারকে একই অভিযোগে একইভাবে অসহযোগিতা করেছিল ও বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে অস্থির রেখেছিল। তথাকথিত গনতন্ত্রের এমনি ধারাবাহিকতায় এবং ক্ষমতার পালাবদলের প্রক্রিয়ায় ২০০১ সালে আবারও তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল, এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে যায়,  বি,এন,পি আবারও ক্ষমতায় আসে। এ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরেও বরাবরের মত আওয়ামী লীগ তাৎক্ষনিকভাবে ফলাফল মেনে নেয়নি এবং নির্বাচনে স্থূল কারচুপি হয়েছে বলে অভিযোগ করেছিল। আমাদের দেশে নির্বাচনে পরাজিত দলের এটাই হলো গনতান্ত্রিক মানষিকতা। বি,এন,পি সরকার ২০০১ - ২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকে বিরোধী দল দমনসহ দূর্নীতি ও দু:শাসনের অভিযোগের কথা বাদ দিলেও প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে যেভাবে দলীয়করন এবং পরবর্তি নির্বাচনে জয়লাভ করার নীলনক্সা ও কৌশল প্রনয়ন করেছিল তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটাকেই বিতর্কিত করে তুলেছিল। বি,এন,পি সরকার তার স্বীয় স্বার্থে গঠিত ঐ সময়ের নির্বাচন কমিশন, সাজিয়ে রাখা প্রশাসন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ( যার প্রধান উপদেষ্টা হয়েছিল বি,এন,পি সরকারের প্রেসিডেন্ট ইয়াজ উদ্দীন আহমেদ ) অধীনেই নির্বাচন করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছিল, কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন কথিত মহাজোট ( এরশাদের জাতীয় পার্টিসহ ) নির্বাচন বয়কট করে এবং ইয়াজ উদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে। স্বৈারাচারমুক্ত কথিত গনতান্ত্রিক যুগের ঐ আন্দোলন এমন পর্যায় ও মাত্রায় উঠেছিল যা স্মরনকালের সবচেয়ে ভয়াবহ ও সহিংস ঘটনায় রূপ নিয়েছিল, সহিংসতা ও আন্দোলনের যাতাকলে পড়ে সারা দেশের জনগন দুই দল বা জোটের কাছে জিম্মি হয়ে গিয়েছিল, ঢাকা শহর বলতে গেলে প্রায় ১ মাস অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিল। দুই জোটের পাল্টা-পাল্টি ও সহিংসতার ফলে সৃষ্ট শাসরুদ্ধকর ঐ পরিস্থিতির অবসান হওয়ার কোন লক্ষন যখন একবারেই দেখা যাচ্ছিলনা তখন সেনাবাহিনীর তৎকালীন প্রধান জে: মইন, ইউ, আহমেদ  এহেন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রানের জন্য জনগনের সেন্টিম্যান্টকে সঠিক ও বিচক্ষনভাবে বুঝতে পেরে প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দীনকে দিয়ে দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে এবং ইয়াজ উদ্দীনকে সরিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান ফখরুদ্দীনকে প্রধান উপদেষ্টা করে সেনাবাহিনীর পৃষ্টপোষকতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্গঠিত করে। দৃশ্যত তখন দেশে তত্ত্বাবধায়ক নামক সরকার বহাল থাকলেও মূলত বা পরোক্ষভাবে সেনাবাহিনীর আনুগত্যকে কাজে লাগিয়ে জে: মইনই দেশ শাসন করতে শুরু করে। বি,এন,পি’র নীল-নক্সা অনুযায়ী নির্বাচন না হওয়ায় খুশি হয়ে আওয়ামী জোট জে: মইন এর উদ্যোগকে স্বাগত জানায় এবং মইনুদ্দীন-ফখরুদ্দীনের কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে তাদের আন্দোলনের ফসল বলে দাবী করে এবং আত্মতৃপ্তি প্রকাশ করে।
কিন্তু কিছুদিন যাওয়ার পরেই দুই জোট বিশেষ করে আওয়ামী জোট মইনুদ্দীন-ফখরুদ্দীনের কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আসল রূপ টের পেতে শুরু করে। ১৯৯৬ সালের সমঝোতা বা রূপরেখা অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল দায়িত্ব বা কাজ হলো ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করে নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া। বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রয়োজনে পূর্ববর্তি নির্বাচিত সরকারের ফেলে যাওয়া ( সাজিয়ে যাওয়া ) প্রশাসন ও নির্বাচন সংশিষ্ট বিভিন্ন স্তরে রদবদল করতে পারে।  কিন্তু জে: মইনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে মনযোগ দেওয়ার পরিবর্তে ক্ষমতায় বসেই রাজনীতিবিদদের চরিত্র হনন তথা জনগনের কাছে তাদেরকে অবাঞ্চিত বা অগ্রহনযোগ্য করে তোলার উদ্দেশ্যে দুই দলের শীর্ষ নেত্রীসহ শত শত নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে দূর্নীতির মামলা দিয়ে জে: মাসুদ এর তত্ত্বাবধানে গঠিত দূর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে তাদেরকে একে একে জেলে পাঠাতে শুরু করে দিল এবং মার্শাল-ল কোর্টের পরিবর্তে ( যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের লেবেল লাগানো ছিল ) বিশেষ আদালতের ( ক্যাঙ্গারু কোর্টের ) মাধ্যমে বিচার করে তাদেরকে সাজাও দেওয়া শুরু করে দিল। এক পর্যায়ে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকেও সংসদ ভবনের পাশে বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত জেলে আটকে রাখা হলো। চেষ্টা শুরু করে দিল দুই নেত্রীকে মাইনাস করার এবং আওয়ামী লীগ ও বি,এন,পিকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দেওয়ার পরিকল্পনা। সাথে সাথে জে : মইনের ত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশে ও বিদেশে তাবেদার ও বর্নচোরা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দ্বারা কিংস পার্টি গঠনের উদ্যোগও নিয়েছিল। জে: মইন ও জে: মাসুদের এ পরিকল্পনা ও উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘ সমরেয়র প্রয়োজন, কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারকেতো ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে বিদায় নিতে হয়। জে: মইনের জরুরী অবস্থার সরকার যদিও  মূলত তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়, কিন্তু দেশবাসী ও বিদেশের কাছেত তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবেই পরিচিত। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মোড়কে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কৌশল হিসেবে জে: মইনের জরুরী অবস্থার সরকার তাদেরই তল্পিবাহক/ক্রীড়নক নির্বাচন কমিশনকে সুকৌশলে কাজে লাগাল। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ দাবী করেছিল ছবিযুক্ত ভোটার লিষ্ট তৈরী করতে হবে। নির্বাচন কমিশন এটাকে আর একটু সংস্কার করে ৪০০ কোটি টাকা খরচ করে ছবিযুক্ত ভোটার লিস্ট তথা জাতীয় পরিচয় পত্র তৈরীর পরিকল্পনা নেয় এবং এ দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে দেয়। নির্বাচন কমিশন এ কাজ শেষ করতে কমপক্ষে ১৮ মাস লাগবে বলে জে: মইনকে ও দেশবাসীকে আশ্বস্ত করে। এই সুবাদে ( আওয়ামী লীগের দাবীকে কাজে লাগিয়ে ) জে: মইনের কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২ বছর ক্ষমতায় থাকার সুযোগ পেয়ে গেল। এই সময়ের মধ্যে দূর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে মামলা সাজিয়ে রাজনীতিবিদদের একে একে জেলে পাঠাতে শুরু করে দিল এবং ক্যাঙ্গারু কোর্টের মাধ্যমে বিচার করে তাদেরকে সাজা দেওয়ার কাজও জোরালো করল। আরো ১৮ মাস ক্ষমতায় থাকার সময় পেয়ে দুই নেত্রীকে মাইনাস করার এবং আওয়ামী লীগ ও বি,এন,পিকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিয়ে  কিংস পার্টি গঠনের কাজও এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যায়। কিন্তু কোন ষড়যন্ত্র বা দূরভিসন্ধিই সফল বা দীর্ঘস্থায়ী হয়না। জে: মইনের কথিত তত্ত্বাধায়ক সরকারেরও দুই নেত্রীকে মাইনাস করতে, দুই দলকে টুকরো টুকরো করতে ( যদিও প্রচষ্টা শুরু করেছিল ) এবং নিজস্ব কিংস পার্টি গঠন করে ভবিষ্যতে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন সফল হয়নি। শেষ পর্যন্ত সবকিছুতে তাল-গোল পাকিয়ে অর্থাৎ লেজে-গোবরে অবস্থা সৃষ্টি করে ব্যর্থতা ও ষড়যন্ত্রের দায়ভার থেকে বাঁচার জন্য জে : মইনের কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। ঐ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিপুল ভোটে জয়লাভ করে ২০০৯ এর জানুয়ারীতে সরকার গঠন করে। জেনারেল মইনের জরুরী অবস্থার সরকার যে প্রকৃত অর্থে সংবিধান অনুযায়ী এবং ১৯৯৬ সালে সর্বদলীয় সমঝোতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিলনা এটা তাদের কার্যকলাপ ও দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার মধ্য দিয়েই প্রমান করে গেছে। এর আগে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচন হয়েছিল প্রকৃত অর্থে ১৯৯৬ সালে সর্বদলীয় সমঝোতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে । সে সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ৯০ দিনের মধ্যেই নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক রদবদল ছাড়া জেনারেল মইনের কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মত অন্য কোন দিকে অযাচিতভাবে হস্তক্ষেপ করেনি। কাজেই জেনারেল মইনের ১/১১ এর সরকার আর প্রকৃত অর্থে ১৯৯৬ সালে সর্বদলীয় সমঝোতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনভাবেই এক হতে পারেনা। 
কিন্তু আওয়ামী জোট তথা মহাজোট ১/১১ এর সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়লাভ করার পর ৩ বছর না যেতেই উচ্চ আদালতের এক রায়ের দোহাই দিয়ে বিরোধী দল বা অন্য কোন পক্ষের সাথে আলাপ-আালোচনা না করে সংসদে তাদের সংখ্যাগড়িষ্ঠতার জোরে বিল পাশ করে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। এর আগে সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে দেশের সর্বস্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ও লোকজনের মতামত গ্রহন করেছিল, তাদের মধ্যে প্রায় ৯৫%ই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছিল, এমনকি দল হিসেবে আওয়ামী লীগও এই ব্যবস্থার পক্ষেই মত দিয়েছিল। কিন্তু একমাত্র অওয়ামী লীগ প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক বাতিলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন, তারই ব্যক্তিগত অবস্থানের আলোকে উচ্চ আদালত ( মূলত প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক ) কিছুদিনের মধ্যেই উদ্দেশ্যমূলক এক রীটের পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে অগনতান্ত্রিক ও সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে তা বাতিল করার পক্ষে রায় দেয়। অথচ এ ব্যাপারে বিচারপতিদের নিয়ে গঠিত এমিকাস কিউরীর অধিকাংশ ( ৯০% ) সদস্যই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। উচ্চ আদালতের প্রাথমিক বা খন্ডিত রায়ে অবশ্য এও উল্লেখ ছিল সংসদ মনে করলে জাতীয় প্রয়োজনে ( উড়পঃৎরহব ড়ভ হবপবংংরঃু ) পরবর্তি আরো ২ টা নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে, তবে বিচারপতি বা বিচার বিভাগের কাউকে এ সরকারের প্রধান হিসেবে মনোনয়ন বা নিয়োগ দেওয়া যাবেনা। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের সংসদ রায়ের এ অংশটাকে উপেক্ষা করে উচ্চ আদালতের পূর্নাঙ্গ রায় বের হওয়ার আগেই তড়ি-ঘড়ি করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে এ ব্যাপারে সংবিধান সংশোধন করে নেয়। স্বভাবতই প্রধান বিরোধী দল বা জোট নির্বাচনের ২ বছর আগে আদালতকে ব্যবহার করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বতিল করে কথিত গনতান্ত্রিক পন্থায় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি। তাদের অভিযোগ সরকার আগামী নির্বাচনে জয়লাভ করা তথা আবারো ক্ষমতায় থাকার উদ্দেশ্যেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে তাদের দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার বন্দোবস্ত করেছে। বিরোধী জোট সরকারের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে এবং তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুন:বহালের দাবীতে বিগত এক বছর যাবত রাজপথে আন্দোলন করে আসছে। হরতালসহ সহিংস আন্দোলনে ইতমধ্যে বহু জানমালের ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে, দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, জনগনের ভোগান্তি চরমে পৌছেছে। সরকারের মনোভাবও এ ব্যাপরে অনড়, তারা শেখ হাসিনাকে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান রেখে বর্তমান সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন করতে বদ্ধ পরিকর, অপরদিকে বিরোধী জোটও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন দলীয় সরকারের অধীনে কোন নির্বাচনে যাবেনা এবং দেশে এমন নির্বাচন হতে দিবেনা বলেও হুমকী দিচ্ছে। অর্থাৎ এ ব্যাপারে সরকার ও বিরোধী জোটের মধ্যে কোন সংলাপ বা কোন সমঝোতা না হলে নির্বাচনের আগে আগামী দিনগুলোতে দেশে আরো অরাজক ও সহিংস ঘটনা বৃদ্ধি পাবে বলে সবাই আশংকা করছে।
সরকার বলছে আদালতের রায়ের ভিত্তিতেই তারা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করেছে, সুতরাং সংবিধানের বাইরে তারা কোন কাজ করবেনা। প্রশ্ন হচ্ছে: একটা দেশের জনগন বড় নাকি সংবিধান বড় ? সংবিধান দেশের জনগনই তথা মানুষেই তৈরী করেছে, এটা ৪র্থ আসমান থেকে অহি হিসেবে নাজিল হওয়া কোন গায়েবী ( আল্লাহÍ ) কিতাব ( পবিত্র কোরআন ) নয় যে এটাকে পরিবর্তন করা যাবেনা। এ দেশের শাসক ও জনপ্রতিনিধিরাই বর্তমান সংবিধানকে জনগনের তথা নিজেদের প্রয়োজনে ১৪/১৫ বার কাট-ছাট করে সংশোধন করেছে।  দেশের স্বার্থে, জনগনের স্বার্থে, দেশকে সহিংসতা ও নৈরাজ্য থেকে রক্ষা করার স্বার্থে, সবার কাছে গ্রহনযোগ্য একটা নির্বাচন করার স্বার্থে প্রয়োজনে আবারও সংবিধান সংশোধন করা কোন পাপ বা কবিরা গুনা হবেনা। ১৯৯৬ সালের নির্বানের আগে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দলের তীব্র আন্দোলনের মূখে তৎকালীন বি,এন,পি সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মেনে নিয়ে তাকে সংবিধানে সংযোজন করেছিল। 
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে এখন বলা হচ্ছে গনতন্ত্রের পরিপন্থি ও সংবিধানের সাথে সংগতিহীন বা সাংঘর্ষিক। ১৯৯৬ সালের আগে যখন এ ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য আন্দোলন করা হয়েছিল তখন কি এ কথা মনে ছিলনা ? প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন, বিচারপতি হাবিবুর রহমান ও বিচারপতি লতিফুর রহমান সাহেবরা যখন ইতিপূর্বে তিনটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তখন তারা কি বুঝতে অক্ষম ছিলেন যে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা গনতন্ত্রের পরিপন্থি ও সংবিধানের সাথে সংগতিহীন বা সাংঘর্ষিক ? তাহলে বিজ্ঞ আইণজীবি ও বিচারক হয়ে তারা কি তখন কথিত গনতন্ত্র পরিপন্থি এ দায়িত্ব পালন করে সংবিধান লংঘনের মত অপরাধ করেছিলেন ? শেখ হাসিনার আওয়ামী জোট সরকারের আমলে প্রধান বিচারপতি হয়ে খায়রুল হক সাহেব ২০১২ সালে বুঝতে পারলেন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা গনতন্ত্রের পরিপন্থি ও সংবিধানের সাথে সংগতিহীন বা সাংঘর্ষিক।  তাহলে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন, বিচারপতি হাবিবুর রহমান ও বিচারপতি লতিফুর রহমান সাহেবরা কি প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের মত জ্ঞানী-গুনি ছিলেননা ? 
একটা দেশের নির্বাচন পদ্ধতি কি বা কেমন হবে এটা একটা রাজনৈতিক বিষয়, রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট সংগঠন বা ব্যক্তিরা আলাপ-আলোচনা ও ঐক্যমতের ভিত্তিতে সংসদের বাইরে বা ভেতরে বসে তা নির্দ্ধারন বা ঠিক করবে, এটাই স্বাভাবিক। আদালত থেকে রাজনৈতিক বিষয় নির্দ্ধারন বা ঠিক করে দেওয়াটাই হবে অস্বাভাবিক। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মত একটা রাজনৈতিক বিষয়কে বাতিল করে আদালত রায় দেওয়ার পর এ নিয়ে দেশে এখন যে ভয়াবহ রাজনৈতিক সহিংসতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে আদালত বা কোন বিচারপতি আর একটা রুল জারী করে বা ফরমান দিয়ে তা এখন বন্ধ করে দিতে বা এর সমাধান দিতে পারেনা কেন ? এখন কেন রাজনীতিবিদদেরকেই দ্বিপক্ষীয়ভাবে বা কোন দেশী-বিদেশী তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্ততায় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানের জন্য তাগিদ দেওয়া হচ্ছে ? কাজেই যেটা রাজনৈতিক বিষয় এবং যেটা রাজনীতিবিদরাই সমাধান দিবেন সে বিষয় আদালতে টেনে আনা যেমন ঠিক নয় আদালতেরও এমন রাজনৈতিক (স্পর্সকাতর ) বিষয় উপেক্ষা করাই দেশ ও জাতির স্বার্থে শ্রেয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয় রাজনৈতিক বিষয় ছাড়া আমাদের দেশে আরো অনেক বিষয় বা জনগুরুত্বপূর্ন সমস্যা আছে যেখানে স্বতোপ্রনোদিত হয়ে আদালতের তথা বিচারকদের কঠোরভাবে হস্তক্ষেপ করা প্রয়োজন।  কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য রাজনৈতিক বিবেচনায় বা দলীয় আনুগত্যের সুবাদে নিয়োগ পাওয়া বিচারপতিদের দ্বারা পরিচালিত বিচার বিভাগ আজ কথিত বিচার বিভাগের স্বাধীনতার নামে দলীয় সরকার বা দলীয় সরকারের প্রশাসন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত / নির্দেশিত হয়েই বলতে গেলে বিচার ( উল্লেখ করার মত নয় সামান্য বিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ) কাজ পরিচালনা করছেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হয়ে এমনই একটা স্পর্শকাতর ও  বিতর্কিত রাজনৈতিক বিষয়ে রায় দিয়ে সারা দেশে আগুন লাগিয়ে দিয়ে চলে গেছেন, এ আগুনে এখন জ্বলছে দেশের সাধারন মানুষ, দেশের সম্পদ, বিদেশের কাছে বাংলাদেশকে একটা সহিংস ও অকার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে গেছেন।
বিরোধী জোটের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুন:বহালের দাবীর জবাবে শেখ হাসিনা বার বার ১/১১ এর কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা উল্লেখ করে বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়াকে জুজুর ভয় দেখান। অথচ শেখ হাসিনা নিজেও জানেন ও বুঝেন জেনারেল মইনের ১/১১ এর জরুরী অবস্থার কথিত তত্ত্বাধায়ক সরকার আর ১৯৯৬ ও ২০০১ এর নির্বাচন পরিচালনাকারী তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনভাবেই এক জিনিষ নয়। অথচ মজার ব্যাপার হলো ১/১১ এর কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকেই শেখ হাসিনা সন্তুষ্ট চিত্তে তাদের ২০০৭ - ২০০৮ এর আন্দোলনের ফসল বলে বহুবার দেশের ও বিদেশের জনগনের কাছে দাবী করেছেন। শুধু তাই নয়, ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা তৈরী করার দাবী জানিয়ে প্রকারান্তরে শেখ হাসিনাই জে : মইনের কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ২ বছর ক্ষমতায় থাকার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ভোটার তালিকায় ভূয়া ভোটার অন্তর্ভূক্ত হওয়ায় শুধু তাকে আবার সংশোধন বা হাল নাগাদ করলেই তা ২ মাসের মধ্যে করা যেত, ছবিযুক্ত ভোটার লিস্ট তৈরী করা একটা সময় সাপেক্ষ ব্যয়বহুল ব্যাপার, এ দাবীকে পুঁজি করেই নির্বাচন কমিশন আরো এক ধাপ এগিয়ে একই সাথে জাতীয় পরিচয় পত্র তৈরীর পরিকল্পনা করে জে : মইনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। তাছাড়া যে ১/১১ এর তত্ত্বাধায়ক সরকারের উদাহরন দিয়ে শেখ হাসিনা এখন খালেদা জিয়া তথা বিরোধী জোটকে ভয় দেখাচ্ছেন ক্ষমতায় আসার আগে তিনিই বার বার দাবী করেছেন এটা তার ও তার জোটের আন্দোলনের ফসল এবং মইনুদ্দীন-ফখরুদ্দীনের কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সকল কর্মকান্ডকে ক্ষমতায় গেলে তিনি বৈধতা দিবেন। খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠ জন বা বিরোধী মহল থেকে এ কথাও শোনা যায় বা অভিযোগ করা হয় জে : মইনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বন্দি অবস্থায় থাকাকালীন শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার কাছে মইনুদ্দীন-ফখরুদ্দীনের কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সকল কর্মকান্ডকে বৈধতা দিলে এবং ক্ষমতায় গেলে তাদের করো বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হবেনা - এ ব্যাপারে মুচলেকা দিলে বা অংগীকার করলে তাদেরকে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়ে বিদেশ যেতে বা রাজনীতি করতে দেওয়া হবে। এ ব্যাপারে খালেদা জিয়া কোন আপোষ করেননি। শেখ হাসিনা রাজী হওয়ায় তাকে বিদেশে যেতে দেওয়া হয় এবং পরবর্তিতে বি,এন,পি’র শীর্ষ নেতাদেরকে কথিত দূর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত করে জেলে ভরে, সাজা দিয়ে, তারেক রহমানকে শারীরীকভাবে পঙ্গু করে দিয়ে, নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে বি,এন,পিকে ২ টুকরো করার চেষ্টা চালিয়ে নির্বাচনের আগে দলে বিভক্তি সৃষ্টি করে , নির্বাচনের আগে বি,এন,পি’র নেতাদের গায়ে সফলভাবে দূর্নীতির লেবেল লাগিয়ে জে : মইন নির্বাচনে বি,এন,পি’র ভরাডুবি’র ব্যবস্থা করে ( নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছিল বলেও বি,এন,পি অভিযোগ করেছিল ) শেখ হাসিনার জোটকে নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়লাভ করার পথ সুগম করে দিয়েছিল। বি,এন,পি বা বিরোধী জোটের এ অভিযোগের ( যদি সত্য নাও হয় )  সত্যতার প্রমান পাওয়া যায় ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা সরকার জে : মইনের কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দ্বারা তার নিজের ( বন্দি রাখা অবস্থায় তাকে খাদ্যে বিষ মিশিয়ে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্রসহ ) ও তার দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতার জেল-জুলুম-অত্যাচারের জন্য জে : মইন, জে : মাসুদ বা অন্য কারো বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা  নেয়নি। বরং  তার ওয়াদামত সেই সরকারের সকল কর্ম-কান্ডকে বৈধতা দিয়েছেন এবং জে : মইন ও ফখরুদ্দীনকে নির্বিঘেœ বিদেশে যেতে ও জে : মাসুদকে বিদেশে রাষ্ট্রদূত করে পাঠিয়ে দিয়েছেন ( এখনও সেখানে কর্মরত আছে )। অবস্থার পূর্বাপর বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায় শেখ হাসিনা ১/১১ এর সরকারের সার্বিক আশীর্বাদ পেয়েই ক্ষমতায় এসেছেন। অথচ এখন খালেদা জিয়া ও বিরোধী জোটকে ১/১১ এর কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভয় দেখিয়ে বলছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসলে আবারও যে উনি ( খালেদা জিয়া )  জেলে যাবেননা এর কি কোন নিশ্চয়তা আছে ? প্রশ্ন হচ্ছে শেখ হাসিনা আন্দোলন করে ১৯৯৬ সালে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবী প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন, হাবিবুর রহমান ও লতিফুর রহমানের তিনটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি জে : মইনের ১/১১ এর কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মত ২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন বা শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে জেলে ঢুকিয়েছিলেন ? ১৯৯৬ ও ২০০১ এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উদাহরন না দিয়ে জে : মইনের ১/১১ এর কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উদাহরন দিয়ে শেখ হাসিনা বিরোধী দলকে যে জুজুর ভয় দেখাচ্ছেন জনগন এটা সহজেই বুঝতে পারে, জনগনকে এত বোকা ভাবা ঠিক নয়।
সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে দিয়ে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী জোট সরকারের মন্ত্রী ও সমর্থকরা এখন বেশ জোরালোভাবে বলছে নির্বাচিত দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়াটাই গনতান্ত্রিক, অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করা অগনতান্ত্রিক। একটা নির্বাচিত সরকার আর একটা নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে এটাই গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা। তাহলে আমাদের দেশের ( অন্য দেশের কথা বাদ দিলেও ) হাজারো সংগঠন ও সংস্থায় যেসব নির্বাচন হচ্ছে সেখানে কি নির্বাচিত ক্ষমতাসীন কমিটির দ্বারাই পরবর্তি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ? বর্তমানে দেশে যেসব স্থানীয় সরকার ও জেলা পরিষদ রয়েছে সেখানে কি অনির্বাচিত প্রশাসকরা দায়িত্ব পালন করছেনা ? সেখানে কি একটা নির্বাচিত সরকার বা প্রশাসন আর একটা নির্বাচিত প্রশাসন বা কমিটির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করছে ( ঢাকা সিটি করপোরেশনই তার প্রকৃষ্ট উদাহরন ) ? এটা কি অগনতান্ত্রিক নয় ? অথবা এমন অগনতান্ত্রিক ব্যবস্থা কি গনতান্ত্রিক নির্বাচন ও ক্ষমতা হস্তান্তরকে বাধাগ্রস্থ করছে ?  
খেলার মাঠে খেলা পরিচালনার জন্য নিরপেক্ষ রেফারী নিয়োগ করা হয়, প্রতিদ্বন্দ্বি দুই দলের মধ্য থেকে টসের মাধ্যমে কাউকে রেফারী নিয়োগ করা হয়না কেন ? তাহলে এটা কি অগনতান্ত্রিক ব্যবস্থা নয় ? দুই দলের মধ্য থেকে কাউকে রেফারী করা হলে পক্ষপাতিত্ব করা হবে অর্থাৎ এক দলের উপর আর এক দলের বিশ্বাস বা আস্থা নাই বলেই খেলা পরিচালনার জন্য নিরপেক্ষ রেফারী নিয়োগ দেওয়া হয়। তেমনিভাবে নির্বাচনটাও প্রতিদ্বন্দ্বি রাজনৈতিক দলের একটা খেলা, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস না থাকে তবে এখানেও একজন নিরপেক্ষ রেফারীর মত যদি নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য একটা অনির্বাচিত সরকার ( তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বতি সরকার ) নির্বাচন পরিচালনা করে তবে তা অগ্রহনযোগ্য বা অযৌক্তিক হবে কেন ? একটা সুষ্ঠু, অবাধ ও সকলের কাছে গ্রহনযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে যদি একটা নিরপেক্ষ ( তৃতীয় গক্ষ ) ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন হয় তবে তার মাঝখানে গনতন্ত্র আর অগনতন্ত্রের প্রাচীর দাড় করানোর কি যুক্তি থাকতে পারে ? এ ব্যাপারে বর্তমান সরকার পৃথিবীর অন্যান্য গনতান্ত্রিক দেশের উদাহরনও দিচ্ছে। অথচ তার আগে একবারও আত্ম-পর্যালেচনা বা উপলব্ধি করা হয়না যে আমরা কি অন্যান্য গনতান্ত্রিক দেশের মত বিগত ৪২ বছরে প্রকৃত অর্থে গনতান্ত্রিক হতে পেরেছি ? কথিত ’৯০ এর গনতান্ত্রিক আন্দোলনের পর “গনতন্ত্র” ছিনিয়ে এনে বিগত ২৩ বছরে কি দেশে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে বা গনতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পেরেছি ? বরং গনতন্ত্রকে সহিংসতা ও সন্ত্রাসে পরিনত করেছি, কথিত গনতান্ত্রিক যুগের প্রতিটি নির্বাচনের সময়েই দেশে রাজনৈতিক হানা-হানি ও সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠেছে। আমরা এমন গনতন্ত্রই প্রতিষ্ঠা করেছি যে একটা নির্বাচনও আমরা শান্তিপূর্নভাবে সম্পন্ন করতে পারিনা। গনতন্ত্রের অন্যতম প্রধান উপাদান হলো পরমত সহিষ্ণুতা, উন্নত গনতান্ত্রিক দেশের জনগন বা রাজনীতিবিদদের মত আমাদের বিশেষ করে আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে কি এই গনতান্ত্রিক মানষিকতা আছে ? আমাদের দেশে বিরোধী বা নিরপেক্ষ মতকে যেভাবে কটাক্ক ও সমালোচনা করে উপেক্ষা করা হয় এবং বিরোধী দলকে দমন ও পীড়ন করা হয় পৃথিবীর অন্য কোন গনতান্ত্রিক দেশে কি সেভাবে করা হয় ? আমাদের দেশে বিরোধী দল যেভাবে গনতান্ত্রিক অধিকারের নামে সহিংস রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালায় এবং আপরদিকে সরকারও যেভাবে বিরোধী দলীয় নেতাদের রাজপথে চোরের মত পিটায়, গুলি করে মারে, মামলার পর মামলা, রিমান্ডে নিয়ে অমানুষিক অত্যাচার এমনকি রাজনৈতিক নেতাদের চোর-ডাকাতের মত ডান্ডা-বেরী পড়িয়ে রাখা হয় পৃথিবীর অন্য কোন গনতান্ত্রিক বা সভ্য দেশে কি তা হয় ? আমাদের দেশে তথাকথিত সংসদীয় গনতন্ত্রের আবরনে যেখানে এক ব্যক্তির হাতে স্বৈরাচারের মত ক্ষমতা থাকে ও প্রয়োগ করা হয় অন্য কোন গনতান্ত্রিক দেশে কি তা আছে ? আমাদের দেশে লাগাতার সংসদ বর্জনের যে সংস্কৃতির চর্চা চলছে অন্য কোন গনতান্ত্রিক দেশে কি তা আছে ? অন্যান্য দেশের সংসদে যে কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে উত্তেজনা বা মারামারিও হয়, কিন্তু সেসব দেশে আমাদের দেশের সংসদের মত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে কুৎসিত মন্তব্য, অসভ্য ও অশ্লীল ভাষায় গালাগালি ও মারামারির উপক্রম হয়না, ঐসব দেশের রাজনীতিবিদরা দাবী আদায়ের বা সরকারের বিরোধিতার জন্য রাজপথে সাধারন মানুষকে কষ্ট দিয়ে এমন সহিংস আন্দোলন করেনা। আমাদের দেশের ক্ষমতাসীন দল পরবর্তি মেয়াদে আবারও ক্ষমতায় আসার উদ্দেশ্যে নির্বাচন কমিশনসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত প্রশাসনের সর্বস্তরে যেভাবে দলীয় আনুগত্যের লোকজনকে বসিয়ে দলীয়করনের নজীর স্থাপন করে পৃথিবীর অন্য কোন গনতান্ত্রিক দেশে শুধু পরবর্তিতে আবারও ক্ষমতায় আসার উদ্দেশ্যে কি এমন দলীয়করন করা হয় ? আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার পর বিচারালয়সহ সব কয়টা সাংধিানিক ও গনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করন করে যেভাবে কলুষিত ও ধ্বংশ করে পৃথিবীর অন্য কোন গনতান্ত্রিক দেশে কি তা করা হয় ?  আমাদের দেশে নির্বাচনের আগে কোটি কোটি টাকার মনোনয়ন বানিজ্য ( ঐড়ৎংব ঞৎধফরহম ) হয়, ভোটের আগে টাকা-পয়সা দিয়ে ভোটার কেনা যায়, পৃথিবীর অন্য কোন গনতান্ত্রিক দেশে কি তা হয় ? এমন আরো অনেক বিষয় ও ক্ষেত্র আছে যা অন্যান্য গনতান্ত্রিক দেশে বিদ্যমান, কিন্তু আমাদের দেশে অনুপস্থিত। কাজেই কেবল স্বীয় রাজনৈতিক স্বার্থে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের উদ্দেশ্যে পৃথিবীর অন্যান্য গনতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনের উদাহরন বা তুলনা দেওয়া কি আমাদের দেশের রাজনীতিবিদ বা ক্ষমতাসীন সরকারের বেলায় শোভা পায় ?  অন্যান্য গনতান্ত্রিক দেশের মত গনতন্ত্রের মূল ও প্রতিটি বিষয় যদি আমরা অনুসরন করতাম তবে নির্বাচনের ব্যাপারেও অন্যান্য গনতান্ত্রিক দেশের ব্যবস্থা বা পদ্ধতিকে অনুসরন করা বা তুলনা দেওয়া যথার্থ ও যৌক্তিক বলে বিবেচনা করা যেত। আওয়ামী জোট সরকার সমর্থিত কিছু কিছু মহল ও ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন সময়ে টেলিভিশনের টক-শোসহ বিভিন্ন জায়গায় বেশ জোরালো গলায় বলে যে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ যেভাবে গনতান্ত্রিক চর্চায় এগিয়ে গেছে আমাদেরকেও এগিয়ে যেতে হবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার অগনতান্ত্রিক ধ্যান-ধারনা ও ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে এসে আমাদেরকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে, আমরা আর কত পিছিয়ে থাকব ইত্যাদি, ইত্যাদি। অর্থাৎ আমাদের মত বিতর্কিত ও বিকৃত গনতান্ত্রিক দেশে একটা সুষ্ঠু, ১০০% অবাধ ও সবার কাছে গ্রহনযোগ্য নির্বাচন করার তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থাকে উনারা অগনতান্ত্রিক ও পিছিয়ে থাকার মানষিকতা হিসেবে বুঝাতে চাচ্ছেন, অপরদিকে সমস্ত প্রশাসন যন্ত্রকে প্রভাবিত করে ১০০% কারচুপি করার সম্ভাবনা ও সুযোগ সম্বলিত ক্ষমতাসীন দলের অধীনে দেশে বিদেশে সবার কাছে অগ্রহনযোগ্য একটা নির্বাচন করাকে উনারা গনতান্ত্রিক ও সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চাবিকাঠি বলে মনে করছেন। আসলে তাদের ফরমূলামত দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তাদের সমর্থিত আওয়ামী জোটই আবার ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা বেশী বলে তারা তাদের চিন্তা-ভাবনা, মন-মানষিকতা ও প্রচারনাকে এভাবে সেট করে নিয়েছেন। অথচ পৃথিবীর অন্যান্য গনতান্ত্রিক  দেশের মত আমাদের দেশের গনতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য গনতান্ত্রিক চর্চায় ও মানষিকতায় আমাদের যে ঘাটতি রয়েছে সবার আগে সেখান থেকে বের হয়ে আসার কোন ফরমূলা উনারা তাদের সমর্থিত সরকারকে দেননা। শুধু দলীয় সরকারের অধীনে একটা নির্বাচন করলেই কি আমরা তাদের ভাষায় সত্যিকার অর্থে গনতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যাব ? ২৩ বছর যাবততো দেশের মানুষ নির্বাচন দেখছে, কিন্তু প্রকুত গনতন্ত্র কি দেখতে পাচ্ছে ? 
সরকারী মহল ও তাদের সমর্থকেরা প্রায়ই বলে যাচ্ছেন নির্বাচন কমিশন একটা স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, তারাই নির্বাচন করবে, সুতরাং নির্বাচন কমিশনকে প্রয়োজনে আরো কিভাবে শক্তিশালী করা যায় তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এটাও একটা হাস্যকর ও প্রহসনের প্রলাপ ছাড়া আর কিছু নয়। আমাদের দেশে নির্বাচন কমিশন যে একটা ঠুটো জগন্নাথ এটা সবাই জানে ও দেখে, নামে সাংবিধানিক ও স্বাধীন হলেও এটা আসলে পরাধীন তথা সরকারের অধীন। যে সরকার ক্ষমতায় আসে নির্বাচন কমিশনকে তাদের পছন্দের লোক দ্বারা গঠিত করে এবং নির্বাচনের সময় তাদেরকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারের আমলের নির্বাচন কমিশনের আচরন ও কর্মকান্ড জনগন প্রত্যক্ষ করেছে এবং তাদের ব্যাপারে বিরোধী দলের আপত্তি সব সময়েই ছিল, ২০০৭-২০০৮ সময়ের মধ্যে তা আরো প্রকট হয়েছিল। তাছাড়া নির্বাচন কি শুধু নির্বাচন কমিশনই করে ? নির্বাচনের সাথে সরকারের আরো অনেক মন্ত্রনালয় ও বিভাগ সরাসরি ও পরোক্ষভাবে জড়িত। সরকার কি নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনীসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের কাছে ন্যস্ত করবে ? যদি তা করা হয় তবে বুঝা যাবে নির্বাচন কমিশন সত্যিকার অর্থে নির্বাচনের সময় স্বাধীনভাবে কাজ করছে কিনা এবং সরকার ঐ সময় নি®ীŒয় ও নিরপেক্ষ থাকছে কিনা। সরকারী মহল ও তাদের সমর্থকেরা তাদের কথিত ইচ্ছানুযায়ী “গনতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে” সব দলের ঐক্যমতের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশনকে পুনর্গঠিত করে পরীক্ষামূলকভাবে অন্তত একবার সরকারকে কি এ ফরমূলা গ্রহন করার উপদেশ দিবেন ?   
সরকারী মহল ও তাদের সমর্থকেরা প্রায়ই এ কথাও বলে যাচ্ছেন এ সরকারের আমলে প্রায় ৬০০০ এর মত স্থানীয় ও কয়েকটা উপ-নির্বাচন হয়েছে, কোথাও কোন কারচুপি বা সরকারী হস্তক্ষেপ হয়নি। স্থানীয় ও উপ নির্বাচন আর জাতীয় নির্বাচনের গুরুত্ব এক নয়, এসব নির্বাচনে জয় পরাজয় সরকার বা বিরোধী দলের কোন মাথা ব্যাথার কারণ নয়। এ কারণে এসব নির্বাচনে সরকারের তেমন হস্তক্ষেপ করা বা কারচুপি করার প্রবনতা কম থাকে। বর্তমান ৪ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনই তার প্রমান, এমন ফলাফলের পরেও সরকারের ক্ষমতা ছাড়ার কোন সুযোগ বা আশংকা নাই। কিন্তু জাতীয় নির্বাচন বা ৩০০ আসনের সংসদ নির্বাচন সরকার ও বিরোধী দলের কাছে সবচেয়ে বেশী গৃরুত্বপূর্ন। কারণ এ নির্বাচনে সরকার বা ক্ষমতার পরিবর্তন হয়, দেশ চালানোর জন্য সরকার পরিবর্তন হয়, ক্ষমতার মসনদ দখল করার সুযোগ হয়। এ কারণে জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার ও কারচুপি করার সম্ভাবনা বা আশংকাও বেশী থাকে। একসাথে একই দিনে সারাদেশে একই সময়ে ৩০০ আসনে নির্বাচন হয় বলে প্রতিটা আসনে, প্রতিটা ভোট কেন্দ্রে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা যেমন কঠিন, তেমনি দেশের সব কয়টা টিভি চ্যানেল, পত্রিকা সাংবাদিক ও নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের পক্ষেও একই দিনে ব কয়টা আসনের খবর সংগ্রহ ও নজরদারী বা তদারকি করা সম্ভব নয় ( পর্যাপ্ত লোকবলের ও সাজ-সরঞ্জামের অভাবে )। ক্ষুদ্র পরিসরে স্বল্প সংখ্যক আসনে কেবল সেটা সম্ভব।
আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে পারষ্পরিক অবিশ্বাস ও অনাস্থার জন্ম নিয়েছে, অগনতান্ত্রিক সংস্কৃতি চর্চার যে প্রসার ঘটেছে, দলীয়করন ও দূর্বৃত্তায়নের যে ন্যাক্কারজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, ছলে বলে কৌশলে ( পুনরায় ) ক্ষমতায় যাওয়ার যে মানষিকতার জন্ম হয়েছে এ অবস্থার মধ্যে একটা দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন কি বিরোধী দল মেনে নিবে ? বি,এন,পি সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনও তাই আওয়ামী লীগ প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং আন্দোলন করে তখন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা কয়েম করেছিল। এমনকি ২০০৭ এর ২২ জানুয়ারী’র নির্বাচনের সময় বি,এন,পি ক্ষমতায় ছিলনা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা যার ( বিচারপতি কে,এম,হাসান ) হওয়ার কথা ছিল তার কোন এক কালে বি,এন,পি’র সাথে সংশ্লিষ্টতার কথিত অভিযোগে তাকে প্র্রধান উপদেষ্টা মেনে নিবেনা বলে আওয়ামী জোট ব্যাপক হিংসাত্মক আন্দোলন শুরু করেছিল, এরপর ইয়াজ উদ্দীন ( বিতর্কিত পন্থায় ) প্রধান উপদেষ্টা হওয়ায় বি,এন,পি’র লোক বলে আওয়ামী জোট তাকেও না মেনে সারা দেশে স্মরনকালের ভয়াবহ সহিংস আন্দোলন শুরু করেছিল, যার ফলশ্র“তিতে ১/১১ তে জে : মইন রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দীনকে দিয়ে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বে একটা কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কায়েম করে ২ বছর ক্ষমতায় ছিল। আর এখন ২০১৪ সালের নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়কের পরিবর্তে শেখ হাসিনাকে সরকার প্রধান রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী জোটের একটা নিরংকুশ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সে নির্বাচনে বিরোধী দল অংশগ্রহন করবে বা নির্বাচনকে মেনে নিবে এটা প্রত্যাশা করা কি অস্বাভাবিক ও দিবাস্বপ্ন নয় ? 
আমাদের দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে এবং নজীরবিহীন গনতান্ত্রিক পরিবেশে সবার অংশগ্রহনের ভিত্তিতে একটা সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহনযোগ্য নির্বাচন করার জন্য একটা নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার বিকল্প এখনো চিন্তা করার সময় আসেনি ( যতক্ষন পর্যন্ত আমরা বিশেষ করে রাজনীতিবিদরা মন-মানষিকতায়, চিন্তা-চেতনায় এবং আচার-আচরনে অন্যান্য উন্নত গনতান্ত্রিক দেশের জনগনের সমতুল্য হতে না পারব )।
তাই, মাথা ব্যথা হলে যেমন মাথা কেটে ফেলে দেওয়া কোন স্থায়ী চিকিৎসা নয় তেমনি ( কেবল ক্ষমতাসীন দলের বিবেচনায় ) তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা খারাপ ( ? ) বলে আদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে তাকে সমূলে উৎখাত করে দেওয়াও উত্তম কাজ নয় ( যার প্রমান এখন দেশে বিরাজমান )। বরং ২০০৭ এর নির্বাচনের আগে এ ব্যবস্থায় যেসব অনিয়ম ও ত্র“টি বা ফাঁক-ফোঁকর ছিল সবাই মিলে এখন আলোচনার মাধ্যমে তাকে সংশোধন ও সময়োপযোগি করাটাই ছিল  উত্তম ও প্রত্যাশিত কাজ। তাই আগামী সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দেশের চলমান সংকটকে কার্যকরভাবে সমাধান করতে হলে আলোচনা বা সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার ব্যাপারে একটা সমঝোতা বা ঐক্যমতে পৌছানো ছাড়া আর কোন পথ খোলা আছে বলে মনে হয়না। একগুয়েমী বা একতরফা সিদ্ধান্ত কখনও সবার তথা দেশের জন্য সুফল বয়ে আনবেনা। বিশেষ করে ৪ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফলের প্রেক্ষিতে বিরোধী দলের অবস্থান ও বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে সরকারকে একগুয়েমী বা স্বার্থান্বেষী মহলের কুপরামর্শকে পরিহার করতে হবে। সরকারের অন্ধ দাম্ভিকতা, উগ্রতা ও বাস্তবতাকে উপলব্ধি করার ব্যর্থতাই সিটি করপোরেশনে তাদের ভরাডুবির অন্যতম প্রধান কারণ।
লেখক :  জাহিদ হাসান
রিয়াদ, সউদী আরব।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন