সংলাপ : কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না

আজমল হক হেলাল
দেশের রাজনীতিতে অবিশ্বাস প্রকট হয়ে উঠছে। কিছুতেই পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস রাখতে পারছে না দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। অবিশ্বাস দানা বেঁধেছে খোদ দল দুটির ভেতরেও। নানা কর্মকান্ডে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি বিরক্ত দেশের সুশীল সমাজ ও বিদেশী কুটনীতিকরাও। ফলে সংলাপ নিয়ে দেখা দিয়েছে চরম অনিশ্চয়তা।


বিশেষ করে বিএনপির সংলাপের ডাক দেওয়ার পরও হরতাল আহ্বান- একদিকে যেমন আওয়ামী লীগের প্রতি বিএনপির অবিশ্বাস প্রকাশ্য হয়ে গেল, তেমনি আশঙ্কা আরো বেশি জোরালো হলো রাজনৈতিক সংঘাতের।

রাজনীতিক, রাজনীতি বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, দিন যত যাচ্ছে, সংলাপের সম্ভাবনা তত বেশি অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। সরকার ও বিরোধী দল নিজ নিজ দাবিতে অনঢ় থাকায় ও কেউ কারো জায়গা থেকে ন্যূনতম ছাড় না দেওয়ায় সংলাপ হবে না বলেই মনে হচ্ছে। অথচ সংলাপ না হলে সমঝোতা আসবে না। আর সমঝোতা না এলে নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে রাজনীতি ততই সংঘাতময় হয়ে উঠবে। 

সংলাপ নিয়ে সর্বশেষ আশা জাগে গত বৃহস্পতিবার। সেদিন নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছাতে সরকারকে সংলাপের বসার আহ্বান জানায় বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। কিন্তু সে আহ্বানের সাড়া না দেওয়ায় মাত্র ২৪ ঘন্টার মধ্যে বেঁকে বসে জোট। আওয়ামী লীগের প্রতি চরম অবিশ্বাস থেকে সকাল সন্ধ্যার হরতালের ডাক দেয় শুক্রবার। চলে যায় সংঘাতের রাজনীতিতে। এ নিয়ে সংলাপের ব্যাপারে অবিশ্বাস দাঁনা বাধে খোদ বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর। এই হরতালের মধ্য দিয়ে প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়লো রাজনৈতিক সংঘাত নিরসনে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ সম্ভাবনা। 

বৃহস্পতিবার যদিও সংলাপের ডাক দিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু নির্বাচনকালীন সময়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে ছিল অনঢ়। অনুরুপভাবে নির্বাচিত সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনের দাবিতে অনঢ় আওয়ামী লীগ বিএনপির সে ডাকের প্রতি ভ্রুক্ষেপও করেনি। উল্টো নিজেদের দাবি পুনরুচ্চারণ করে সেদিনই তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের মুখপাত্র ও মন্ত্রী ড. হাছার মাহমুদ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আলাপ আলোচনার সুযোগ নেই। দেশের সংবিধান ও সংসদের রীতি অনুযায়ি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিয়মানুযায়ি তিনিই অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব পালন করবেন। একই সঙ্গে তিনি সংলাপের নামে বিএনপির সরকার উৎখাতে ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম,হেফাজতকে তান্ডবে উস্কানি দেওয়া এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করাসহ বিভিন্ন অবিশ্বাসের ঘটনা তুলে ধরেন। সর্বশেষ গতকালও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে অনুষ্ঠিত এক সভায় বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে সংসদে এসে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালীর সরকার ব্যবস্থা নিয়ে কোন কথা বলেননি।

অন্যদিকে, রাজনৈতিক সংঘাত নিরসনে দেশের মানুষ যখন সংলাপের কথা ভাবছেন, ঠিক তখনই গত ১৯ মে রবিবার থেকে সব ধরনের সভা সমাবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সরকার। এর মধ্য দিয়ে সংলাপ সম্ভাবনা আরো বেশি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে বলে অভিমত প্রকাশ করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রশ্নে কিছুতেই বিরোধী দলের দাবি মেনে নেবে না সরকার। তাই দাবি আদায়ে বিরোধী দল যাতে কোনো বিভিন্ন কর্মসূচীর নামে সহিংসতা করতে না পারে, তাই সরকার এমন নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আপাততঃ নাকচ হলো সংলাপের সম্ভাবনাও।

দেশের রাজনৈতিক সংকট নিরসনে প্রধান দুই দলের শীর্ষ দুই নেত্রীর মধ্যে সংলাপ নিয়ে আলোচনা চলছে প্রায় বছর জুড়েই। সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন মহল থেকেই বার বার আহবানও জানানো হচ্ছে। এমনকি রাজনৈতিক সংকট নিরসনে দুই নেত্রীর মধ্যে সংসদে এবং সংসদের বাইরে রাজনৈতিক সংলাপ অনুষ্ঠানের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে সম্প্রতি রুলও জারি করেছে হাইকোর্ট। নানা উদ্যোগ নেয় বিভিন্ন মহল। সাবেক প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় পাটির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেন, আমি দুই নেত্রীকে চিঠি দিয়ে সংলাপের আমন্ত্রন জানিয়েছি। তাদের আহ্বান করেছি সংলাপে বসার জন্য। সংলাপ ছাড়া সংকট নিরসনের কোন বিকল্প নেই। একইভাবে গত সপ্তাহে সংলাপে বসা ও সংলাপ আয়োজনে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া, বিভিন্ন রাজনীতিক, বিশিষ্ট নাগরিক ও বিদেশী কুটনীতিকদের চিঠি দিয়েছেন সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা। কিন্তু কোন উদ্যোগে সাড়া মেলেনি কোনো পক্ষ থেকেই।

সংলাপ নিয়ে বিরক্ত বিশিষ্ট নাগরিক ও বিদেশী কুটনীতিকরাও। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আবকর আলী খান বলেছেন, সংলাপের জন্য কিছু ছাড় দিতে হবে। কিছু গ্রহণ করতে হবে। বদলাতে হবে মানসিকতা। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হচ্ছে। যদি তাই হয়, তা হলে নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নির্ধারণে প্রয়োজনে জনমত যাচাইমূলক গণভোটও আয়োজন করা যেতে পারে। কারণ বর্তমানে দু’দলই নিজেদের অবস্থানে অনড় থেকে যেভাবে সংলাপের কথা বলছে, তাতে সংলাপ হওয়ার সম্ভবনা খুবই ক্ষীণ। সংলাপ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ পেয়েছে দেশে নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনারও কণ্ঠে। চলতি সপ্তাহে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, দেশের (বাংলাদেশ) সংকট নিজেদেরই সমাধান করা উচিত। বিশিষ্ট আইনবিদ ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, বিভিন্ন মহল থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের কথা বলা হলেও প্রধান দুই দলের শীর্ষ দুই নেত্রীর মধ্যে আলোচনায় বসার কোনো মানসিকতাই দেখা যাচ্ছে না। বক্তৃতায় একজন সংলাপের আহবান জানালে পরক্ষণে আরেকজন তা নানা শর্তজুড়ে দিয়ে নাকচ করে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। এ অবস্থায় বর্তমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে আপাতত কোনো পথ দেখা যাচ্ছে না। কারণ ক্ষমতার লোভে প্রধান দুই দলই ভোটের হিসেব নিকেশ নিয়ে ব্যস্ত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরেক উপদেষ্টা ও সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজনের সভাপতি হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র মধ্যে যে দা-কুমড়ো সম্পর্ক তাতে সংলাপের কোনো সম্ভবনা জাতি দেখতে পাচ্ছে না। আমার মনে হচ্ছে সংলাপ শেষ পর্যন্ত আলোচনার মধ্যেই থেকে যাবে। বাস্তবে রূপ নেবে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন