অনুসন্ধানি প্রতিবেদন-১:> আন্তর্জাতিক চোরাচালানে বাংলাদেশের গডফাদার চট্টগ্রাম-টেকনাফের ইয়াহিয়া

বেরিয়ে আসছে কুকৃর্তির সব অজানা কাহিনী

কক্সবাজারের মাফিয়া ডনফরিদুল মোস্তফা খান (আমাদের সময় ডটকম): আন্তর্জাতিক চোরাচালানে বাংলাদেশের গডফাদার হচ্ছেন নিজেদের ক্ষমতার জন্য সব সময় সরকারি দলের কাছাকাছি থাকতে ইচ্ছুক চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের বহুল আলোচিত সমালোচিত মাফিয়া ডন খ্যাত আনিসুর রহমান ইয়াহিয়া। তিনি অবশ্যই বর্তমানে উখিয়া-টেকনাফ থেকে জাতীয় পার্টি মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থী তাহা ইয়াহিয়ার পিতা। বৃহত্তর চট্টগ্রাম টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত উক্ত ইয়াহিয়ার নেটওর্য়াক। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশকে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল হিসেবে পরিচিত করার যে পরিকল্পনা তাও তার পরিবার তথা ভাই শফি সহ এই চক্রের অন্যান্য চোরাকারবারিদের। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ দিয়ে যত সব অস্ত্র, মাদক সহ বিভিন্ন পণ্যের বড় বড় চোরাচালান হয়েছে সবই ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। প্রধানত অস্ত্র, সার ও সিগারেট চোরাচালানই মূলতঃ ইয়াহিয়ার নেতৃত্বাধিন চক্রের প্রধান কাজ ছিল।
ফলে দেশ-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছে এই চক্রের সদস্যরা। গত জরুরী অবস্থায় যৌথ বাহিনীর অভিযান আতংকে দিকবিদিক লাপাত্তাও ছিল তারা। ওই সময়  ইয়াহিয়ার বেশ কয়েকটি ব্যাংক একাউন্ট জব্দ করা হয়েছিল। আন্ডারওয়াল্ডের মহারতি এই ইয়াহিয়াকে তৎকালীন সময়ে র‌্যাব, পুলিশ, গোয়েন্দা ও ট্রান্সফোর্স সদস্যরা হন্য হয়ে খুঁজলেও তিনি ছিলেন অধরা। তার জন্য তখন পৃথক পৃথক ফাইল খুলেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক।
এছাড়া মাফিয়া ডন হিসেবে পরিচিত ইয়াহিয়ার ভাই শফিকুর রহমান শফি সহ তার পরিবারের সকল কুকৃর্তি বেশ জুড়ে শুরে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায় নড়ে চড়ে বসেছিল রাষ্ট্রীয় সব যন্ত্র।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ছাত্র জীবনে মেধাবী ইয়াহিয়া চট্টগ্রাম কলেজে পড়ার সময় থেকেই জড়িয়ে পড়েন ব্যবসায়। পৈত্রিক ভাবে ধনির দুলাল হলেও টাকার পাহাড় গড়তে তিনি হারিয়ে যান অন্ধকার জগতে। বৈধ ব্যবসার পাশাপাশি কালো বাজারে সিগারেট আমদানি দিয়ে শুরু হয় ইয়াহিয়ার অন্ধকার জগতে পথ চলা। তবে তার বিশাল সম্পত্তি গড়ার পেছনে মূল ভিত্তি ছিল মিয়ানমার। চোরাই পথে বিভিন্ন ধরনের বার্মিজ পণ্য এনে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন তিনি। দেশের সম্পদ সার পাচার চক্রে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। পরে সময়ের ব্যবধানে ইয়াহিয়া জড়িয়ে পড়েন স্ট্রণ ও অস্ত্র চোরাচালানে। মূলতঃ আন্তর্জাতিক মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠে ইয়াহিয়ার। এরপর থেকে দেশের সব মাফিয়া কর্মকান্ডে মধ্যমণিতে পরিণত হন তিনি। দাউদের পরিকল্পনার অন্যতম বাস্তবায়নকারী হিসেবে কাজ করে যেতে থাকেন আনিসুর রহমান ইয়াহিয়া। এক পর্যায়ে টাকার পাহাড়ে নিজের সম্মানজনক একটু স্বস্থি খুঁজে নিতে তিনি কক্সবাজারের ইতিহাসে সবচেয়ে মোটা টাকা দিয়ে ক্রয় করে নেন “দৈনিক আজকের দেশ-বিদেশ” পত্রিকা। এরপর মাফিয়া ডন ইয়াহিয়া গণমাধ্যমের খাতায় নিজের নাম অন্তর্ভূক্ত করার ফলে তখন থেকে এ পর্যন্ত কৃত সব অপকর্মের দুর্নাম মুছতে তৎপর হয়ে উঠেন। এক্ষেত্রে বেশ সফলতাও পান ইয়াহিয়া। কারন তিনি নিজেই একটি পত্রিকার মালিক হয়ে যাওয়ায় অনেক সংবাদকর্মী চোখ লজ্জায় তার কুকৃর্তির ঘটনা প্রকাশ থেকে নিজেদের বিরত রাখতে শুরু করেন।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম শহরের অভিজাত এলাকা খুলশির ১ নং রোডে একেবারে শেষ দৃষ্টিনন্দন বাড়িটি ইয়াহিয়ার। এ বাড়িটি চোখ রাখলে বুঝা যাবে তার সম্রাজ্য কতটা বিশাল। দীর্ঘদিন ধরেই এই বাড়িটিকে রি-মডেলিং করে চলেছেন তিনি। তার এই রি-মডেলিংয়েই তিনি খরচ করেছেন কোটি কোটি টাকা। চট্টগ্রামে এমন বিলাস বহুল বাড়ি দ্বিতীয়টি কারোর আছে কিনা সন্দেহ! এই বাড়ির প্রতিটি কক্ষের সঙ্গে লাগানো আছে ছোট ছোট সিঁড়ি। এসব সিঁড়ি ব্যবহার করে যে কেউই যেকোন তলার কক্ষে সহজেই যেতে পারে। ভবনের ছাদে রয়েছে অত্যাধুনিক সুইমিংপুল। প্রায় ৮ গন্ডা জায়গা জুড়ে রয়েছে ইয়াহিয়ার এই বাস ভবন। তৎমধ্যে ৫ গন্ডা ব্যবহার করেন তিনি বিল্ডিংয়ে, বাকি জায়গা জুড়ে তুলেছেন শখের বাগান। খুলশিতেই তার আরো একাধিক ভবন রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে। এছাড়া ঢাকা, কক্সবাজার, টেকনাফ, উখিয়া টিভি রিলে স্টেশনের পূর্ব পাশে বিশাল শাহপরী গার্ডেন, শাহপরীরদ্বীপ, সেন্টমার্টিন, মিয়ানমার, সিঙ্গাপুর এবং দুবাইতে রয়েছে তার আরো অনেক বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
সূত্র জানায়, ১৬ মে ২০০৮ সালের আগ পর্যন্ত ইয়াহিয়া বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ১৮২ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছিলেন। বিশাল এই ঋণ পরিশোধ না করে তিনি দীর্ঘদিন ধরে লাপাত্তা থাকায় রাতের ঘুম হারাম হয়ে পড়েছিল ব্যাংক কর্তৃপক্ষের। তবে এখনো তিনি সেই ঋণের টাকা সম্পূর্ণ শোধ করেছেন কিনা বিস্তারিত জানা যায়নি।
চোরাকারবারি ইয়াহিয়ার খোঁজখবর নিতে গেলে বিস্মিত হয়ে যান সকলেই। দুদক কর্মকর্তা সাংবাদিক ও সংশ্লিষ্টরা তার হরেক অপকর্মের সন্ধানে রীতিমত হতভাক। চট্টগ্রাম শহরের ইয়াহিয়ার এক প্রতিবেশি জানান, আমরা তার সম্পর্কে যতটুকু জানি তা শেষের নয়। যতই খবর নিতে চেষ্টা করি ততই বেরিয়ে আসে ইয়াহিয়ার অন্ধকার জগতের অজানা অনেক কাহিনী। যা রাষ্ট্রের একজন ভালো নাগরিকের পক্ষে করা সম্ভব নয়। কারণ তার অন্ধকার সব কুকর্মে দেশদ্রোহিতার আভাস রয়েছে।
দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের আগে ইয়াহিয়ার সম্পর্কে দপ্তর অনেক কিছু অবহিত হয়েছে। তার জন্য এক সময় দুদকে পৃথক পৃথক ফাইলও খোলা হয়েছিল। কিন্তু জরুরী অবস্থার পর নতুন সরকার গঠন হলে ইয়াহিয়া এসব ফাইল গুলো আটকে যায়। শুধু দুদক নয়, র‌্যাব, পুলিশ ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তার সম্পর্কে অনেক কিছু জানে। কিন্তু কেউই তো বিষয়টি নিয়ে কখনো মাথায় ঘামায় না। আর যারা যখন মাথা ঘামিয়েছেন তারা পেয়েছেন চোরাচালান সম্রাট ইয়াহিয়া ভান্ডারের বান্ডিল বান্ডিল নগদ টাকা। এ কারনেই বছরের পর বছর ধরে তিনি শুধু রেহাই পেয়ে আছেন তা বড় কথা নয়, তার ছত্রছায়ায় এখনো দেশের গণমাধ্যম ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা হচ্ছে। হয়তো তিনি কিংবা তার ছেলে অথবা তার অন্য কোন চোরাকারবারি সহযোগিতা যেকোন সময় মহান জাতীয় সংসদ সদস্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি পদবির কর্ণধারও হয়ে যেতে পারেন। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তখন সেই ইয়াহিয়াদের কাছ থেকে জাতি কি আশা করতে পারেন, তা নিশ্চয়ই সচেতন মহলের এখনই ভাবার সময়।
ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা ও গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ:-
নিজেদের সব কুকৃর্তি ও চোরাচালান নির্বিগ্নে চালিয়ে যেতে যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, সে সরকারের ক্ষমতার স্বাধ ও গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের মতো দূর্দান্ত কৌশলী ইয়াহিয়া ও তার পরিবার। এ কারনে কক্সবাজারে তিনি রাতারাতি ক্রয় করে নেন দৈনিক আজকের দেশ বিদেশ নামক একটি পত্রিকা। ফলে কক্সবাজারের গণমাধ্যম ইতিহাসে তার নাম নিবন্ধিত হওয়ায় স্থানীয় সহকর্মী সাংবাদিকদের সহমর্মীতাও তিনি কম পাননি। জানা গেছে, চোরাকারবারি ইয়াহিয়া সাংবাদিকদের সাথে নিজের সম্পর্ক ঘাড় করতে স্থানীয় বাঘাবাঘ সাংবাদিকদের চড়া বেতন ও পদবি দিয়ে নিজের পত্রিকায় কর্মসংস্থান করে দেন। ফলশ্রুতিতে সাংবাদিকদের মধ্যে তার নিজস্ব একটি বাহিনী গড়ে উঠায় অন্যান্য সাংবাদিকরা ইয়াহিয়াকে নিয়ে কখনো ঘাটাঘাটি করেন না। অভিযোগ উঠেছে, ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে কেউ টু-শব্দ করলে তার মালিকানাধীন দৈনিক আজকের দেশ বিদেশ পত্রিকা দিয়ে তিনি তাকে (প্রতিবাদকারীকে) সায়েস্তা করে দেন। শুধু তাই নয়, ব্যক্তিগত জীবনে প্রচুর অর্থবিত্ত বৈববের মালিক হওয়ায় ইয়াহিয়া নাকি প্রতিপক্ষ কাউকে সহ্য করতে পারেন না। লেখালেখি, হামলা, মামলা যখন যা দিয়ে শত্রুর সাথে মোকাবেলা করতে হয়, তখন তাই করতে তিনি পারদর্শি।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, কক্সবাজারের কিছু বাঘাবাঘা সাংবাদিককে কৌশলে তিনি নিজের পক্ষে এনে সব সময় ক্ষমতাসীন হয়ে থেকেছেন। কেউ তার অপকর্মের কথা প্রকাশ করলেই তার উপর নেমে এসেছে ইয়াহিয়া ও দৈনিক আজকের দেশ বিদেশ পত্রিকার নিপীড়ন। শুধু তাই নয়, জানা গেছে ইয়াহিয়া ও তার চোরাকারবারী সদস্যরা যখন বুঝতে পারেন এই দেশে অপকর্ম করতে হলে নিশ্চয়ই রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়া দরকার। তাই তারা একেক সময় একেক কৌশল অবলম্বন করতে পারে। সুত্র জানায়, ইয়াহিয়া তার নিকটতম আত্মীয় ড. হাবিবুর রহমানকে এক সময় আওয়ামী লীগের টিকেট পাইয়ে দিতে তৎপরতা শুরু করেন। এজন্য তারা আওয়ামী সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ইতিপূর্বে একাধিকবার দেখা করার পাশাপাশি ইয়াহিয়া নিজেই বিএনপি’র টিকেট পেতে তৎপরতা চালান। তবে দেশের দু’ প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা তার হরেক কুকৃর্তির তথ্য জেনে ফেলায় কেউই আনুষ্ঠানিক ভাবে ইয়াহিয়া ও পরিবারের কাউকে নিজেদের দলে এনে বিতর্কে জড়াননি। এ অবস্থায় ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে সুচতুর চোরাচালানি ইয়াহিয়া ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা যখন যাকে ক্ষমতায় আনার দরকার গোপনে টাকা-পয়সা দিয়ে তাদের সহযোগিতা করে নিজেদের ভাগ্য সব সময় নিয়ন্ত্রণে রাখতে। এছাড়া এরশাদ সরকারের আমলে তার ভাই আরেক মাফিয়া ডন শফি জাতীয় পার্টি থেকে সংসদ নির্বাচনের প্রচেষ্টা চালান। তবে এক্ষেত্রেও তাকে ব্যর্থ হতে হয়। এম.এ গণি তাকে টেক্কা দিয়ে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে যান। ৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠন করলে শফি ও ইয়াহিয়ারা সক্রিয় হয়ে উঠেন। বহুমুখী প্রচেষ্টায় বিএনপি’র হাই কমান্ডের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করেন তারা। মূলতঃ এই সময় থেকে দেশ জুড়ে ইয়াহিয়ারা চোরাচালান নেটওয়ার্কের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটান।
জানা গেছে, ৯১ সালের বিএনপি সরকার গঠনের পর ইয়াহিয়ার ভাই শফিকুর রহমান সোনাদিয়া দ্বীপ দিয়ে ১০ মন সোনা চোরাচালানের মাধ্যমে আনছেন বলে খবর পায় পুলিশ। ফলে তৎকালীন সময়ে অভিযানে নামেন কক্সবাজার সদর থানার ও.সি আজিজুর রহমান। এ সময় তিনি উদ্ধার করেন সাড়ে ৪ মন সোনা। যেগুলো পরবর্তীতে সরকারের কাছে জমা দেয়া হয়। সোনা ধরা পড়ার পর মাফিয়া ডন ইয়াহিয়ার পরিবার রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় চোরাচালান করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। যেকোন মূল্যে ৯৬ নির্বাচনে উখিয়া-টেকনাফ আসন থেকে ইয়াহিয়া নিজেই জোট প্রার্থী হওয়ার জন্য সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর শরণাপন্ন হন। কিন্তু এখানেও দুভার্গ্য কৌশলী চোরাচালানি গডফাদার ইয়াহিয়াদের। এই আসনে শাহাজাহান চৌধুরীর আধিপত্যের কারনে ইয়াহিয়ার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ থেকে পুনরায় ইয়াহিয়া গং-এর আরেক গডফাদার হাবিবুর রহমানের প্রার্থীতা নিশ্চিত হয় বলে এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে ইয়াহিয়া সহ তার অপর চার ভাই বেঁকে বসেন। হাবিবুর নির্বাচন করলে তাকে হারানোর জন্য প্রয়োজনে শত কোটি টাকা খরচ করবেন বলে ঘোষণা করেন ইয়াহিয়ারা। এক পর্যায়ে চাপের মুখে নির্বাচন থেকে সড়ে দাঁড়ান ড. হাবিব।
অস্ত্র পাচার চক্র ও রুট ঃ-
দেশের অস্ত্র পাচারে রয়েছে তার সম্পৃক্ততায় ৪ সদস্যের একটি সঙ্গবদ্ধ চক্র। তারা হলেন বাংলাদেশের দাউদ ইব্রাহিম হিসেবে পরিচিত। চট্টগ্রামের বহুল আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার অন্যতম আসামী শফিকুর রহমান, আনিসুর রহমান ইয়াহিয়া, টেকনাফের সাবরাং এলাকার হামিদুর রহমান ও ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার প্রধান আসামী হাফিজুর রহমান। এছাড়া অস্ত্র চোরাচালানে এলাকা ভিত্তিক রয়েছে আরো কয়েকজন সদস্য।
সূত্র জানায়, উক্ত চক্র বিদেশ থেকে অস্ত্র আনার রুট হিসেবে ব্যবহার করে সাগর পথ। পরে এসব অস্ত্র দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছানো হয়। অস্ত্রগুলো শুধু দেশে নয়, বিদেশে পাচারের ক্ষেত্রেও তারা এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। দেশের ইতিহাসে স্মরণকালের চট্টগ্রামের আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলায় মাফিয়া ডন শফিকুর রহমান, হাফিজ উদ্দিন আসামী হলেও রহস্যজনক কারনে তৎকালীন সময় পার পেয়ে যান আনিসুর রহমান ইয়াহিয়া। অভিযোগ রয়েছে, জোট সরকারের সময় হাওয়া ভবনের কর্তা ব্যক্তির সুনজর থাকায় ওই সময় তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন। তবে আদালত তৃতীয় দফায় অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেওয়ায় ওই সময় আতংকে ছিলেন ইয়াহিয়া। পরে অবশ্যই তিনি নগদ টাকা ও নানা কারিশমায় সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। সূত্র জানায়, এরশাদ সরকারের আমলে কক্সবাজার চোরাচালানে তীর্থস্থান হিসেবে গড়ে উঠার অন্যতম নায়কই হচ্ছেন এই ইয়াহিয়া। সেই জন্য দোর্দন্ড প্রতাপে অবাধে চোরাচালানে কাজ চালিয়ে যান ইয়াহিয়া। যখন যে সরকার ক্ষমতায় ছিল তখন সে সরকারে ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা বসে থাকায় ইয়াহিয়াকে কেউ ঘাটানোর চেষ্টা করেননি এ যাবত। সর্বশেষ জোট সরকার আমলে হাওয়া ভবনের কর্তা ব্যক্তির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ছিলেন তিনি। ওই সময় তিনি নিজেকে তিনি তারেক রহমানের বন্ধু পরিচয় দিতেও দ্বিধাবোধ করেননি। শুধু তাই নয়, অভিযোগ উঠেছে, ইয়াহিয়া নিজেকে উখিয়া-টেকনাফের বিএনপি’র প্রার্থি করতেও আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন। চোরাকারবারিদের শীর্ষ গডফাদার হওয়া সত্বেও বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, ইয়াহিকাকে চেনেন না বা জানেন না এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম। মূলতঃ আন্ডারগ্রান্ডে থেকে চোরাচালানের নেতৃত্ব দেওয়ায় সাধারণ মানুষ তাকে চিনেন না। তবে এক পর্যায়ে খোলস ছেড়ে বের হয়ে আসতে শুরু করেন তিনি। সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে কক্সবাজারে বেশকিছু দিন অকাতার দান-খয়রাতও করেন তিনি। সর্বশেষ ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির বাতিল হওয়া নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা ছিল তার। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সেই নির্বাচনে মনোনয়ন দাখিল করে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেন তিনি।
স্বর্ণ ও সিগারেট চোরাচালান সিন্ডিকেট:-
ইয়াহিয়া চোরাচালানিদের নিয়ে স্বর্ণ ও সিগারেট চোলাচালান গড়ে তুলেন তারা হলো হামিদুর রহমান, শিতল বাবু প্রকাশ এন.কে দাশ, গিরি বাবু (এক সময় কুষ্টিয়া থেকে আটক হয়ে জেল খেটেছেন) ও আনোয়ার, মোহাম্মদ মোজাহের। এই সিন্ডিকেট সমুদ্র পথে স্বর্ণ ও বিদেশী সিগারেট এনে চট্টগ্রামের আনোয়ারার গহিরা এলাকা দিয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতেন।
সার পাচার সিন্ডিকেট:-
৭ সদস্যের সার পাচারকারী সিন্ডিকেট ছিল ইয়াহিয়ার। তারা হলো- হামিদুর রহমান, টেকনাফের জামাল প্রকাশ কালা জামাল, হাবিবুর রহমান, আবুল মঞ্জুর, শমসু, রশিদ ও জলিল প্রকাশ নুর জলিল। এই পাচারকারী সিন্ডিকেট দেশের মূল্যবান সার মিয়ানমারে পাচার করে দেয়। সাগর ও নদী পথে পাচার করা হতো সার। ফলে তৎকালীন সময় কোস্টগার্ড ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এই চক্রের যে তালিকা করেছিল সেখানে ইয়াহিয়ার নাম ছিল।
বিদেশে ইয়াহিয়ার যত সম্পদ ও ব্যবসা ঃ-
শুধু বাংলাদেশে নয়-বিদেশেও প্রাচুর্যের পাহাড় গড়েছেন ইয়াহিয়া। বিশেষ করে দুবাই, সিঙ্গাপুর ও মিয়ানমারে রয়েছে তার ব্যবসা বাণিজ্য। দেশ থেকে অবৈধ ভাবে অর্থ পাচার করে বিদেশে বাড়ি-গাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন ইয়াহিয়ারা। বিদেশে তার সম্পত্তির মধ্যে দুবাইয়ে আলিশান একটি বাংলো, একটি বিশাল এপার্টমেন্ট ও হুন্ডি ব্যবসা। বিএনপি’র আলোচিত ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুন আরো দুজন বিএনপি নেতার এসব সম্পত্তিতে অংশিদারিত্ব ছিল বলে গুণজন ছিল। মিয়ানমারে হুন্ডা, পেডরোলো পাম্পের এজেন্ট সহ ইয়াহিয়াদের আরো বেশকিছু ব্যবসা ছিল। এছাড়া সিঙ্গাপুরে তার এপার্টমেন্ট ও ব্যবসায়িক অফিস ছিল। 
দেশে ইয়াহিয়ার ব্যবসা:-
দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইয়াহিয়ার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রাম নগরীর নাসিরাবাদ এন. রহমানিয়া বনস্পতি অ্যান্ড ভেজিট্যাবল ওয়েল প্রাইভেট লিমিটেড, শাহাপুরি ডেইরি এন্ড ফুড প্রাইভেট লিমিটেড, সিমেন্ট ফ্যাক্টুরি, শাহপরী ফিশিং লিমিটেড, শাহপুরী হোল্ডিং, শাহপরী ইয়ার সার্ভিস, নবি ফুড ময়দা, নাসিরাবাদে কোমল পানীয় কারখানা, হোটেল ইউনাইটেড, জাহাজকাটা ইয়ার্ড-২, একটি ঔষুধ কারখানা ও সার্জিল স্টীল ইত্যাদি।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক চোরাচালানে বাংলাদেশের গডফাদার শিল্পপতি উক্ত আনিসুর রহমান ইয়াহিয়ার অজানা আরো চমকপ্রদ তথ্য এসেছে প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে। সেখানে তার সম্পদ, গাড়ি, অস্ত্র ও চোরাচালানে তার অন্যতম সহযোগিদের তথ্য উপাত্ত, তার ভাই মাফিয়া ডন শফির সাকা-বাবর-তারেক কানেকশন অপর ভাই ড. হাবিব কাহিনী, রাজস্ব ফাঁকি, সন্ত্রাস লালন-পালন, জঙ্গি সম্পৃক্ততা, রোহিঙ্গা কানেকশন সহ বিভিন্ন তথ্য রয়েছে। যা শীঘ্রই অনুসন্ধান শেষে প্রকাশিত হবে ধারাবাহিক ভাবে। চোখ রাখুন এই গণমাধ্যমে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন