কান্না থামেনি ইলিয়াসের মায়ের আর্থিক অনটন আনসার আলীর পরিবারে

ডেস্ক রিপোর্ট
অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে চলে গেল ১৪টি মাস। দীর্ঘ ১৪মাসেও সন্ধান মিলেনি নিখোঁজ এম. ইলিয়াস আলী ও তার গাড়ী চালক আনসার আলী‘র। তারা কেমন আছেন, কোথায় আছেন আজও জীবিত আছেন না মৃত তা এখনো অজানা রয়ে গেছে। তাদের উদ্ধারে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তত্পরতা একেবারেই বন্ধ। তবুও আশায় বুক বেঁধে রয়েছেন তাদের গর্ভধারিনী মমতাময়ী মা-স্ত্রী, সন্তানসহ পরিবারের সদস্যরা। এই দুই জননীর অগাত বিশ্বাস একদিন ফিরে আসবেন তাদের আদরের নাড়ি ছেড়া ধন। একই ভাবে ফিরে আসার প্রতিক্ষার প্রহর গুনছেন ইলিয়াস-আনসারের জন্মস্থান বিশ্বনাথসহ সিলেটের হাজার হাজার নেতাকর্মী, ভক্ত ও শুভানুধ্যায়ীরা। ইলিয়াস ফিরবেন না এ কথা মানতে নারাজ তারা সবাই। কারন তিনি ছিলেন সিলেট-২ আসনের উন্নয়নের রুপকার।
সিলেট বিএনপি সুসংঘটিত হয়েছিল ইলিয়াস আলীর হাত ধরেই। নিখোঁজের পূর্ব পর্যন্ত ইলিয়াসের রাজনৈতিক অবস্থান ছিল সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রিয় নির্বাহী কমিটির সাগঠনিক সম্পাদক। দায়িত্ব পাওয়ার পর অল্প দিনেই তিনি সিলেটের কোটি মানুষের হূদয়ে স্থান করে নেন। ইলিয়াস আলীর সমালোচক থাকলেও নিখোঁজ হওয়ার পর সিলেটের এক কোটি মানুষ তাঁর জন্য কাঁদছে দলমত নির্বিশেষে। সকলেই একমত রাজনৈতিক মত-পার্থক্য থাকতে পারে কিন্তু এ সময়ের সিলেটের দাবী আদায়ের একমাত্র বলিষ্ঠ কণ্ঠ নিঃসন্দেহে ছিলেন ইলিয়াস আলী। এ কথা তাঁর প্রতিপক্ষরাও স্বীকার করেন। একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও ব্যক্তিগত গাড়ী চালক নিখোঁজ হওয়ার পর সরকার সন্ধান দিতে ব্যর্থ হওয়ায় আগামী সংসদ নির্বাচনে এ সরকারকে চরম মাশুল দিতে হবে বলে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে শুনা যাচ্ছে। অপরাধ করলে শাস্তি হবে কিন্তু গুম হবে এটা কারো কাম্য নয়।
মানষিক ভাবে ভেঙে পড়েছেন ইলিয়াস জননী ঃ মানষিক ভাবে একেবারেই ভেঙে পড়েছেন সত্তরোর্ধ ইলিয়াস জননী সুর্যবান বিবি। রোগে শোকে কাতর এই জননী ছেলে ফেরার প্রতিক্ষায় বসে আছেন। ছেলের জন্য কেঁদে কেঁদে তার চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। এখন তিনি বাকরুদ্ধ। তার মুখের ভাষাও পষ্ট নয়। নিয়মিত খাওয়া দাওয়া করছেন না তিনি। তারপরও নামাজ-কালাম, দোয়া-দুরুদ পড়ে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করছেন ছেলেকে ফিরে পাবার জন্য। লোকজন তাকে দেখতে গেলে নির্বাক চোখে তাকিয়ে তাকেন। কখনো হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন। আবার কারো কাছে ছেলের খবর এনে দিতে আকুতি জানান। কিন্তু তাঁর ছেলে ফিরে পাবার জন্য তাকে কি কেউ কোন শান্তনা দিতে পারছেন? কে জানে ইলিয়াস আলী কোথায়। সরেজমিনে ইলিয়াস আলীর গ্রামের বাড়ি উপজেলার রামধানা গ্রামে গিয়ে দেখা যায় সেখানে পিনপতন নিরবতা। আগের মতো মানুষের আনাগোনা নেই। বাড়িতে ঢুকে বাংলো ঘরে গিয়ে দেখা যায় চেয়ারের স্তুপ। আগেইর মতো আছে ইলিয়াস আলীর বসার আসন। ঘরটি বেশ বড় এবং চারিদিকে ইলিয়াস আলীর সাথে বিশিষ্ট জন ও নেত্রী-নেতার ছবি টাঙানো। ইলিয়াস আলী যখনই বাড়িতে আসতেন তখন এই ঘরটিতে বসে নেতাকর্মী ও এলাকাবাসীর সাথে বৈঠক করতেন। কিছুক্ষন পর সেখান থেকে ইলিয়াস আলীর মায়ের ঘরে গিয়ে দেখা যায় তিনি বিছানায় শুয়ে আছেন। সাংবাদিক এসেছেন শুনে কেউ একজন তাকে ধরে বসালেন। কেমন আছেন জানতে চাইলে অস্পষ্ট ভাষায় তিনি বলেন, ‘ আল্লাহ যে ভাবে রাখছইন অউ ভাবে আছি, আইজ এত দিন অইল আমার পুয়া নাই অইছে কোন খোজ পাইনা, কিলা ভালা থাকতাম কউকা, আমরা সরকাররে কত বার কইলাম আর কুন্তা চাইনা শুধু আমরার মানুষ চাই। যে কুন্তার বিনিময় আমার পুয়া ও নাতিরে ফিরত চাই। কিন্তু সরকার কোন ব্যবস্থা করল না, এখন আমার ভরসা আল্লাহ, একমাত্র আল্লাহর কাছে কইরাম আমার ছেলেরে ফিরাইয়া দিতা’ বলেই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। তার পর আবারো সুর্যবান বিবিকে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হয়।
সাধারন মানুষের প্রত্যাশা ছিল সরকার ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করে দেবে। অথবা ইলিয়াস কোথায় আছে সরকার তার সঠিক সন্ধান বের করবে। কিন্তু দেখা গেল সরকারের লোকজন একেক সময় একেক কথা বলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছেন। শেষ পর্যন্ত প্রধান মন্ত্রীর আশ্বাসও নিরাশ হয়ে গেল। এখন একমাত্র সৃষ্টিকর্তা জানেন ইলিয়াস আলী কোথায় ও কেমন আছেন এবং কবে ফিরবেন।
কান্না থামছে না আনসারের পরিবারের ঃ ইলিয়াস আলীর সাথে ঢাকা থেকে নিখোঁজ হন তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ী চালক আনসার আলী। আনসার আলী ছিলেন ইলিয়াস আলীর একজন নিকটাত্বীয় এবং বিশ্বস্ত। দীর্ঘ দিন ধরে ইলিয়াস আলীর সাথেই আনসার আছেন। নিখোঁজের পর ইলিয়াস আলীর জন্য দলীয় নেতাকর্মীসহ যেমন দেশবাসী উদ্বেগ উত্কণ্ঠায় রয়েছেন ঠিক তেমনি ভাবে আনসার আলীর জন্যও মানুষের আপষোসের শেষ নেই। আনসার আলীর পিতা ইউসুফ আলী মারা যাবার পর সংসারের হাল ধরেন আনসার নিজেই। ২ভাই ২বোনের সংসারে পারিবারিক আর্থিক অসচ্ছলতা থাকায় লেখাপড়া ছেড়ে আনসার নিজের রোজগার দিয়ে সংসার চালাতে থাকেন। এক পর্যায়ে নিজের উপার্জিত টাকা ও ধার কর্জ করে ছোট ভাইকে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠান। দুই ভাই মিলে বিয়ে দেন দুই বোনকে। এক সময় নিজেও বিয়ে করেন একই উপজেলার দোহাল গ্রামের মুক্তা বেগমকে। যখন পরিবারের আর্থিক অবস্থা কিছুৃটা সচ্ছল তখনি আনসার নিখোঁজ হওয়ায় তার পরিবারে নেমে আসে অমাবস্যার অন্ধকার। বর্তমানে আনসারের পরিবারে মা নুরজাহান বেগম, স্ত্রী মুক্তা বেগম ও অবুঝ শিশু মুখশানা মাহজাবিন চাঁদনী অসহায় অবস্থায় দিন যাপন করছেন। অসহায় এই পরিবারের কান্নায় আকাশ বাতাস যেন ভারী হচ্ছে। পাড়া প্রতিবেশীদের কোন শান্তনাই তাদের কান্না থামাতে পারছেন না। এ কান্না কবে থামবে একমাত্র সৃষ্টি কর্তাই জানেন। ইলিয়াস ও আনসারের শুভাকাংখীরা তাদের বাড়িতে দেখা সাক্ষাত করতে গেলে তার মা সকলের কাছে বিলাপ করে কাঁদতে থাকনে। তিনি বলেন, আমার ছেলে কোন রাজনীতি করেনা। কারো সাথে শত্রুতাও নেই। ইলিয়াস আলীর সাথে থাকায় আমার পুত্র নিখোঁজ হয়েছে। আমি সরকারের কাছে আমার ছেলে ও ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার আকুল আবেদন করছি।
গতকাল এই প্রতিনিধি সরেজমিনে আনসারের নিজ বাড়ি উপজেলার গুমরাগুল গ্রামে গেলে তাঁর মা এগিয়ে এসে এই প্রতিবেদক কে ঘরে নিয়ে বসান। সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। নুরজাহান বেগম আবেগে আপ্লুত হয়ে বলেন ‘কত সাংবাদিক আইলা গেলা, ক্যামেরা দিয়া ছবি তুললা, কিন্তু কুন্তা অইলনা, আমার পুয়ারে তারা ফিরত দিতা পারলানা, আমরা সংবাদ সম্মেলন করি সরকাররে কইলাম আমার পুয়ারে ফিরত দিবার কথা, কিন্তু আমার পুয়ার কোন খবর নাই, আমি অখন চলতাম পারিনা অসুখ, আমার পুয়ায় আমারে ঔষধ অনিয়া দিত, আইজ আমারে ঔষধ কে আনিয়া দিব? এই দুনিয়াত বিচার নাই, এরলাগি আমি এখন আল্লার দিকে চাইয়া আছি, আল্লায় আমার পুয়ারে ফিরত দিবা’ এ কথা বলেই তিনি গুমরে উঠেন। এসময় আনসারের স্ত্রী মুক্তা বেগম ও মেয়ে চাঁদনী দাদীর পাশে এসে বসে। দাদীর কান্না দেখে চাঁদনী ও আব্বা আব্বা বলে কেঁদে ফেলে। এসময় মুক্তা বেগমও চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। মুক্তা বলেন, আমার স্বামীকে হারিয়ে আমরা আজ অসহায় হয়ে পড়েছি। একদিকে আমার শাশুড়ি ছেলের চিন্তায় শয্যাশায়ী অন্য দিকে আর্থিক সংকটের কারণে চিকিত্সা করাতে পারছিনা। আমার অবুঝ শিশুটি প্রতিনিয়ত বাবার জন্য কাঁদে। আমি তাকে কি শান্তনা দেব সেই ভাষা আমার জানা নেই। আমার দেবর মধ্যপ্রাচ্যে রুজি রোজগারহীন হয়ে কষ্টে আছে। ৭/৮মাস পূর্বে দলের পক্ষ থেকে খোজ খবর নিলেও বর্তমানে কেউ আমাদের সাথে যোগাযোগ করছেন না। এখন আমি কিভাবে পরিবার চালাবো তা আমার জানা নেই। তিনিও সরকারের কাছে তাঁর স্বামীকে ফিরিয়ে দেওয়ার আকুতি জানান।
প্রসঙ্গত: গত বছরের ১৭ এপ্রিল রাতে ঢাকার বনানী এলাকা থেকে নিখোঁজ হন সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সাংসদ এম. ইলিয়াস আলী ও তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িচালক আনসার আলী। এখবর ছড়িয়ে পড়লে তাঁর জন্মস্থান বিশ্বনাথ তথা সিলেটবাসী আন্দোলনে নামে। তাদের সন্ধানের দাবিতে হরতাল ডাকে কেন্দীয় বিএনপি। হরতালের দ্বিতীয় দিন গত বছরের ২৩এপ্রিল মিছিল করতে গিয়ে নিহত হয় বিশ্বনাথে যুবদল ও ছাত্রদলের তিনজন নেতাকর্মী। ৭/৮টি মামলায় আসামী করা হয় প্রায় ২৫ হাজার নেতাকর্মীকে। নেতাকর্মীসহ হয়রানি করা হয় সাধারণ মানুষকে। শতাধিক নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধ অবস্থায় এখনও বেঁছে আছেন। প্রায় তিন শতাধিক নেতাকর্মী দীর্ঘদিন কারাভোগ করে আইনী লড়াই শেষে কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। এখনও তাদের সন্ধানের দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করছে বিশ্বনাথবাসী