কে হচ্ছেন আগামিদিনের রাষ্ট্রনায়ক?- হাসিনা-খালেদা নাকি তৃতীয়পক্ষ

ডেস্ক রিপোর্ট
ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের আর মাত্র ছয় মাস বাকি। বিদায়ের আগ মুহূর্তে চরম জনপ্রিয়তা সংকটে পড়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। সম্প্রতি সবচেয়ে বড় সিটি করপোরেশন গাজীপুরসহ দেশের ৫ সিটির স্থানীয় নির্বাচনে ধবলধোলাই হয়েছে ক্ষমতাসীন জোট।
স্থানীয় এসব নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়কে বিরোধীরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে রায় বলে দাবি করছে। ফলে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই নির্বাচন দেয়ার জোর দাবি উঠেছে। বিরোধী জোটের দাবি-সরকারকে অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা বলছেন, সময়ের একদিন আগেও ক্ষমতা ছাড়া হবে না।
মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ক্ষমতা ছাড়ার নজির বাংলাদেশের ইতিহাসে নেই। বরং ক্ষমতাকে কীভাবে আকড়ে ধরে রাখা যায় সে চেষ্টাই করেছে প্রতিটি সরকার। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তখন তাদের নীতি-ই হচ্ছে, কীভাবে প্রতিটি নির্বাচনে নিজেদের সমর্থিত প্রার্থীর বিজয় হবে সে ব্যবস্থা করা। অবশ্য আওয়ামী লীগ সরকার এবার ক্ষমতায় এসে এর কিছুটা ব্যতিক্রমও দেখা গেছে। দেশের সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে বিরোধী জোট সমর্থিত প্রার্থীদের বিজয় হচ্ছে এই ব্যতিক্রম। 
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার। অবশ্য এই দলটিই এক সময় তত্ত্বাবধায়ক বাতিলের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। এবার ক্ষমতায় আসার আগে তত্ত্বাবধায়ক প্রধান কে হবেন, তা নিয়েও দেশজুড়ে সৃষ্টি করেছিল এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি। গোটা দেশের মানুষ ভুগছিল লগি-বৈঠা আতঙ্কে। এক পর্যায়ে তত্ত্বাধায়ক প্রধান হন সাবেক বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফখরুদ্দিন আহমদ। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি কঠোর পদক্ষেপ নেন। দেশের প্রধান দুই নেত্রী হাসিনা ও খালেদাকে জেলে নেন। এভাবে দেশের পরিস্থিতি শাšত্ম হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন না দিয়ে সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়ে দুই বছরেরও বেশি সময় অঘোষিত সেনা শাসনে চলে দেশ। শঙ্কিত হয়ে পড়ে জাতি। অবশেষে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় হ¯ত্মাšত্মর হয়। ক্ষমতায় আসে ১৪ দলীয়  মহাজোট সরকার।

কিন্তু এই মহাজোট সরকার এসে অতীতের অভিজ্ঞতার দোহাই দিয়ে বাতিল করে বহু আন্দোলনের ফসল তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা। এবার এই তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে নড়েচড়ে বসে এক সময়ের এই ব্যবস্থার ঘোর বিরোধী দল বিএনপি। এ ব্যবস্থার দাবিতে সঙ্গে আরো ১৭ দলকে নিয়ে গড়ে তোলে ১৮ দলীয় জোট। তাদের পরিষ্কার বক্তব্য হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবে না।

সরকারি দলও তাদের অবস্থানে অনড়। তত্ত্বাবধায়কে আর কখনোই ফিরতে চায় না তারা। তাদের দাবি, মহাজোট সরকারের আমলে স্থানীয় ও উপনির্বাচনসহ দেশে সাড়ে ৫ হাজারেরও বেশি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয়েছে। সুতরাং তত্ত্বাবধায়কে ফিরতে তারা কিছুতেই রাজি নয়। আর বিরোধী দল বলছে স্থানীয় নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচন এক নয়। এমনকি সরকার আদালতের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গে দেয়া রায়ের নির্দেশনা মানছে না বলে বিরোধীদল দাবি করছে। ওই নির্দেশনায় অšত্মত আরো দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়কের অধীনেই হতে পারে বলে বলা হয়েছিল। 

ক্ষমতাসীন ও বিরোধী জোটের বিপরীতমুখী অবস্থানে উত্তপ্ত দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। আগামী বছর দেশে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় নির্বাচন। ইতোমধ্যে এ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন দলের মধ্যে ঐক্যজোট গঠন করা হচ্ছে। বর্ষীয়ান রাজনীতিক কর্নেল অলি আহমদ বিএনপি ছেড়ে নিজেই একটি দল গঠন করেন। দলটির নাম এলডিপি।  তিনি একবার বলেছিলেন, এলডিপি বিএনপির ত্রাস। ওই সময় তিনি জিয়া পরিবারের পরিবারতন্ত্র ও দুর্নীতির কথা তুলে ধরেন। কিন্তু সেই অলিই আবার বিএনপির সান্নিধ্যে আসছেন। 

বিএনপির নিবেদিত প্রাণ অধ্যাপক বি চৌধুরী। বিএনপি সরকারের আমলে রাষ্ট্রপতি ছিলেন। কোনো কারণ ছাড়াই তাকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। পরে তিনি বিকল্প ধারা নামে একটি সংগঠন করে তোলেন। আবার কিছু চাওয়া আর পাওয়ার আশায় তিনিও ফিরে এসেছেন বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটে।

এদিকে সময় বুঝে এখন এরশাদও পাঁয়তারা করছেন বিএনপির সঙ্গে ঐক্যজোট করতে। মাঝে মধ্যেই মহাজোট ছাড়ার ঘোষণা দিচ্ছেন। গাজীপুর সিটি নির্বাচনের আগে রীতিমতো নাটক তৈরি করলেন। বললেন, আমি কাউকে সমর্থন করি না। পরে বিএনপি সমর্থিত মান্নান তার সঙ্গে দেখা করলে তাকে সমর্থন দেন এরশাদ। স্থানীয় নেতারাও মান্নানের পক্ষেই নির্বাচনী প্রচারণা চালায়। কিন্তু নির্বাচন ঘনিয়ে আসলে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে এরশাদ ঘোষণা দেন, যেহেতু এখনো মহাজোটে আছি, সুতরাং মহাজোট সমর্থিত প্রার্থীকেই সমর্থন করছি। কিন্তু তার এ সমর্থন ছিল কার্যত অচল। কারণ, স্থানীয় নেতারা ঘোষণা দেয়, এরশাদ মহাজোট সমর্থিত প্রার্থীকে সমর্থন দিলেও তারা বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট সমর্থিত মান্নানের পক্ষেই কাজ করবেন। এভাবে হাওয়া বদলানোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে।

অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করছেন, বিগত বিএনপি সরকার এরশাদকে বিভিন্ন মামলা দিয়ে ৫ বছর জেলে ঢুকিয়ে রেখেছিল এবং জিয়া হত্যার সঙ্গে জড়িয়েছিল। যেহেতু ক্ষমতাসীন ১৪ দল জোট সরকারের ভাবমূর্তি বর্তমানে খুব একটা ভাল নয়। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতায় আসতে পারে এমন আশঙ্কায় নিজের গা বাঁচাতে সময় বুঝে এখন বিএনপির সঙ্গে আঁতাতের চেষ্টা করছেন এরশাদ। অবশ্য বেগম রওশন এরশাদসহ জাতীয় পার্টির বেশ কয়েকজন নেতা জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গেই থাকার পক্ষেই জোর দিচ্ছেন। তবে যেকোনো মুহূর্তে অঘটন ঘটাতে পারে এরশাদ।

এর বাইরে এককভাবে নির্বাচনে যাওয়ার কথা বলছেন এরশাদ। কোনো জোটে না থেকে এককভাবেই নির্বাচন করতে চান তিনি। তিনি একবার বলেছিলেন, জাতীয় পার্টি আর কারো ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হতে চায় না। এবার এককভাবে নির্বাচন করব আমরা। তবে এক্ষেত্রেও ঝুঁকি রয়েছে। কারণ, দেশের প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় দলের সাংগঠনিক অবস্থা তেমন ভাল নয়, বরং বেশ কিছু স্থানে রয়েছে দলীয় কোন্দল। ফলে এটিও খুব একটা সুবিধাজনক হবে বলে মনে হচ্ছে না।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করে। এ বিচার প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে দেশে চলে রাজনৈতিক অস্থিরতা। বিশেষ করে জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হুসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পর দেশব্যাপী যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তাতে গোটা দেশে সরকারের ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষুণœ হয়।

এরপর আবার যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের ইসলাম অবমাননাকর বক্তব্যে গরম হয়ে উঠে হেফাজতে ইসলাম। তারা ইসলাম অবমাননার বিরুদ্ধে আন্দোলনের অংশ হিসেবে গত ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশ করে এবং কিছু দাবি-দাওয়া তুলে সেখানে অবস্থান নেন হেফাজত নেতাকর্মীরা। এরশাদসহ বিএনপির নেতারা ঐ আন্দোলনে সমর্থন দেন।

পতনের ভয়ে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়। গভীর রাতে অন্ধকারে অভিযান চালিয়ে হেফাজত নেতাকর্মীদের শাপলা চত্বর থেকে হটিয়ে দেয়া হয়। গুজব ওঠে- কয়েক হাজার হেফাজত নেতাকর্মী নিহত হয়েছে। দেশব্যাপী জনমনে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

এর আগে গত ২৪ এপ্রিল সাভারে ধসে পড়ে রানা প্লাজা। নিহত হয় হাজারেরও বেশি শ্রমিক। আহতাবস্থায় জীবিত উদ্ধার হয় আড়াই হাজারের বেশি শ্রমিক। যাদের অনেকেই হাত-পা হারিয়ে আজ অসহায়। এখনো নিখোঁজ রয়েছে তিন শতাধিক। এ ঘটনায় সরকারের ভাবমূর্তি যখন ব্যাপক ক্ষতিগ্র¯ত্ম, তখনই হেফাজত আন্দোলন। এক রকম বিপাকে পড়ে যায় ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার। 

এমন সংকটপূর্ণ মুহূর্তে আবির্ভাব হয় রেশমা নাটকের। ১৭ দিন পর ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয় তাকে। গোটা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে এ ঘটনা। রেশমাকে দেয়া বিস্ময়কন্যার খ্যাতি। কিছুটা চাপা পড়ে শাপলা অভিযানে নিহত হেফাজতকর্মী হত্যা ও সাভারে ভবন ধসে হাজারো নিহতের মর্মাšিত্মক ঘটনা।

কিন্তু দু’ াস যেতে না যেতেই বিস্ফোরণ ঘটে। দেশের বাইরে দুটি পত্রিকায় প্রচার হতে থাকে রেশমা উদ্ধার ঘটনা ছিল সাজানো নাটক। আবারো ভাবমূর্তি সংকটে পড়ে সরকার। এভাবে একের পর এক ইমেজ সংকটে বর্তমানে ভীষণ চাপে পড়েছে মহাজোট সরকার।

একে তো হেফাজত আন্দোলনে কুপোকাত বর্তমান সরকার। যার অকাট্য প্রমাণ সম্প্রতি দেশের ৫ সিটি নির্বাচন। সবগুলোতেই বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট সমর্থিত প্রার্থীর কাছে ধরাশায়ী হয়েছে ক্ষমতাসীন জোট। বিপুল ভোটে পরাজিত হয়েছে সরকার সমর্থিতরা।

পাশাপাশি এ বিজয়কে তত্ত্বাবধায়কের পক্ষে জনগণের রায় বলে দাবি করছে বিরোধী দলীয় জোট। অবশ্য সম্প্রতি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার একটি জরিপে বলা হয়েছে, দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে। বিদেশি পর্যবেক্ষকসহ বিভিন্ন প্রতিনিধি দল ও সংগঠনও সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা বলছে।

কিন্তু সরকার বলছে, ইউরোপীয় দেশগুলোর মত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন। সরকারের দাবি- নির্বাচন করে নির্বাচন কমিশন, সরকার নয়। বর্তমান নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী ও স্বাধীন। সুতরাং এই কমিশনের অধীনে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হওয়া সম্ভব। এই যুক্তিতে তারা আর কিছুতেই তত্ত্বাবধায়কে ফিরতে রাজি নয়।

কিন্তু বিরোধীদল বলছে, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাদের মতে- নির্বাচন সুষ্ঠু হলো কিনা তা পরের কথা। কত শতাংশ মানুষ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে এটাই বড় বিষয়। যেহেতু দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ তত্ত্বাবধায়কের পক্ষে। সুতরাং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে মানুষের স্বতঃস্ফূূর্ত উপস্থিতির প্রশ্নই আসে না।

সুতরাং বিরোধী দলীয় জোট দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠেয় নির্বাচন বয়কট করলে দেশের বেশির ভাগ জনগণ ভোট দেয়া থেকে বিরত থাকবে। ফলে এ নির্বাচনও ’৯৬ সালের বিএনপির একক নির্বাচনের মতই হবে ব্যর্থ একটি নির্বাচন। বিশ্ব এই নির্বাচন গ্রহণ করবে কী না, সেটাও একটি বড় বিষয়। এতে পরিস্থিতি জটিল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অস্থির হয়ে উঠতে পারে রাজনৈতিক অঙ্গন। অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে গোটা দেশে। এমন পরিস্থিতিতে তৃতীয়পক্ষ ক্ষমতায় আসার সুযোগ পাবে, যা দেশের গণতন্ত্রের জন্য হুমকি।