ঈদ উপলক্ষে শতকোটি টাকার ইয়াবা পাচারের আশঙ্কা

সেবন ও বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ছে কক্সবাজারের শতাধিক পুলিশ সদস্য

ফরিদুল মোস্তফা খান: খোদ কক্সবাজারে কর্মরত প্রায় শতাধিক পুলিশ সদস্য ভয়ংকর মাদক ইয়াবা সেবন ও বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ছে। শুধু তাই নয়, এই চক্রে সীমান্ত শহর টেকনাফ ও কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে আগে কর্মরত ছিলেন, এখন বদলি হয়ে অন্য জেলায় চাকরি করেন সেরকম অগণিত পুলিশ সদস্যের নাম পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে পুলিশের এক শ্রেণির বিপথগামী
ওসি, এসআই, এএসআই ও কনস্টেবল পদমর্যাদার পুলিশ সদস্যরাও রয়েছে। জানা গেছে, রক্ষকের সরকারি কর্মে নিয়োজিত এসব ভক্ষকদের তালিকায় বাদ পড়েননি বর্তমানে কক্সবাজার জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখা ডিবি ও বিভিন্ন থানায় কর্মরত অগণিত দূর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্যের নাম। তবে টেকনাফ থানায় কর্মরত বর্তমান ওসি ফরহাদের ঐকান্তিক সততার কারণে ওই থানায় এখন সেরকম কোন দুষ্ট পুলিশ সদস্য আছে তা তদন্তে ওঠে আসেনি।
উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, রাতারাতি বিপুল বিত্ত বৈভবের মালিক হওয়ার নেশায় কক্সবাজার জেলায় দিন দিন ইয়াবা সেবন ও বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়া পুলিশ সদস্যের পাশাপাশি কিছু অসৎ বিজিবি সদস্যসহ অন্যান্য ব্যবসায়ীরা ক্রমশ এর তালিকা দীর্ঘ করছে। আকারে ছোট, বিক্রিতে প্রচুর দাম, সেবনে মুখে কোন দূর্গন্ধ নেই সহ নানা যৌক্তিক কারণে মুহুর্তেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দূর্নীতিবাজরা এতে জড়িয়ে পড়ছেন। রাতারাতি স্বর্গবিলাসে এই পথে যারা একবার পা দেন, তারাও অন্যান্য সাধারণ ব্যবসায়ীর মত আর ফিরে আসতে পারেন না সুপথে। বদলি কিংবা অন্য কোন কারণে এই চক্রের সদস্যরা কক্সবাজার ছেড়ে দেশের যেখানেই যাক না কেন, ঠিকই ভয়ংকর এই মাদক সেবন ও ব্যবসার লালসায় বার বার ছুটে আসেন কক্সবাজারে। কেউ কেউ বিলাসবহুল প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহার করে পর্যটক সেজে সিভিলে মাসিক, সাপ্তাহিক, দৈনিক ও ক্ষেত্র বিশেষ প্রতি রাতেই সীমান্ত শহর টেকনাফ ও কক্সবাজারে তাদের সুবিধাজনক স্থানে রঙ-বেরঙের গাড়িতে চড়ে নাটকীয় অভিযান উৎকোচ আদায় এমনকি বান্ডেল বান্ডেল ইয়াবা নিয়ে চম্পট দেন বলে জানা গেছে। 
সূত্র জানায়, বিপথগামী এসব পুলিশ সদস্যদের উক্ত অনৈতিক কাজে অঞ্চল ভিত্তিক কিছু দালাল ও সোর্স সবসময় তাদের সহযোগিতা করে। বিনিময়ে তারা হরদম আয় করছেন বাণ্ডেল বাণ্ডেল নগদ টাকা। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, ইদানিং প্রায় প্রতি রাতেই সীমান্ত শহর টেকনাফ,  সাবরাং, কাটাখালী, লেদা ও পর্যটন শহর কক্সবাজারের বিভিন্ন মধু স্পটে ভিড় জমান কক্সবাজারের বাইরে অন্য জেলায় কর্মরত বেশকিছু অসৎ পুলিশ সদস্য। সেখানে সবচেয়ে বেশি এই ভয়ংকর কাজটি করে নির্বিঘ্নে ফিরে যান, যারা ইতোপূর্বে এই জেলার বিভিন্ন স্পটে চাকুরির সুবাধে উক্ত কর্মে জড়িত ছিলেন।
অনুসন্ধানকারী টিম আরো জানান, বর্তমানে কক্সবাজার জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখা ডিবিতে কর্মরত এসআই সোহেল, এএসআই আনিছ, এসআই ইমন, টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশে আগে কর্মরত (বর্তমানে অন্য জেলায়) এসআই বিল্লালসহ প্রায় শতাধিক পুলিশ সদস্য রয়েছে। যারা একেক সময় একেক ধরনের নামি দামি গাড়ি ব্যবহার করে গভীর রাতে প্রায় প্রতিদিনই টেকনাফ-কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থান থেকে বস্তা বস্তা ইয়াবার চালান উদ্ধার করে নামে মাত্র কিছু জমা দিয়ে বাকিগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছে দেশের আনাচে-কানাচে। সূত্র মতে, দূর্নীতিবাজ সদস্যদের কাছ থেকে এই ট্যাবলেটটি ক্রয় করলে অন্যান্য ব্যবসায়ীর চাইতে কম দামে পাওয়া যায় বলেই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বাঘা বাঘা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সাথে তাদের কানেকশন রয়েছে। সূত্র মতে, সম্প্রতি এরকম একজন পুলিশ সদস্যের বড় একটি ইয়াবার চালান ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটক করে। তবে সরকারি চাকুরি ও মানবিক কারণে ওই সময় সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যরা ট্যাবলেটগুলো কেড়ে নিয়ে ওই পুলিশ সদস্যকে উত্তম-মাধ্যম দিয়ে ছেড়ে দেন। পুলিশ নামের নিজ বাহিনীর কলঙ্ক এসব অসাধুরা শুধু নয়, রমজানের আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে এবছরও কক্সবাজার থেকে শতকোটি টাকারও বেশি ইয়াবা  পাচারের আশংকা দেখা দিয়েছে। নিরাপদ কৌশলে এসব ইয়াবা পাচারের জন্য ইতোমধ্যে প্রস্তুতিও স¤পন্ন হয়েছে। এজন্য সড়ক-মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে গোপনে সমঝোতার কথা শোনা যাচ্ছে। নারী নেত্রী, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষিকা, ড্রাইভার ও কথিত সাংবাদিকদের নিয়ে গঠিত কয়েকটি চক্র সিন্ডিকেট করে সপ্তাহ খানেক সময়ের মধ্যে এসব ইয়াবা পাচার করতে পারে বলে তথ্য পাওয়া গেছে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও সীমান্তের একাধিক নির্ভরযোগ্য সুত্রের কাছে।
সূত্র জানায়, রমজানের ঈদ আসন্ন। তারপর ঈদ পরবর্তী বিভিন্ন উৎসব। বিগত বছর গুলোতে এরকম ঈদ মৌসুমে ইয়াবা পাচারকারীরা নিরীহ মহিলা, বেকার যুবকসহ বিভিন্নভাবে ইয়াবা ট্যাবলেট পাচার করতো। প্রশাসনের নজরে পড়া, বারবার ইয়াবাসহ পাচারকারীরা গ্রেফতার হওয়ায় একপর্যায়ে তারা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করে। এজন্য কক্সবাজার শহরের বেশ কয়েকটি আবাসিক হোটেল- রেস্তোরায় দফায় দফায় বৈঠকও হয়েছে। সিদ্ধান্ত মতে চক্র গুলো শতকোটি টাকারও বেশি ইয়াবা ট্যাবলেট পাচার করার প্রস্তুতি নিয়েছে। 
ইয়াবা পাচারে গঠিত চক্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে রাজনৈতিক বিষয়টিকে। সে লক্ষ্যে চক্রে স¤পৃক্ত করা হয়েছে, শীর্ষ দু’টি দলের ১০ জন নারী নেত্রী। যাদেরকে প্রতিনিয়ত মাঠে-ময়দানের রাজনীতিতে সক্রিয় দেখা যায়। স্কুল শিক্ষিকা, টেকনাফ, উখিয়া, হ্নীলা, মরিচ্যা, রামু ও কক্সবাজারের ২০ জন জনপ্রতিনিধি, দক্ষ ড্রাইভার, একটি আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও কয়েকজন কথিত সাংবাদিক পরিচয়দানকারী ব্যক্তি। 
সুত্র জানায়, মিয়ানমার থেকে টেকনাফ স্থল বন্দর ও নাফ নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট হয়ে সর্বগ্রাসী এই মাদকগুলো কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক, মেরিন ড্রাইভ সড়ক ও নৌপথ হয়ে প্রথমে আসবে কক্সবাজারে। এরপর বিভিন্ন মডেলের আলিশান প্রাইভেট গাড়ি, বন্দরের পণ্যবাহী ট্রাক, লবণ বোঝাই ট্রাক, যাত্রীবাহী বাস, মাইক্রো, রোগীবাহী এম্বুলেন্স, বিভিন্ন এনজিও সংস্থার গাড়ি এমনকি কথিত ভিআইপিদের গাড়ির পাশাপাশি কক্সবাজার-ঢাকা রুটে চলাচলরত অভ্যন্তরীণ বিমানযোগে ছড়িয়ে পড়বে দেশের আনাচে-কানাচে। এছাড়া কন্টিনেন্টাল ক্যুরিয়ার সার্ভিস, সুন্দরবন ক্যুরিয়ার সার্ভিস, এসএ পরিবহন ও মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র থেকে মাছ বোঝাই মিনিট্রাকেও এসব ইয়াবার চালান বিভিন্ন স্থানে সরবরাহের পরিকল্পনা রয়েছে। সূত্র মতে, যেখানেই পাচার হোক না কেন, ভয়ংকর এই মাদকটি প্রথমে আসবে কক্সবাজারে। তৎমধ্যে আসন্ন পর্যটন মৌসুম ও ঈদুল ফিতরের চাহিদা মেটাতে স্থানীয় রাখাইন পল্লীসহ ছোট-বড় ইয়াবা ব্যবসায়ীরা পর্যাপ্ত সংখ্যক ইয়াবা মজুদ করবে। এর কয়েকটি বড়ছোট চালান টেকনাফ থেকে কক্সবাজারে না থামিয়ে সরাসরি চট্টগ্রাম ও ঢাকায় চলে যাবে বলে জানা গেছে। এরপর হাত বদল হয়ে চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানের নামী-দামী আবাসিক হোটেল, ফ্ল্যাট বাড়ি, বিপথগামী অভিনেতা-অভিনেত্রী, দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী, বকে যাওয়া যুবক-যুবতী, স্কুল-কলেজের নেশাগ্রস্থ শিক্ষার্থী ও এক শ্রেণির দূর্নীতিবাজ ও বিকৃত মানসিকতার আমলাদের দপ্তরে পৌঁছে যাবে। আর যে চালান কক্সবাজারে ‘যাত্রা বিরতি’ করবে, সেখান থেকে বেশিরভাগ ইয়াবা শহরের বিভিন্ন তারকা মানের হোটেল ও বাসা-বাড়িতে উঠবে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়। 
এদিকে ইয়াবা পাচার সংক্রান্ত বিষয়ে টেকনাফ ৪২ বিজিবি ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক জানান, ইয়াবা পাচারকারী চক্র যতই শক্তিশালী হোক বিজিবির হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। ইয়াবা পাচার রোধে বিজিবির পক্ষ থেকে অভিযান আরো জোরদার করা হয়েছে। বিশেষ করে ইফতার, তারাবির নামায ও সেহেরী সময় নজরদারী আরো বাড়ানো হয়েছে।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার জানান, জেলা পুলিশ ইতোমধ্যেই ইয়াবা পাচারকারী ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা ও অভিযান অব্যাহত রাখছে। জড়িত কাউকেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। ট্যাবলেটটি আকারে ছোট হওয়ায় আসলে খুব তাড়াতাড়ি বিষয়টি দৃষ্টি গোচর হয় না। তবে পুলিশ যেভাবে নতুন কৌশল ও ফাঁদ পেতেছে, এতে পাচারকারী যতই প্রভাবশালী কিংবা চতুর হোক না কেন, ধরা পড়বে বলে আশা করা যাচ্ছে। 
উল্লেখ্য, ভয়ংকর মাদক উক্ত ইয়াবা বাণিজ্যে জড়িয়ে ইতোপূর্বে কাড়ি কাড়ি টাকা, বদলীর পরও তদবির করে আবার কক্সবাজারে আসা, স্বনামে-বেনামে তাদের গাড়ি বাড়ি ও নানা সহায়-সম্পত্তির মালিক হওয়া এরকম বেশকিছু পুলিশ নামের কলংকের বস্তুনিষ্ঠ তথ্য বেরিয়ে এসেছে প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে। যা তদন্ত সাপেক্ষে ভবিষ্যতে প্রকাশ করা হবে।