বাংলাদেশের ইয়াবা গডফাদার সাইফুল এখনো অধরাঃ নৌ ও স্থল পথে সমান তালে চলছে ব্যবসা


ফরিদুল মোস্তফা খানঃ সর্বনাশা ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত টেকনাফের শীর্ষ এক ব্যবসায়ী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রসফায়ারে নিহতসহ আরো বেশ কয়েকজন বাঘা বাঘা মাদক সম্রাটের গ্রেপ্তারের পরও নিজের অবস্থান টিকিয়ে রেখে স্থল ও নৌ পথে ভয়ংকর এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন, বাংলাদেশের ইয়াবা গড ফাদার সাইফুল করিম ওরফে হাজী সাইফুল। ফলে ক্রমেই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়া ভয়ংকর উক্ত মাদক ইয়াবা ব্যবসা সম্ভবত বাংলাদেশ থেকে আর নির্মূল করা যাবে না। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও রাষ্ট্রীয় সব যন্ত্র ট্যাবলেটটি প্রতিরোধে যতই কড়াকড়ি ভূমিকা পালন করে সুচতুর ইয়াবা ব্যবসায়ীরা ততই কৌশল পাল্টিয়ে প্রতিদিন সীমান্তের ৪৩ পয়েন্ট দিয়ে বানের পানির মতো ঢুকাচ্ছে ট্যাবলেটটি। সীমান্ত এলাকায় ৮টি সংগঠনের ব্যানারে ৩৭টি কারখানা প্রতিদিন প্রায় ৩০ লাখেরও বেশি প্রাণঘাতি এই মাদক সরবরাহ দিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। এ কাজে জড়িত ইয়াবা গডফাদার হাজী সাইফুলসহ বাঘা সব ইয়াবা ব্যবসায়ীরা টেকনাফের স্থায়ী ঠিকানা ছেড়ে এখন বন্দর নগরী চট্টগ্রাম ও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে তুলেছেন আবাস। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, মুঠোফোনের মাধ্যমে সেখান থেকে ইয়াবা বাণিজ্যের কলকাটি নাড়া উক্ত ইয়াবা স¤্রাট সাইফুল সবসময় থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

প্রশাসনের তালিকায় কোন দিন আসেনা তার নাম। রহস্যজনক ভাবে বছরের পর বছর ধরে অধরা থেকে যাওয়া এই সাইফুলের একক পৃষ্টপোষকতায় এখন দেশব্যাপী পরিচালিত হচ্ছে ভয়ংকর মাদক ইয়াবা ব্যবসা।
জানা গেছে, প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে ইয়াবা ব্যবসায়ী সাইফুল মাঝে মধ্যে নিজেকে হাজী, আলেম, ক্রীড়া প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন বেশ ধরে ক্ষান্ত হননা, ক্ষেত্রবিশেষ প্রশাসনের সোর্স বনে যান।
সূত্র জানায়, এ কাজে পারদর্শী বিত্তহীন থেকে কোটিপতি হওয়া উক্ত সাইফুল নিজের এক ভাইকে সংবাদকর্মী বানানোর পাশাপাশি কক্সবাজারের অপর এক শীর্ষ দৈনিক এর প্রতিনিধির সাথে সার্বক্ষণিক লিয়াঁজু রাখেন। মূলত সাইফুলের লিয়াজু রাখা সাংবাদিক নামধারী এসব ইয়াবা গডফাদাররাই বছরের পর বছর ধরে নিয়ন্ত্রণ করছে তার ইয়াবা সম্রাজ্য। এ অবস্থায় আসল ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বাদ দিয়ে তারা প্রশাসনের দৃষ্টি ঘুড়িয়ে দিতে অনেক সময় উদ্দেশ্যমূলক সংবাদ পরিবেশন এমনকি সীমান্তের ইয়াবা প্রতিবাদকারীদের উপর ঝাপিয়ে পড়েন। শুধু তাই নয়, হাজী সাইফুলসহ এলাকায় এ রকম আরো অনেক ইয়াবা গডফাদার রয়েছে, যারা সীমান্তে নিজেদের অবৈধ বাণিজ্যের আধিপত্য বিস্তার ও অপকর্ম টিকিয়ে রাখতে নানান কারিশমায় স্থানীয় লোকজনদের জিম্মি করে রাখেন।
জানা গেছে, এক সময় চট্টগ্রামের একটি আঁড়তে সামান্য বেতনে চাকরি করে এখন ইয়াবা ব্যবসায়ী শত কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া হাজী সাইফুলই একমাত্র ব্যক্তি যার একক পৃষ্টপোষকতায় চলছে বাংলার বড় সব ইয়াবার চালান। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, মিয়ানমারের বড় বড় ইয়াবা ব্যবসায়ীদের কাছে বাংলাদেশের পাইকারি ট্যাবলেট ক্রেতা খ্যাত হাজী সাইফুলের কারনেই দেশে ভয়ংকর এই মাদক নির্মুল করা না গেলেও এ পর্যন্ত প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় কোন ব্যবস্থা নিতে পারেননি। অভিযোগ উঠেছে পুলিশ, বিজিবি ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর গোপন প্রতিবেদন এমনকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় শীর্ষ এই ইয়াবা ব্যবসায়ী বছরের পর বছর ধরে সর্বনাশা মাদক ট্যাবলেট দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিলেও প্রশাসন তার বিরুদ্ধে কার্যকর কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। কক্সবাজারে কর্মরত দেশের শীর্ষ একটি দৈনিকের স্টাফ রিপোর্টার তাকে সবসময় শুধু আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে তা বড় কথা নয়, জানা গেছে, সাংবাদিক নামধারী ওই ব্যক্তি সাইফুলের কোন ইয়াবা আটক হলে তা ছাড়িয়ে নিতেও প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট স্তরে ধর্না দেন। 
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে হাজী সাইফুল করিম নিজের জাহাজে করে চট্টগ্রাম বন্দরে ইয়াবা নিয়ে যান। সেখান লাইটার জাহাজে ঢাকা, ভৈরব ও খুলনা হয়ে ভারতেও পাচার হয় ইয়াবা। খুলনা ও যশোর ইয়াবার রুট না হওয়ায় ওই রুট দিয়ে পরে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় নিরাপদে ইয়াবা আনা-নেওয়া করেন সাইফুল।
গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী প্রশাসন ও বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের হৃদ্যতা রয়েছে তার সঙ্গে। টেকনাফ-কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে সাইফুলের বাড়িতে অনেক কর্মকর্তারা নিয়মিত আসা-যাওয়া করেন। প্রায় কর্মকর্তাদের জন্য খানাপিনার আয়োজন করা হয় বলে জানা গেছে। এসব কর্মকর্তাদের সাইফুল দামি উপহারও দিয়ে থাকেন। হাজী সাইফুল টেকনাফ বিজিবি’র সাবেক এক কর্মকর্তাকে ৩৭ লাখ টাকায় একটি গাড়ি কিনে দিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, ওই কর্মকর্তা বর্তমানে বিজিবি’র সদর দপ্তরে কর্মরত রয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাইফুলের একক পৃষ্টপোষকতায় তার ইয়াবা স¤্রাজ্যে কক্সবাজারে কর্মরত শীর্ষ এক দৈনিকের সাংবাদিক, পুলিশের চট্টগ্রাম বিভাগীয় এক কর্মকর্তা, আব্দুর রহমান ও জিয়াউর রহমান নামের তার দুই শালা, ভগ্নিপতি তোয়াক্কেল হোসেন (বর্তমানে কারান্তরীন) সহ আরো বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। যা তদন্ত শেষে প্রকাশিত হবে। শুধু তাই নয়, এই চক্রে রয়েছে ইয়াবা ব্যবসায় ৫শ’ ৬০ জনের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। 
টেকনাফ উপজেলার বেশির ভাগ পরিবারের কোন না কোন সদস্য ভয়ংকর এই ব্যবসায় সম্পৃক্ত। ওই এলাকায় অনেকেই ঠাট্টা করে বলেন, টেকনাফে ইয়াবা দিয়েই আপ্যায়ন করা হয় হঠাৎ আমন্ত্রিতদের।
স্থানীয় এক স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনের কর্মকর্তা বলেন, যারা ইয়াবা ব্যবসা করেন তাদের চেয়ে যারা ব্যবসা করেন না, তাদের তালিকা করাই সহজ।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, সীমান্তের কুলালপাড়া, ডেইলপাড়া, পল্লানপাড়া, কে.কে পাড়া, বাজার পাড়া, আলিয়াবাদ, নাইট্যং পাড়া, চৌধুরী পাড়া, ইসলামাবাদ, কলেজ পাড়া, লামার বাজারসহ এমন কোন পাড়া নেই যেখানে ইয়াবা ব্যবসায়ী নেই। সূত্র মতে, টেকনাফ উপজেলার প্রায় প্রতিটি গ্রাম ছাড়াও উখিয়া, রামু, মহেশখালী, কক্সবাজার সদর ও চকরিয়া-পেকুয়ায়ও হাজারো খুচরা ইয়াবা ব্যবসায়ী রয়েছে। গোপনে যার একক পৃষ্টপোষকতা করছে হাজী সাইফুল। সূত্র মতে, ইয়াবার পাইকারী বিক্রেতা হাজী সাইফুলই দিব্যি এসব খুচরা ব্যবসায়ীদের ট্যাবলেট সরবরাহ দিয়ে আসলেও প্রশাসনের তালিকায় সংশ্লিষ্টরা কখনো তার নাম রাখে না।
অভিযোগ উঠেছে, সংশ্লিষ্টরা তালিকায় শুধু সাইফুলের নাম বাদ দেয়, তা বড় কথা নয়, শীর্ষ এই ইয়াবা গডফাদারের শিখিয়ে দেওয়া নিরপরাধ লোকজনদেরও এই তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়।
সীমান্তে ৩৭ ইয়াবা কারখানা ঃ
মিয়ানমার সীমান্তে ৩৭ ইয়াবা কারখানায় তৈরি হয় ১৩ ধরনের ভয়ংকর মাদক ইয়াবা। এসব কারখানার মধ্যে মিয়ানমারের কুখাই এলাকায় কেচিন ডিফেন্স আর্মিরই রয়েছে ১০টি কারখানা। নামকখাম এলাকায় পানশে ক্যাও ম্যাও অং মৌলিন গ্রুপের কারখানা রয়েছে দুটি। কুনলং এলাকার স্পেশাল পুলিশ এক্স হলি ট্র্যাক্ট গ্রুপের রয়েছে একটি, এক নম্বর ব্রিগ্রেড তাংইয়ান এলাকায় ম্যাংপাং মিলিশিয়া ও মংঙ্গা মিলিশিয়া শান স্টেট আর্মির (নর্থ) রয়েছে একটি করে কারখানা। লুই হুপসুর (মংশু) এলাকায় ইয়ানজু গ্রুপের একটি কারখানা ও নামজাং, মাহাজা অ্যান্ড হুমং এলাকায় শান ন্যাশনালিটিজ লিবারেশন (এসএনপিএল) অ্যান্ড কাই-সান চুউ শাং (নায়াই) গ্রুপের রয়েছে ৪টি কারখানা, কাকাং মংটন এলাকার ইউনাইটেড ওয়া এস্টেট আর্মির (ইউডব্লুএসএ) আছে আরও ৩টি ইয়াবা কারখানা। এছাড়া মংশাত, তাশিলেক, মংপিয়াং ও পাংশাং এলাকায় ইউনাইটেড ওয়া এস্টেট আর্মি (ইউডব্লুএসএ) ও লাহু মিলিশিয়ার কারখানা রয়েছে ১০টি। মাওকমাই এলাকায় শান ন্যাশনালিটিজ পিপল আর্মির রয়েছে দুটি কারখানা, কোকান এলাকায় মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মির কারখানা রয়েছে (এমএনডিএএ) একটি। এসব কারখানায় ১৩ ধরনের ইয়াবা তৈরি করা হয়। এর মধ্যে ডব্লিওওয়াই, ৮৮৮আর২, ওকে, গোল্ড, টাইগার, এইচসিআর্ট, চিকেন ওয়ার্ল্ড, স্কালহোয়ে, হর্স-সুয়ে, হর্স হেড এবং ফ্লাওয়ার অ্যান্স এলর্টাট উল্লেখযোগ্য।
চলবে... (আগামি পর্বে সাইফুলের নৌ পথে ইয়াবা বাণিজ্যের ফিরিস্তি)

1 টি মন্তব্য: