বেরিয়ে আসছে সাগর পথের আদম দালালদের আরো কুকীর্তি : ফতুর হচ্ছেন মানুষ

ফরিদুল মোস্তফা খান: পাসপোর্ট ভিসা ছাড়া মানুষ ছুটছে সাগর পথে মালয়েশিয়ায় শিরোনামে সংবাদ প্রকাশের পর বেরিয়ে আসতে শুরু করছে এই চক্রে জড়িত দালাল চক্র কর্তৃক সাধারণ যাত্রীদের জীবন-মরণ নিয়ে অভিনব প্রতারণার হরেক তথ্য। শুধু তাই নয়, সাগর পথে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমানোর কাজে জড়িত এই দালাল চক্র কিভাবে নিরহ মানুষদের জিম্মি করে তার শেষ সহায়-সম্বল ভিটে-বাড়ি বিক্রির টাকা আত্মসাত করে তারও এক ভয়াবহ চিত্র ভেসে উঠেছে অনুসন্ধানে। জানা গেছে, দালাল চক্র প্রথমে সম্পূর্ণ বিনা পয়সায় মালয়েশিয়ায় পৌঁছিয়ে দিয়ে তারপর টাকা নেয়ার ফন্দি আটকিয়ে যাত্রী সংগ্রহ করেন। এরপর তাদেরকে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে টেকনাফ ও কক্সবাজারের বিভিন্ন জলসীমানা দিয়ে নির্ধারিত কাঠের নৌকায় তুলেন। গাদা-গাদি করে এক সাথে আটার বস্তার মতো অবুঝ এইসব মালয়েশিয়া যাত্রীদের কাঠের নৌকায় ভরে রাতের অন্ধকারে গভীর বঙ্গোপসাগরে রওনা দেন দালালরা। এক পর্যায়ে রাতের পর রাত, দিনের পর দিন গভীর বঙ্গোপসাগরের জল সীমানায় যাত্রীদের ঘুরিয়ে ৫/৭ দিন পর দালাল চক্র সাধারণ মালয়েশিয়া যাত্রীদের নিয়ে হাজির হন থাইল্যান্ডের গহীন অরণ্যে। এরপর সুচতুর দালাল চক্র তাদের সাথে যাওয়া লোকজনদের কাছ থেকে নিকট আত্মীয়দের মোবাইল/টেলিফোন নাম্বার সংগ্রহ করে যোগাযোগ করেন। শুরু হয় দালাল চক্রের প্রতারণার প্রথম পর্ব।
জানা গেছে, থাইল্যান্ডের গহীন অরণ্য থেকে সর্বপ্রথম দালালরা তাদের সাথে যাওয়া লোকজনদের নিকট আত্মীয়দের সাথে কথা বলিয়ে দেন এবং শিখিয়ে দেন কোন চিন্তা নেই। তারা মালয়েশিয়ায় পৌঁছে গেছেন। অতএব দালালদের মনোনীত অন্য দালালদের কাছে যেভাবেই হোক ১ লাখ ৮০ থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত পরিশোধ করতে হবে।
সূত্র জানায়, মুঠোফোনে অপরপ্রান্ত থেকে স্বজনদের কণ্ঠ পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে সহজ-সরল আত্মীয়-স্বজনরা এবার ভিটে-বাড়ি বিক্রি ও নিজের শেষ সহায়-সম্বল বন্ধক রেখে টাকা জোগাড় করে দালালদের মনোনীত ব্যক্তির কাছে অথবা তাদের একাউন্টে সরাসরি জমা করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য মানুষ নামের সাগর পথে এই দালাল নরপশুদের নাটক এখানেই শেষ না, তারা টাকা পেয়েও এবার অস্বীকার করে বসে থাকেন। এরপর সাথে নিয়ে যাওয়া হতভাগ্য ওই মালয়েশিয়া যাত্রীর উপর শুরু হয় নির্মম নির্যাতন। হাত-পা লোহার ছিকল দিয়ে বেঁধে ক্ষেত্রবিশেষ অস্ত্র ঠেকিয়ে তাদেরকে পুনরায় বাধ্য করান বাংলাদেশে থাকা স্বজনদের কাছে আরেকবার ফোন করে তাদের কথা মত টাকা পরিশোধ করে ছাড়িয়ে নিতে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, সাগর পথের দালাল চক্রের নিষ্ঠুরতা এখানেও শেষ না, তারা সর্বশেষ চেষ্টা করে আরো কিছু টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিতে পারলে তো ভাল, না পারলে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া সহজ-সরল ওই মালয়েশিয়া যাত্রীটিকে বাৎসরিক ও মাসিক সিস্টেমে অন্য দালালদের হাতে তুলে দেন। এক্ষেত্রে যারা দালালদের কথার অবাধ্য হন তাদের অনেককেই নিষ্ঠুর এই নরপশুরা প্রাণে হত্যা করেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, যারা দালালদের কথা মতো অন্য দালালদের হাতে চলে না যান তাদেরকে পুনরায় কাঠের নৌকায় তুলে বঙ্গোপসাগরে বিশাল জলরাশিতে নিক্ষেপও করা হয়।
ওয়াকিবহাল সূত্র জানায়, শুধু এভাবেই নয়, সাগর পথে মালয়েশিয়ায় আদম পাচারে জড়িত দালাল চক্রের সদস্যরা মাঝে মাঝে সাধারণ যাত্রীদের টেকনাফ থেকে তুলে কয়েকদিন সাগরে ঘুরিয়ে কক্সবাজার নাজিরারটেক, খুলনা, সুন্দরবন, কুতুবদিয়াসহ বিভিন্ন উপকূলে নামিয়ে দিয়ে বলেন, এবার তোমরা নাম এটাই মালয়েশিয়া। সাম্প্রতিক সময়ে কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক উপকূলে দালালরা নামিয়ে দিয়ে যাওয়া বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ, শিশুর সাথে এই প্রতিবেদকের দেখা হয়। তারা বলেন, ভাই আপনি কি বাঙ্গালী? উত্তরে এমন প্রশ্ন কেন করলেন জানতে চাইলে এসব খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ পাল্টা প্রশ্ন করেন আপনি কতদিন ধরে মালয়েশিয়ায় আসছেন। এরপর প্রতিবেদকের বুঝতে বাকি রইল না, নিশ্চয়ই এরা দালালের খপ্পরে পরে মালয়েশিয়া মনে করে এদিক দিয়ে আসছেন। তাই প্রতিবেদক ওই সমস্ত নারী, পুরুষ ও শিশুদের বোঝাতে চেষ্টা করলেন এটা মালয়েশিয়া নয়, এটা হচ্ছে কক্সবাজারের নাজিরারটেক। প্রতিবেদকের মুখ থেকে এই কথা শুনার পর হাউমাউ করে এসব যাত্রীরা বিলাপ ধরে কাদতে শুরু করলেন। বড় বড় তাদের নিঃশ্বাস আর চোখের পানির সাথে প্রতারিতরা বলতেই লাগলেন বাপরে-মারে দালালরা আমাদের সব টাকা-পয়সা লইয়া মালয়েশিয়া কইয়া এই কোথায় নামিয়ে দিল? আমরা এখন কি করব? ও আল্লাহ আমরা এখন কি করব?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন