ট্রাইব্যুনালের ৬ষ্ঠ রায়


বাংলানিউজ: একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রায় ৩ বছর চার মাসে ৫ম অভিযুক্তের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করলেন। সর্বশেষ ঘোষিত এ রায়ে বুধবার জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে।
২০১০ সালের ২৫ মার্চ গঠিত হয় প্রথম ট্রাইব্যুনাল। বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে গত বছরের ২২ মার্চ গঠিত হয় দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল। গঠনের পর প্রথম দু’বছর যুদ্ধাপরাধ মামলার বিচারের গতি শ্লথ থাকলেও গত বছর এ প্রক্রিয়া গতি পায়।

গত ৩ বছর চার মাসে ৬ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেছেন ট্রাইব্যুনাল। দুই ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছে বুদ্ধিজীবী হত্যায় অভিযুক্ত ২ জনসহ বিএনপি-জামায়াতের ৫ নেতা এবং আওয়ামী লীগের এক বহিষ্কৃত নেতার (জামায়াতের সাবেক রোকন) মোট ৫ মামলার। আরও ২ শীর্ষ জামায়াত নেতার মামলার বিচার শুরু হতে যাচ্ছে শিগগিরই। 

৪ ফাঁসি, ১ যাবজ্জীবন, গোলাম আযমের ৯০ বছর
এ পর্যন্ত দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধের ৪ মামলার রায় ট্রাইব্যুনাল-২ আর দুই অভিযুক্তের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেছেন ট্রাইব্যুনাল-১।

ঘোষিত ৬টি রায়ের মধ্যে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও পলাতক জামায়াতের সাবেক রোকন (সদস্য) আবুল কালাম আজাদ বাচ্চু রাজাকারকে ফাঁসি এবং জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমকে ৯০ বছর ও আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে।

সাঈদীর মামলার মাধ্যমে প্রথম ট্রাইব্যুনাল এবং বাচ্চু রাজাকারের মাধ্যমে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল বিচারিক কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। সাঈদীর মামলাটি ছিল ট্রাইব্যুনালের ১ নম্বর মামলা। অন্যদিকে ৫টি মামলা আইন অনুসারে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনক্রমে স্থানান্তরিত হয় ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ট্রাইব্যুনাল-২ এ।

৪টি মামলার মধ্যে ফাঁসির আদেশ দিয়ে বুধবার মুজাহিদ, গত ৯ মে কামারুজ্জামান ও ২১ জানুয়ারি বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দিয়ে ৫ ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনায়। ট্রাইব্যুনাল-১ ঘোষিত অন্য দু’টি রায় দেওয়া হয়েছে যথাক্রমে সোমবার ও গত ২৮ ফেব্রুয়ারি, যে দুই মামলায় গোলাম আযমের ৯০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ ও সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হয়েছে। 

৩ মামলা সুপ্রিম কোর্টে
কাদের মোল্লা ও সাঈদীর রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করেছেন রাষ্ট্র ও আসামি উভয়পক্ষই। কামারুজ্জামান তার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলেও রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করেননি।

রাষ্ট্রপক্ষ কাদের মোল্লার দণ্ড বাড়িয়ে সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি আর আসামিপক্ষ যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশ থেকে খালাসের আরজি জানিয়ে এ আপিল করেছেন। কাদের মোল্লার মামলায় গত ১ এপ্রিল থেকে উভয়পক্ষের আপিলের একসঙ্গে শুনানি শুরু হয়েছে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগে।

সাঈদীর মামলায় প্রমাণিত অভিযোগগুলোতে শাস্তি চেয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষ আর ফাঁসির দণ্ডাদেশ থেকে খালাসের আরজি জানিয়ে আপিল করেছেন আসামিপক্ষ। কামারুজ্জামানও আপিল করেছেন ফাঁসির দণ্ডাদেশ থেকে খালাস চেয়ে।

সাঈদী ও কামারুজ্জামানের মামলা আপিল শুনানি শুরুর দিন ধার্যের অপেক্ষায় রয়েছে।

বিচার চলছে আরও ৬ জনের
দুই ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছে বিএনপি-জামায়াতের আরও ৩ নেতা এবং আওয়ামী লীগের এক বহিষ্কৃত নেতার (জামায়াতের সাবেক রোকন)। শুরু হয়েছে বুদ্ধিজীবী হত্যায় অভিযুক্ত ২ জনের বিচারও, যাদেরকে একটি মামলায় আসামি করা হয়েছে।

বিচারাধীন মামলাগুলোর মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সংসদ সদস্য সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরীর মামলার বিচারিক কার্যক্রম এগিয়ে রয়েছে ট্রাইব্যুনাল-১ এ। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে, চলছে আসামিপক্ষের সাক্ষীদের সাফাই সাক্ষ্যগ্রহণ। তার বিরুদ্ধে সর্বমোট ৪১ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন আর তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া ৪ জন সাক্ষীর জবানবন্দিকেই সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল। অন্যদিকে সাকা চৌধুরী নিজেসহ তিনজন সাফাই সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আগামী ২১ জুলাই তৃতীয় সাফাই সাক্ষীর জেরার দিন ধার্য রয়েছে।

গত বছরের ৪ এপ্রিল সাকার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। এতে তার বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৩টি মানবতাবিরোধী অপরাধের উল্লেখ করা হয়। এসবের মধ্যে রয়েছে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ করে গুডস হিলে নির্যাতন, দেশান্তরে বাধ্য করা, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন অপরাধ।

ট্রাইব্যুনাল-১ এ জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। এ পর্যন্ত ১৩ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন এবং আগামী ২১ জুলাই ১৪তম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে। নিজামীর বিরুদ্ধে গত বছরের ২৮ মে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, লুট, ধর্ষণ, উস্কানি ও সহায়তা, পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ মোট ১৬টি ঘটনায় অভিযোগ এনে বিচার চলছে। 

অন্য অভিযুক্ত বিএনপির সাবেক নেতা সাবেক মন্ত্রী আব্দুল আলীমের বিচার চলছে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে। আলীমের বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তাসহ মোট ৩৪ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন এ পর্যন্ত। শিগগিরই সাক্ষ্য দেবেন ৩৫তম ও শেষ সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তা। গত বছরের ১১ জুন ৭ ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট ১৭টি অভিযোগে আব্দুল আলীমকে অভিযুক্ত করেন ট্রাইব্যুনাল।

বিচার শুরু হয়েছে আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা মোবারক হোসেনের, যিনি স্বাধীনতার পরে জামায়াতের রোকন ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, অপহরণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ৫টি অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা ও স্বাধীনতা পরবর্তীকালে জামায়াতের রোকন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোবারক হোসেন। গত ১৬ মে মোবারকের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন শেষে ২০ মে সাক্ষ্য দেওয়া শুরু হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের। এ পর্যন্ত ৬ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে এবং আগামী ২১ জুলাই ৬ষ্ঠ সাক্ষীকে আসামিপক্ষের জেরার দিন ধার্য রয়েছে। তার বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবেন ২১ জন।

বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলার বিচার শুরু
ট্রাইব্যুনালের আর একটি বড় অর্জন, ৪২ বছর পরে শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার শুরু করতে পারা।

রাষ্ট্রপক্ষের সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন শেষে এ দু’জনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন ২ সাক্ষী। বৃহস্পতিবার ১৮ জুলাই ২য় সাক্ষীর অসমাপ্ত জেরা অনুষ্ঠিত হবে। 

গত ২৪ জুন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রধান দুই খুনি আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছেন ট্রাইব্যুনাল-২।

গত ২৭ মে এ দু’জনকে পলাতক দেখিয়ে তাদের বিচার শুরুর নির্দেশ দেন এ ট্রাইব্যুনাল। আশরাফুজ্জামান ও মাঈনুদ্দীনের পক্ষে মামলা লড়ার জন্য ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে আব্দুস শুকুর খান ও সালমা হাই টুনিকে রাষ্ট্রীয় খরচে আইনজীবীও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

পলাতক আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দীন দু’জন অভিযুক্ত হয়েছেন ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ স্বাধীনতার উষালগ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষক, ৬ জন সাংবাদিক ও ২ জন চিকিৎসকসহ ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ করে নির্মম নির্যাতন শেষে হত্যার দায়ে। এতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট’৭৩ এর ৩/২ ধারা মোতাবেক অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যা ও গণহত্যা- এ ৫টি মানবতাবিরোধী অপরাধের ১১টি অভিযোগ আনা হয়। এ মামলায় মোট ৪৫ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।

বিচার শুরুর অপেক্ষায় আরও ২ মামলা
যে ২ জনের বিরুদ্ধে মামলা বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে তারা হচ্ছেন জামায়াতের সিনিয়র নায়েবে আমির আবুল কালাম মোহাম্মদ ইউসুফ ও জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাশেম আলী।

জামায়াতের সিনিয়র নায়েবে আমির একেএম ইউসুফের বিরুদ্ধে রোববার ১৪ জুলাই অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরু হয়েছে ট্রাইব্যুনাল-১ এ। রাষ্ট্রপক্ষ শুনানি শেষ করেছেন। ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার আসামিপক্ষের শুনানির দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।

গত ১২ মে ইউসুফের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে ওই দিনই গ্রেফতার করা হয় তাকে। ১৪ মে জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে জেলহাজতে পাঠানো হয় তাকে।

জামায়াত নেতা এ কে এম ইউসুফের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, ধর্মান্তরকরণ, বাড়ি-ঘর ও দোকানে লুটপাট, অগ্নিসংযোগের ১৫টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে আনুষ্ঠানিক অভিযোগে।

মুক্তিযুদ্ধকালে খুলনায় রাজাকার বাহিনী প্রতিষ্ঠা, ডা. মালেক মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে এবং পাকিস্তানি বাহিনীর সকল সহযোগী বাহিনীকে নেতৃত্ব দানের কারণে তিনি অভিযুক্ত হয়েছেন সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির (উর্ধ্বতন নেতৃত্ব) দায়েও।

ইউসুফের বিরুদ্ধে জব্দ তালিকার ৬ জন সাক্ষীসহ ৭১ জন সাক্ষী করা হয়েছে।

অন্যদিকে গত ২৬ মে গ্রেফতারকৃত জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য, দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের চেয়ারম্যান মীর কাশেম আলীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল-১। আগামী বৃহস্পতিবার ১৮ জুলাই অভিযোগ গঠনের শুনানির দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল। মীর কাশেম আলীর বিরুদ্ধে গত ১৬ মে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন প্রসিকিউশন। মীর কাশেমের বিরুদ্ধে হত্যা, আটক, অপহরণ নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও লাশ গুমের মোট ১৪টি অভিযোগ আনা হয়েছে। এর আগে গত ২৪ এপ্রিল তার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।

তদন্ত শেষ ২ মামলার
একাত্তর সালে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, ধর্মান্তরিতকরণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ১০টি অভিযোগে ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র জাহিদ হোসেন খোকন রাজাকারের বিরুদ্ধে গত ২৩ জুন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন প্রসিকিউশন। একই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন জানানো হয়েছে। এর আগে গত ২৯ মে তার বিরুদ্ধে ১৩টি অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে তদন্ত শেষ করে তদন্ত সংস্থা চিফ প্রসিকউটর বরাবর ৬০৭ পৃষ্ঠার তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। এর মধ্যে ১০টি অভিযোগ সন্নিবেশিত করে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়।

খোকন রাজাকারের বিরুদ্ধে মোট ১০টি অভিযোগ আনা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে, ১৬ জন নারী-শিশুসহ মোট ৫০ জন নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা, ঘরে আগুন দিয়ে ৩ জনকে হত্যা, ৮ জনকে গুরুতর আহত করা, ২ জনকে ধর্ষণ, ১৭ জনকে দুই দিন আটকে রেখে নির্যাতন, নয়জনকে ধর্মান্তরিত করা, ১০টি গ্রামে দুইটি মন্দিরসহ অসংখ্য বাড়ি-ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ, ৭ জন গ্রামবাসীকে তাদের বিবাহ যোগ্য কন্যা ও সন্তানাদিসহ দেশান্তরি হতে বাধ্য করা।

তদন্ত সংস্থার তদন্তকারী কর্মকর্তা সত্য রঞ্জন রায় ২০১২ সালের ১৬ এপ্রিল থেকে ২০১৩ সালের ২৯ মে পর্যন্ত জাহিদ হোসেনের বিরুদ্ধে তদন্ত চালান। তদন্তে ৭৮ জনের বেশি ব্যক্তির সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। তাদের মধ্যে ৫০ জনকে মামলার সাক্ষী করা হয়েছে। খোকন রাজাকার তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুর পর থেকেই পলাতক।

তদন্ত শেষ হয়েছে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে। গত ৯ জুলাই তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে আজহারের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে ৯ ধরনের ৬টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ ও সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির (উর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়) অভিযোগ আনা হয়েছে। আগামী ৩১ জুলাই আজহারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিলের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল-১।

তদন্তাধীন আরও ৯ মামলা
বর্তমানে তদন্ত চলছে আরও ৯ জনের বিরুদ্ধে। তাদের মধ্যে আটক আছেন ২ জন। যেসব আসামির বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলার তদন্ত কাজ চলছে তারা হলেন- জামায়াতের নায়েবে আমির আব্দুস সোবহান মিয়া, সাবেক প্রতিমন্ত্রী সাবেক এমপি সৈয়দ মোহাম্মদ কাওসার (হবিগঞ্জ), চট্টগ্রামের রাউজানের বিএনপি নেতা গিয়াসউদ্দিন কাদের গিকা চৌধুরী, যশোরের মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন, পিরোজপুরের জাতীয় পার্টি নেতা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল জব্বার, বাগেরহাটের সিরাজুল ইসলাম ওরফে সিরাজ মাস্টার, খুলনার আমজাদ মিনার, রাজশাহীর লাহার আলী শাহ ও আলবদর বাহিনীর উদ্যোক্তা জামালপুরের মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন। আটক আছেন সৈয়দ মোহাম্মদ কাওসার ও আব্দুস সোবহান মিয়া।

জামায়াতের নায়েবে আমির আব্দুস সুবহানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আগামী ১৯ আগস্ট দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল-১।

তদন্তাধীন মামলার আসামি গিয়াসউদ্দিন কাদের গিকা চৌধুরী হলেন সালাহউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরীর ছোট ভাই। সাকা চৌধুরী ও মীর কাসেম আলীর ব্যাপারে চট্টগ্রামে তদন্ত করতে গিয়ে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য গিকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ পান তদন্ত সংস্থা। অভিযোগের তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করতে তদন্ত সংস্থা গত মার্চে চট্টগ্রামের রাউজান ও সাকা চৌধুরীদের বাড়ি গুডস হিলে যান।

২০১১ সালে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর নেতৃত্বে একটি তদন্ত দল চট্টগ্রামের রাউজানে যান। সে সময় এলাকার লোকজন তদন্ত দলের কাছে সাকা চৌধুরী ও গিকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ধরেন। বিশেষ করে নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যার সঙ্গে সাকা চৌধুরীর পাশাপাশি গিকা চৌধুরীর সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ পাওয়া যায়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে এ ঘটনায় রাউজান থানায় একটি মামলাও হয়েছিল। নূতন চন্দ্র সিংহের ছেলে চিত্তরঞ্জন সিংহের দায়ের করা মামলায় মুসলিম লীগ নেতা সাবেক স্পিকার ফজলুল কাদের ফকা চৌধুরী, তার দুই ছেলে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ ১০ জনকে আসামি করা হয়।

অন্যদিকে রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা সাবেক মন্ত্রী খুলনার একেএম ইউসুফের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে গিয়ে তদন্ত সংস্থা বাগেরহাটের সিরাজ মাস্টার ও খুলনার রূপসা এলাকার আমজাদ মিনারের বিরুদ্ধে অভিযোগ পান। এরপর তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। সিরাজ মাস্টারের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের ২১ মে বাগেরহাট জেলার রামপাল থানার ডাকরা গ্রামে কালীমন্দিরে জড়ো হওয়া হিন্দু সম্প্রদায়ের তিন-চার হাজার নারী ও পুরুষের ওপর সশস্ত্র হামলার ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই ঘটনায় কিরণ চন্দ্র চক্রবর্তী, বেলা রানী মণ্ডল, মারুময় ব্যানার্জিসহ ছয়-সাত শ’ মানুষ শহীদ হন। একই জেলার কচুয়া থানার মঘিয়া গ্রামে ১৫ জনকে হত্যা ও শাঁখারিকাঠি গ্রামে ৪০ জনকে হত্যার সঙ্গেও তার সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে জানা গেছে। এসব ঘটনায় একেএম ইউসুফ প্রধান আসামি। তার সহযোগী হিসেবে সিরাজ মাস্টার এসব অপরাধে সম্পৃক্ত ছিলেন।

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় শান্তি কমিটির সহ সভাপতি, সাবেক সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার আবদুল জব্বারও মানবতাবিরোধী অপরাধে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে প্রমাণ মিলেছে। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত দল সম্প্রতি দ্বিতীয় দফায় তদন্তে এসে তার সম্পৃক্ত থাকার সত্যতা পেয়েছেন। তিনি মঠবাড়িয়ার সূর্যমণি গণহত্যার জন্য অভিযুক্ত। এছাড়া মঠবাড়িয়ার মেধাবী ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী গণপতি হালদার হত্যা ও উপজেলার হিন্দু অধ্যুষিত তুষখালী গ্রামের ৩৬০টি বাড়িতে আগুন লাগানোর ঘটনায় তার জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আবদুল জব্বার স্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধীদের সংগঠিত করেন। তার মদদে ও নির্দেশে শান্তি কমিটির নেতা ইস্কান্দার আলী মৃধার নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ৬ অক্টোবর রাতে মঠবাড়িয়ার সদর ইউনিয়নের আঙ্গুলকাটা গ্রামের মিস্ত্রিবাড়ি ও হালদারবাড়িতে ৬০-৬৫ জন সশস্ত্র রাজাকার হানা দিয়ে ৩৭ জন হিন্দু লোককে ধরে নিয়ে যায়। সাতজনকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিয়ে বাকি ৩০ জনকে সূর্যমণি বেড়িবাঁধে নিয়ে গুলি করা হয়। গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে ২৪ জন শহীদ হন। ভাগ্যক্রমে ছয়জন বেঁচে যান।

ওই ঘটনায় বেঁচে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা জ্ঞানেন্দ্র মিত্র (৬২) বাদী হয়ে আবদুল জব্বার এবং ৬০-৬৫ জন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে আসামি করে মঠবাড়িয়া সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি দায়ের করেন।

আলবদর বাহিনীর উদ্যোক্তা মোহাম্মদ আশরাফ হোসেনের বিরুদ্ধেও তদন্ত শুরু হয়েছে। জামালপুরে আলবদর বাহিনী গঠন করে মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যা চালানোর অভিযোগ রয়েছে আশরাফের বিরুদ্ধে। আশরাফ মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে ময়মনসিংহ ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিলেন। এরপর তিনি জামালপুরে আলবদর বাহিনী গঠন করেন। তার এই আলবদর বাহিনীই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আশরাফের পর কামারুজ্জামান ময়মনসিংহ ছাত্রসংঘের সভাপতি নির্বাচিত হন।

আরও যাদের ব্যাপারে তদন্ত চলছে তারা হলেন খুলনার মো. আমজাদ মিনার ও রাজশাহীর মো. লাহাব আলী শাহ এবং বাগেরহাটের সিরাজুল ইসলাম ওরফে সিরাজ মাস্টার। তদন্ত সংস্থা এসব ব্যক্তির ব্যাপারে তদন্তের জন্য চট্টগ্রাম, পিরোজপুর, পাবনাসহ বিভিন্ন অভিযোগ-সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিদর্শন করেছে। ওই সব স্থানের একাধিক গণকবর ও বধ্যভূমির ছবি তোলা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ও নির্যাতিতদের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

তবে তদন্ত শুরু না হওয়া মামলার সংখ্যা এর কয়েকগুণ। দেশের সাতটি বিভাগ থেকে আসা এসব মামলার সংখ্যা মোট পাঁচশ’ ৫৭টি। এসব মামলার আসামির সংখ্যা তিন হাজার একশ’ ৫৫ জন।

চলছে দ্বিতীয় পর্বের বিচার
ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলাগুলো থেকে ইতোমধ্যে ছয়টির রায় হয়েছে। সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে আরো পাঁচটি। এগুলোর মধ্যে ৩টি মামলা বিচারিক প্রক্রিয়ার শেষ বা যুক্তিতর্কের পর্যায়ে যাচ্ছে শিগগিরই। যুক্তিতর্কের জন্য ট্রাইব্যুনালও বেশি সময় নষ্ট করতে রাজি নন। মামলাগুলোর গতি প্রকৃতি দেখে ওই তিন মামলার রায় আগস্ট মাসের মধ্যে আসতে পারে বলে ধারণা করছেন প্রসিকিউশন। এর মধ্য দিয়ে আগামী নির্বাচনের আগেই ৯টি মামলার সমন্বয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের প্রথম পর্বের সমাপ্তি হতে পারে।

তবে ইতোমধ্যেই দ্বিতীয় পর্বে শুরু হয়েছে বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলাসহ ২ মামলার বিচারিক কার্যক্রম। তদন্তাধীন আরও কয়েকটি মামলাও শিগগিরই আদালতে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে।

৬টি রায়ের পর ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলোতে আরও গতি আনতে প্রসিকিউশনও বদ্ধপরিকর। প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বাংলানিউজকে বলেন, ৬টি রায়ের পর ট্রাইব্যুনালে মামলার চাপ অনেকাংশেই কমে গেছে। কাঙ্ক্ষিতভাবে গতি-প্রকৃতি অনুযায়ী বিচারাধীন বাকি ৩ মামলার রায় আগস্ট মাসের মধ্যে পাওয়া যেতে পারে।

প্রসিকিউশন জানিয়েছেন, রায় ঘোষিত ৬ মামলা ও বিচারাধীন ৩ মামলা অর্থাৎ শীর্ষ ৯ যুদ্ধাপরাধীর মামলাগুলোকে প্রথম পর্বের ধরা হয়।

অন্যদিকে বিচার শুরু হওয়া ও বিচার শুরুর অপেক্ষায় থাকা এবং তদন্তাধীন অন্য মামলাগুলোকে দ্বিতীয় পর্যায়ের মামলা ধরে সেগুলোতে জোর আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি চলছে।