আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ-এর গল্প : পরমের খোঁজ

একদিন এমন হয় যে একটি অচেনা অদেখা প্রায় ভুলে যাওয়া বিশ্বাসের পা ধরে ঝুলে থাকা জোঁকের মতো অপেক্ষা তার আর সহ্য হয় না। সে তাকে দেখতে চায় কথা বলতে চায় মুখোমুখি বা এইসব কিছু না হোক সে যে লিখিত কিছু না বা লিখিত হলেও সে যে কারো অপক্ষায় থাকে না
এবং সে যে আনন্দ নিরানন্দ যাই হোক যা কিছু আছে চারদিকের স্বতঃস্ফূর্ত সরল বা জটিল সৃষ্টিজাতের মধ্যেই সে বিলীন -সে যে অপর অন্য হলেও কোনোভাবেই আলাদা নয় বিভক্ত নয় এটি সে বুঝতে চায়। কয়েকদিন ধরে মন শুধু পাখির মতো উড়াল দিয়ে আকাশে বাতাসে আবার নীচে কূলহীন একদম একটা সমুদ্রের মাঝখানে ঘর বানাতে চায়। এই যে বনবাতাস এই যে টিয়া পাখির লাল এই যে পানির ভেতর মাছের পরিবার সন্তান উৎপাদন পানির কিনার ধরে নগ্ন নিশাচর চলাফেরা এ-গুলো তার বুঝতে ইচ্ছে করে দেখতে ইচ্ছে করে। এই যে লেবুপাতার সবুজ জামার সবুজ স্কুলের কাছে শিশুদের পলায়ন কোলাহল এইসব দেখতে ইচ্ছে করে। একদিন এমন হয় যে মৌন মাংসস্তর যা আবার এই মানসআধারে একটি রূপচৈতন্যের টিলা হয়ে বসে সে এটিকে ভাঙ্গার জন্য অস্থির হয়ে পড়ে। সে একটি পথ খুঁজে বেড়ায় আর মনে মনে ভাবে তার খোঁজ সে শেষ পর্যন্ত পাবে তাতে যদি সে নিখোঁজও হয় হবে হোক। সে আরো কাছে আসতে চায় আরো ভাষা বিনিময় করতে চায় এমন ভাষা যে খুব ব্যক্তিগত একদিন ছোটবেলার স্কুলঘরের ফুটবল চুরি থেকে উঠতি যৌবনকালে রাস্তাহীন কোন এক অচেনা বান্ধবীর টাটকা আপেল যুগোলে হঠাৎ হাত দেয়ার বিষয়টিকেও সে মাথায় রাখে। এমনভাবে বলতে চায় যেন সে অনেকদিন ধরে তাকে চেনে জানে মনে রাখে। সে স্থির করে যে বুক খুলে সবকিছু দেখাবে সবকিছু দরোজা জানালা দোকানপাট মিষ্টির দোকান রিক্সার পিছনে আলাল দুলাল হরিণ বান্দর রাস্তাঘাট দর্জির কাপড় ড্রেনের পাশে মুরগি জবাই ছেলেদের ফুটবল বিয়ে বাড়ি শাড়িজামা পড়ে সবার আসা যাওয়া পর্দায় কাজল শাহরুখ দিলওয়ালা দুলহানিয়া সবকিছু আর এক জায়গায় রিক্সা সিএনজি বেবিগাড়ির পর্দায় যে লেখা থাকে মায়ের দোয়া এইসব সে দেখাতে চায় বলতে চায়। আর বলতে চায় তার অতো দ্রুত চালে বহে চলা সময় ধরে ধরে কায়দাকানুন শর্তটর্ত ভালো লাগে না তার হাজার হাজার কাহিনী চলে না রাত জেগে জেগে ছোট পাথরবিন্দু স্পর্শ করে করে কথা শুনতে ইচ্ছে করে না পা ধুতে ইচ্ছে করে না। মধ্যরাতে যাদুবস্ততার অসীমসংঘে কাপড় চোপড়ে জন্মকাজের বীজ লাগলেও সে এসবের কেয়ার করে না যথারীতি আহার করে ঘুমায়। সে তার সদা উপস্থিতির ভেতর এই সরলসোজা রাস্তা ধরে বাঁশবাগানের চাঁদ পুকুরপাড়ের নাচ গোলাপের মৃত্যু দোকানের বাতি ঘাটের ভিড় মেয়েদের গোল এসব দেখতে দেখতে ট্রেনে উঠে যেতে চায় যেদিকে মন চায় সেদিকে পা রাখতে চায় কোনো আটকে রাখা না একদম না। তার কাছে বলতে চায় একদিন সন্ধ্যাকালে হাটভরা মানুষ, মানুষের বহুস্তর রেখা গতি গুড়ের পাতিল- পাতিলে পিঁপড়ার চলন রেডিওতে গান আছেন আমার মোখতার একটা ভুরিওয়ালা লোক একটা কুকুর এ-সব তার কাছে বলতে চায়। সে বলতে চায় যে খালি রাস্তাঘাট আর ইটবালি লোহালক্করের দোকানপাট দেখা যায় আর পেট ভরে ভাত খাওয়ার মতো যে কল নড়ে সংসারের ভেতর অনিঃশেষ সেটি দিনে দিনে ছোট হয় । 

একদিন আর একটি লোকালয়ে শাদা ধবধবে দালানের নিচে ঘুম নিদ্রা জাগরণ প্রণয় কাতরতা প্রণয় শাপলার সাথে যে এত কোমল লীলাময়ী বারবার লুকিয়ে যায় পানির নিচে ডানে যায় বামে যায় খালি চুল খুলে রাখে মাতাল সে রূপে মাতাল অন্ধ সে ধরতে পারে না। হলুদ রঙের জামা পড়া স্কুলছাত্রী বা ফুল খালি পানির ভেতর লুকিয়ে যায়। আর অন্যদিন তার বড়লোক বাবা তাকে বিয়ে দিয়ে দেয় অথবা হয়ত শাপলা তার শাপ হয়ে নিজেই বাবু নামের এক লম্বা চুলওয়ালা দোকানদারের হাত ধরে কোথাও চলে যাবার মনোস্থির করে। এইসব চলতে থাকার পর বা হওয়ার পর হাঁটতে হাঁটতে স্বপ্নে পাওয়া পাঁচড়ার মলম লোকটা হঠাৎ জামা ধরে ডাকে এই ভাইকে একটা মলম দিতে হইব কারণ উনার অভাবের সময়ে দুই উরুর কোনায় ঘামে বা খাদ্যের অভাবে লাল লাল গোটার মতো পাঁচড়া হইছিল যা আবার নিউমার্কেটের বলাকা সিনেমা হলের সামনে বিক্রি হয়। যেখানে চৌধুরী এণ্ড সন্স বুকস্টল জন মিল্টন জন কীটস কাফকা কামু এইসব বিদেশি কবি সাহিত্যিক কোলস নোটস মুড়িভাজা বেশি পয়সা হলে কাবাব আর রুটি এইসব তাকে দেখাবে গল্প করে। তাকে জানানোর বিষয়টিতে যে আনন্দ সেটি অনেক বুকের ভেতর থেকে আসে সে বুঝতে পারে। সব সময় সব বয়সে সে জানুক কাছে এসে দেখুক এইসব প্রকাশ্য লুকোনো বায়স্কোপের খেলা মজা। সব কিছু কি আশ্চর্য্য ঘুরে ঘুরে আসে কিন্তু যে মানুষ যে আবার ভাই যে ভাইয়ের মতো চলে কাছে থাকে এক বাড়ির ছাদের নিচে যার বাস সেখানে একটি রেল লাইন যোজন যোজন দূরত্ব। আর মানুষজন গায়ের রঙ একদম এক ভাষাও এক তারা এইখানে দূরে রাখে শুধু পর করে দেয় শত শত শর্ত দিয়ে তাকে ধরতে বলে বলে কদমবুসি করো হাত ধুয়ে আসো লেখালেখি করবা না শুধু এইদিকে চোখ রাইখা ঠোঁট নাড় মিয়া। 

তারপরও অনেকদিন পর একদিন শীতের সকালে মুখ বন্ধ করে বউবাচ্চা ছেলেমেয়েদের রূপরঙ তামাসা গোসল করা কাপড় পরা দেখতে দেখতে ভোরে ট্রাকটরের গতিতে সকাল দুপুর রাত্রি বাগানের দোলাচল গোলাপের রঙ বাসে চড়ার ইতিহাস পানি সংগ্রহের লাইন ১৯৫২ সন আবুল বরকত ১৯৭১ সন রিক্সার মধ্যে বাঙালির সারিবদ্ধ লাশ মীরপুরের বধ্যভূমিতে খালি লুঙ্গি সার্ট বা গামছা পড়া নিহত বুদ্ধিজীবী শহীদ মিনার অপরাজেয় বাংলা মিছিলের মুখ বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট সাকিব আল হাসানের মুখ সবুজ ড্রেস বাংলাদেশের পতাকা যা লাল সবুজ মনোহর এ-সব ভাবতে ভাবতে সে তার নামে যে ঘর সকলে মিলে বানায় পয়সা না দিলেও দিতে হবে মাসে একবার তার ঘরে হাজির হয়। এতদিন না হয় চুপ করেই ছিল সে এমন করে ছিল যে তার কোনো কথাই কেউ বুঝবে না আমলে নেবে না এমন ভাব। ছোট মেয়েটার সাথে হাত ধরাধরি করে হেঁটে হেঁটে সে একরকম চুপ করেই ছিল আর বলত মা মনি তুমি যে আকাশটাকে দেখ এইটা অনেক বড় চারিদেকে ছড়াইয়া আছে দেখ কি রকম নীল তুমি এই বাগানটায় থাকো এইখানে সুন্দর ফুল ফোটে। এখানে কোনো নিয়মকানুন নাই কোনো প্রশ্ন নাই চোখ ভইরা শুধু দেখতে থাকো। আবার কোনো কিছু জানা না থাকলে মন খারাপের কিছুই নাই তার এতে কোনো কিছু আসে যায় না। এই যে গাছ তার পাতা কি সবুজ! কেন সবুজ কেন লাল নয় যে চোখ জুড়িয়ে দেয় সেতো প্রকাশেই খুশি আর আমরা দেখ কেমন লটকে আছি পানির মতো পড়ে যাই না কারণ সে চায় আমরা লটকেই থাকি পড়ে গেলে তো আমরা হারিয়ে যাব কোনদিকে। সে আমাদেরকে দেখতে পাবে না। তখন ডান দিক থেকে পুরনোকালের বাতাস আসে তাকে ঝাপটিয়ে চলে যায় বাম দিকে একদম গোল সাপের মতো রাস্তার পাশ দিয়ে। সঙ্গমরত ঘুঘু ডাকে পাতার ভিড়ে আকাশ নীলনীল আর মেঘেঢাকা কোথাও যে কি আছে সব কিছু দূরে নীল আসমানে এই নীল গ্যাসের মতো। সে হঠাৎ মনে করে গাজীপুরে বাস স্ট্যাণ্ডের কাছে গজে ওঠা নতুন বাজারে এসে বড় একটা রুইমাছ ভাইয়ের বাসায় ভাবীর রান্না করা জলপাই বাতাসি মাছের ঝোল এইসব দেখে সে চুপ করেই ছিল আর মনে মনে তার প্রতি শ্রদ্ধা দেখাত মায়ের জন্য ফুটপাত থেকে একটি লাল সুয়েটার কিনে দিত। কিন্তু আজ আর তার চুপ থাকা কাজে লাগে নি একটা দেখার ইচ্ছা কথা বলার ইচ্ছা কেমন পাথরের ভার নিয়ে শরীরের উপর দাঁড়িয়ে আছে এমন যে আর কত সে সহ্য করবে। আজ তাকে দেখতেই হবে কেন যে এত কাজে কর্মে নিজেকে বিলিয়ে দেয় আর সবার জন্য সময় বানায় অপেক্ষা বানায় আর সেখানে উপস্থিত হয়ে হ্যাঁ বলা না বলা এমন যাতনা। কেন বাচ্চাদের মতো করে একই সাথে বাঘ আর হরিণ হাঁটা দেখবে কেন রক্তপাতের ভেতর শাদা পতাকার রঙ দেখবে আর সে হ্যাঁ বলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে। আবার দেখবে সব জায়গাতে থেকে সে কার চুল ধরে টান দিল কাকে ভাবল কতটুকু ঘুম আসে কিভাবে রোদে চুল ছাড়িয়ে বসে থাকে মেয়েরা গান গায়। এইসব আসলেই কি কে বানায় নাকি অন্য কেউ বানায় বাতাসে ছড়ায় যেখানে মানুষ একদিন দাঁড়িয়ে থাকে আর উত্তর পায় না কোনো কিছুর মন একদম ভ্যাবাচেকা ভয়ে অস্থির। 

তো একদিন সত্যি সত্যিই বাস থেকে নেমে সে পরিবারসহ একটি স্কুলঘরের মতো বাড়ির ভেতরে দুম করে পা রাখে। কেমন যেন ঘরটা মনে হল সব কিছু পড়ে যাবে ইট পাথর বালি বই জামাকাপড় আসবাবপত্র ফটো বালিশ বিছানা টিভি ফ্রিজ এমন কি এই পাখির বাসাটাও পড়ে যাবে শরীরের কাছে আসবে ধেয়ে তাতে পাখিটা মরে যাবে। আলো তো আছেই কিন্তু আলোপতনের যে শেষ সীমানা সেটিও হয়ত ঢেকে যাবে কারো ছায়ায় শেষ হয়ে যাবে আর জেগে উঠবে এমন একটি অন্ধকারপর্ব যেখান থেকে শুরু হবে আবার লক্ষ বছর। একটি মোমবাতিই এখন আলোকেন্দ্র বাতাসে কাঁপা কাঁপা। শুধু মোমবাতির শেষ শিখাটি অন্ধকারে ছড়িয়ে পড়ছে আর ধীরে ধীরে মানুষের মুখগুলো চক্র চরকি পাখি শেয়াল হরিণ মুরুগি বনমোরগ রাজা বাদশা বদমাশের ঠিকানা গান যন্ত্র কম্পিউটার এইসব হয়ে একটি বিন্দুতে মিলিয়ে গেল বা মোমবাতি হয়ে গেল। তার জোড়কদমে যে হাঁটার ভঙ্গি ছিল সেটি শেষ করে এইমাত্র সবার কাছ থেকে শেখা কদমবুসির স্টাইল ধরে শরীর বাঁকা করে মাটির কাছাকাছি মুখ নেওয়ার ধাক্কা সেটা তার অচেনা লাগে। সে শিখেছিল যে পাঠবিহার আনন্দপাঠকাজ আজ অনেকদিন হল তারপর কার্লমাকর্স ডাস ক্যাপিটাল বিদ্যাসাগর মাইকেল জেমস জয়েস রবীন্দ্রনাথ চে গুয়েভারা লোরকা ফকনার আখতারুজ্জামান ইলিয়াস চিলে কোঠার সেপাই জীবনানন্দ বোদলেয়ার শয়তানের সঙ্গী আফিমতাড়িত সাগরে সাগরহীন ডুবন্ত বালককবি রেঁবো সবকিছুই এই মোমবাতির ঘরে বৃষ্টিপতনের বুর বুর পানি পড়া গোয়ালঘরে গরু জন্মানোর মতো তার পায়ের তলায় এসে থেমে নিভে গেল। যে পড়ে সে জাগে আবার পড়ে জাগে খেলা এমন খেলাসময় তার কাছে আসে আর যায়। একসময় একটি ঘূর্ণনের মধ্যে সে পড়ে আবার ভাসতে থাকে বা যেখান থেকে পথচলা শুরু সে দিকেই আবার মন যায় মৃত্যুর প্রতি ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও সে ভাবে কি মহান উপস্থিতি কি ঝামেলাহীন সেদিকে পা রাখা। আলো যে কিভাবে আসে সে ভাবে। ঘুমিয়ে থাকলে তার চলে আসা তার চিরআগমন সত্য। সে ভাবে সে আছে এই জেনে যে সে তাকে ভালোবাসে এই না আসা আলোতেও অন্ধকারেও। তা বোঝা যায় কারণ জেগে থাকলে বাচ্চাদের ভেতর সে আলো হয়ে একটি আনন্দ হয়ে সাত সকালে ব্যায়াম করা ছেলেমেয়েদের মাঠে চিরকুমার এমন স্বর অনুভব যে সময় আর সময় থাকে না। ঠিক বোঝা যায় তার উপস্থিতি দেখা যায় না ধরা যায় না লাল বা সবুজের মতো কাছের আবার কাছের না রক্তের মতো- যন্ত্রণা যা আবার ভালো লাগে সবার অগোচরে বা সামনে।

একদিন এমনই হয় যে বন্ধু হারিয়ে যায় অনেক দূরে চলে যায় সেই আসে হাত পা নাড়তে নাড়তে মুখে হাসি ধরে আসতে থাকে কথা বলতে বলতে আসে। বন্ধুর হাত লম্বা মিটিং মিছিল থেকে বের করে গরুখোঁজা করে তারপর এই লম্বা স্কুলঘরের খবর। আসো বন্ধু অনেক তো হইছে এইবার মোমের আলোর দিকে আসো দুনিয়া কানামাছি ভোঁ ভোঁ হারাইয়া যায় নিজেরে দৌড়াইয়া খুঁজি। দুই চার দিন মাত্র তারপর কি করবা মিয়া চান্দে গিয়া থাকবা অইখানে কি এই মোমের আলো পাইবা তাও পাইবা যদি মনে কামনা করো অবশ্য। এইখানে যে জিনিস কেনোদিন পাইবানা তাই পাইবা আমার কথা শোনো। কথা শেষ হলে কথা শুনে সে ঠাণ্ডা তরমুজের বড় ভাগটা বন্ধুর মুখে ঢুকিয়ে দেয়। ডিম দেয় ভাত দেয় বউকে কিন্তু দেয় না ছেলেমেয়েদেরকে দেয় না এইসব বন্ধু ভালো পায় আনন্দে গ্রহণ করে। খুব পাকা পথওয়ালা লোক জানবাজি ধরছে শুধু মাঝে মাঝে হাত বাড়িয়ে কাজের ইশারা দেয় বলে ফ্যানটা ছাড়ো একটু ঠাণ্ডা পানি আনো। খোকাটাও জিজ্ঞেস করে বাথরুমটা কোথায় তোয়ালা কোথায় আমার জুতাটা ঘরের ভেতরে আন না হইলে চোরে নিয়া যাইবো বিশ্বাস করো যেমন চোরের হিংসা বাড়ছে এই এলাকায়। অনেকক্ষণ এ-ভাবে কাটে। কিন্তু বন্ধু নিজে তেমন একটা কাজ করে না শুধু ভাবীসাহেবা একটা স্কুলে ছাত্রছাত্রী পড়ায় মাঝে মাঝে বন্ধু ঘরে কিছু বাচ্চাদের গল্প কাহিনী শোনায় কিন্তু অবসর পেলেই বন্ধুবান্ধব নিয়ে বহু দিনরাত পার করে দেয় শুধু কথা বলে বলে আর অনেক সময় মহিষের মতো করে ঘুমায়। যেদিন ঘুমায় সেদিন বন্ধুকে আর পাওয়া যায় না দেখাও যায় না আবার এমনকি বিছানায়ও পাওয়া যায় না। বউ বাচ্চা আসে ডাকে মোবাইলে ডাকে কিন্ত কোনো সারা শব্দ পাওয়া যায় না। কোথায় যায় এই বন্ধু যে একটা সূত্রসন্ধানে তাকে পথ দেখায় তাকে একভাবে একটা অন্যপথে তাড়িয়ে নিয়ে আসার জন্য যে ভাষা বিনিময় করে সেটি কাজে লাগে মানে সে সব মানুষের তৈরি পথে পা রাখার জন্য কাজ থেকে দুই একদিনের জন্য অব্যাহতি নেয় ভালো একটা সাবানে গোসল করে সুন্দর পরিপাটি থাকে।

এই স্কুলঘরের দিকে যেখানে লাইট বাল্ব কিছুই নাই সেদিকে মুখ খোলা করে বসে থাকা মাথায় যদিও ঘুরে ঘুরে সব কিছু আসতে থাকে একটি আগে যে সব কথা বলেছিলাম। পা ব্যথা করে শরীর ঝিম মারে তবু অপেক্ষা করে থাকতে হয়। সবাই সোজাসুজি সামনা সামনি বসে থাকে কিন্তু এমনভাবে বসে থাকে যে কারো মুখ কেউ দেখে না আবার দেখে শুধু নিঃশব্দের তরল ভেসে থাকা ভাষাটা যেটি অচেনা অদেখা শরীরী ভাষার চেয়ে গূঢ় মানসচোখে। বন্ধুও এক সময় আসে ছোট ছোট পা ফেলে একেবারে শব্দহীন। মেয়েছেলেরা ছোট বাচ্চা আত্মীয়স্বজন সব অন্য ঘরে সবার জন্য একটা বেশ আলাদা ব্যবস্থা আছে যত্ন করে ভিন্নভাবে। শুরু করেন -একজন বলে কিন্তু আসলে শুরু হয় না আর একজনের অপেক্ষায় থাকে। সেও এক সময় আসে। রাস্তায় দেরি হইয়া গেছে ভেরি সরি মাফ কইরা দেন। রাস্তাঘাটে অনেক জ্যাম মানুষ আর মানুষ কোনো কিছু আর কাজ করে না। গাড়ি গাড়ি ধুঁয়া উল্টা পাল্টা নিয়মকানুন ফকির মিসকিনের ভিড়। একসময় কথা শেষ হয়। তার চোখে মুখে কেমন একটা অবহেলার ভাবভঙ্গি। এতগুলো মানুষ যে বসে আছে কোনো খেয়াল নেই। মোটাসোটা সুখী চেহারার লোকাটার মৃদু হাসি আকাশ পর্যন্ত লম্বা। এক সময় নত ভঙ্গিতে বসে হাত মিলায় সবার সাথে আমি জয়নাল তারপর চলতে থাকে আমি নজরুল আমি হামিদ আমি আশফাক... মোমবাতি শেষ হয়ে গেল আর একটা জ্বালানোর কায়দা করে ছোট বাচ্চাটা। এক সময় বন্ধু শুরু করে এক এক করে পাঠ করে। সুর করে নয় ধীরে ধীরে শুদ্ধ করে উপস্থিত সবাই শোনে আবার পাঠ করে শোনে আর পাঠ করে পাখি কবুতরের মতো। কিন্তু একজনও এইসবের ব্যাখ্যা করে না। যদিও একটা উদ্দেশ্য পাওয়া যায় অর্থ পাওয়া যায় কিন্তু তার কোনো ব্যবহার প্রয়োজনীয়তা তখন পাওয়া যায় না বর্তমান পাওয়া যায় না। শুধু নীরবে শ্রবণে আর বহনে কি আনন্দ আজব। হঠাৎ সবার মুখের দিকে তাকালে গ্রামের সেই কলা গাছের ভেলা মাঠে গরু বলদ বাড়ির পাশে ছাতিম গাছ শর্ষেতে উড়ে যাওয়া ঘুড়ি তার অনেক আশা রঙ মেয়েদের গান উঠোনে এইসব মনে আসে। এমন কি কিভাবে মাটি কেনা বাজার থেকে কত দামের চাউল ডাল সবজি সোয়াবিন তেল বিদেশি মুরগির বাচ্চা ঢেউটিন পাখির খাবার এইসব খালি মনে আসে। আবার একসময় কথা বলার ফাঁকে এখানে উপস্থিত নতুন এক ভাই হঠাৎ ইণ্ডিয়া থেকে বউ নিয়া আসে। তার চোখে কালো কালিতে আঁকা মুখ ভরা রঙের ঝনঝন আরো কত কি তাই কথা বেশি বলে অনেক নিয়মকানুনের কথা বলে বলে মাফ নাই সব কিছু দড়িতে বান্দা ছোটার কোনো উপায় নাই। সে কারো খোঁজে আসে না সে বলে তার খোঁজ শেষ এখন শুধু উপস্থিত থাকার কথা পাখি সাজা পালন করা খুব সরল হিসাব। আবার একসময় বন্ধুও শুরু করে এমনভাবে শুরু করে যে উপস্থিত মানুষগুলোর মনে আশা থেকেও কোনো আশা জাগে না। 

দিনরাত্রি রাতদিন এইরকমই এত পথ অতিক্রম করে আজকে মন বদলের দিনে সেই মৌনকাল শেষ করে যে তার খোঁজে আসে। সে দেখে ওরা তাকে কেটে ছোট করে ফেলেছে ইচ্ছেমতো কেটে ফেলেছে অসংখ্য ভাগে তারপর বলছে এটা তোমার এটা আমার আমার তোমার আর সবাই সবার কথামত তাকে খুশি করার জন্য অস্থির শীতে গ্রীষ্মে খরায় বন্যায় শব্দে নৈঃশব্দে আহার অনাহারে হাজির দেয়ার জন্য অস্থির হয়ে আছে প্রশ্ন কমানোর জন্য অপেক্ষায় আছে। আর সবাই বলছে কোনো ব্যক্তিগত নাই এখানে সবকিছু সামাজিক সব কিছু তার আবার সবার আর যেহেতু তাদের এই সে - সব কিছু চায় মানুষের মতো আদর যত্ন হাত পা নিয়মকানুন বসে থাকা চলে না এইখানে। সময় অসময় দৌড়ে আসো হাজিরা দাও আদর করো যেন ভুলে না যাও। সে ভাবে আসলে সে কী চায় কেন চায়? আসলেই কি সে কোনো কিছু চায়? পোশাকের আয়োজন যথারীতি উপস্থিতি সামাজিক মিলনস্থল দেখাদেখি কাছে থাকা কাছে ডাকা পয়সা দেয়া পয়সা নেয়া। একসময় ভিড়ের মধ্যে সে ভাবে- কিছুই চায় না সে, কাল দাগ লাল দাগ ধুলো মাটি মানুষের মেয়ে মানুষের আদর তার থেকে গলে যাওয়া সৃষ্টিফোঁটা লাগলো কি লাগল না তার কোনো যায় আসে না। সে উপস্থিত এই যে মোমবাতির আলো এই যে মন আলোর পিছনে অনেকদিন আগ থেকে জ্বলছে পাথর পড়ছে কোথাও সবখানে সে। তাহলে সে কি এগুলো চায় এই যে সবাই একা একা বসে আছে ভাবছে সবাই সবার কাছের সবার নাম জানা ঠিকানা জানা- তার থেকে আলাদা হয়ে বন্ধুর কাছে জমায়েত মানুষের সাথে আলাপ আলোচনা করে খেয়ে দেয়ে লম্বা ঘুম আর সকালে উঠে আর এক বাড়ি গিয়ে তার আদর তার খবর আহার পরিবেশন সেকি আসলে এইগুলো চায়। নাকি চায় না। সবার সাথে বসে থাকা একসময় সে খুব একা হয়ে যায় আর বারবার মোমবাতির শেষ আলোবিন্দুর দিকে তাকিয়ে থাকে। একসময় কিন্তু বন্ধুর মুখ কেমন কঠিন হয়ে আসে। সব কিছু খুলে বলে এমন করে বলে যে পাহাড় গলে গলে পড়ে সবার শরীরে বউ বাচ্চাকাচ্চা সবাই আতঙ্কে মাটির নিচে মুখ লুকায়। তাকে বলে চলো আমরা পালিয়ে যাই আর সহ্য করতে পারছি না। বন্ধু বলে যায় কোনো মাফ টাপ নাই ভায়েরা বোনেরা সময় থাকতে আপনারা সামিল হইয়া যান আসেন যলদি আসেন এইখানে চোখ রাখেন আমার হাত ধরেন কোনো প্রশ্ন এখন করবে না একদম চুপ। 

এসব কথা শুনতে শুনতে সে দেখে তাকে কেউ পেছন থেকে বেঁধে ফেলেছে নাকি সে নিজেই নিজেকে ধরে রাখে পিছন থেকে। হয়ত তাই সে তো জানে এখানে উপস্থিত হামিদ আশফাকের মুখের মতো বিষয়টা খুব সরল আবার সহজ না। সে চিন্তা করে দেখে সে এতদিন যে চুপ ছিল তার একটা বেরাম হয়ে গেছে মানে কোনো কথা না বলা বা সবাইকে খুশি করা সে নিজে যা বোঝে অনেক আগেই সেই মেঘ থেকে পানি পড়া বা সাদা বকটার উড়াল দেয়ার সময় যে একটা মায়ার ঝিলিক হয়েছিল সেবার তার সবকিছুকে ফেলে আসার কথা ঐ বাড়িতে দুম করে পা রাখার কথা না। যার অবস্থান এই যে পিঁপড়া এইযে কচু পাতা মৃত বেড়াল রাস্তার মধ্যে সবখানে এই যে বাচ্চা হয় গর্ভে এই যে পুকুরে মাছ সাঁতারকাটা মাছ সব কিছুর মধ্যে সে থাকে এই মোমাবাতির ঘরে প্রাচীনকালের গুহার ভেতর বাতি ছাড়া অন্ধকারে শুধু অনুভব করে বোঝা যায় তেমন একটি অনুভব সে নিতে পারে তারপর তার সব কিছুর উপস্থিতি টের পাওয়া যায় তাকে বলা যায় বল চুরির কাহিনী মেয়েদের গোপন অংশের দিকে তাকিয়ে অথবা হাত দিয়ে দেখে এমন কিছু স্বপ্ন বা বাস্তবতার ভেতর তার অবশেষে নেমে আসা পাখির মতো উড়াল। একটা শর্তহীন থাকা না থাকার মতো অবস্থা হয়ে আস্তে আস্তে নিয়মকানুন পরিত্যাগের সৎসাহস সে একদিন পায় তখন সে দেখে এই ভিড় ছাড়িয়ে আকাশ বাতাস মহা গ্যালাক্সির সীমানা ছাড়িয়ে দলে দলে এক ভালোবাসা মায়ার অনুভব তার মাংসমণ্ডলী ভেদ করে আপেলের মতো এই লাল হৃদপিণ্ডে ঢুকে এক বাসা তৈরি করে রেখেছে আর সেই বাসায় ছোট বেলার সেই হারিয়ে যাওয়া বল, মরা পাখিটার চোখ রোদে শুকানো মায়ের শাদা কাপড় উড়ছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন