গোলাম আযমের রায় আজ সোমবার

ডেস্ক রিপোর্ট: মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াতের সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের মামলার রায় ঘোষণা করা হচ্ছে আগামীকাল সোমবার। বাঙালি হত্যায় পাকি¯ত্মানি বাহিনীকে সহায়তাকারী হিসেবে যার নাম সবার ওপরে উঠে আসে।

মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র, উস্কানি, পাকিস্তানি সেনাদের সাহায্য করা এবং হত্যা-নির্যাতনে বাধা না দেওয়াসহ ৫ ধরনের অভিযোগ রয়েছে জামায়াতে ইসলামীর মুক্তিযুদ্ধকালীন আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে তার বিচারের দাবি দীর্ঘ দিনের।

রোববার ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল মামলাটি রায় ঘোষণার জন্য আগামীকাল দিন ধার্য করেন।

এর আগে গত ১৭ এপ্রিল মামলাটির কার্যক্রম শেষ করে রায়ের জন্য সিএভিতে (অপেক্ষমান) রেখে দেয় ট্রাইব্যুনাল।

মামলার কার্যক্রম শেষ হওয়ার প্রায় তিন মাস পর এ রায় ঘোষণা করা হচ্ছে।

গত ১০ মার্চ থেকে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত গোলাম আযমের পক্ষে ১১ কার্যদিবস যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন তার পক্ষের আাইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম ও ইমরান সিদ্দিকী।

এর আগে গত ১৭ ফেব্র“য়ারি থেকে ৪ মার্চ পর্যন্ত প্রথম দফায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ, প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম ও সুলতান মাহমুদ সীমন। এরপর আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন হলে প্রসিকিউশন দ্বিতীয় দফা যুক্তি উপস্থাপন করেন।

জামায়াতের সাবেক এ নেতার বিরুদ্ধে এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) মতিউর রহমানসহ মোট ১৭ জন সাক্ষী প্রসিকিউশনের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তার মধ্যে সাতজন ছিল জব্দ তালিকার সাক্ষী এবং ১ জন সাক্ষীর আইও’র কাছে দেয়া জবানবন্দিকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন ট্রাইব্যুনাল।

অন্যদিকে আসামিপক্ষের সাফাই সাক্ষীদের ১২ জনের মধ্যে একমাত্র সাফাই সাক্ষী গোলাম আযমের ছেলে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্তকৃত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী তার বাবার পক্ষে সাক্ষ্য দেন।

গত বছরের ৯ জানুয়ারি গোলাম আযমের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে ৬২ টি ঘটনায় পাঁচ ধরনের অভিযোগ আনা হয়। এরপর ১১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনাল প্রসিকিউশনের অভিযোগ আমলে নেন।

মানবতাবিরোধী পাঁচ ধরনের অপরাধের সুনির্দিষ্ট ৬১ টি ঘটনায় অভিযুক্ত করে গত বছর ১৩ মে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে ট্রাইব্যুনাল। গত বছরের ১১ জানুয়ারি গোলাম আযমকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে গত বছরের ৯ জানুয়ারি তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের দেয়া আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেয়া হয়।

১৯৭১ থেকে ৭ বছর লন্ডনে অবস্থান করার পর ১৯৭৮ এ সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে আবার বাংলাদেশে আসেন এই জামায়াত নেতা। ১৯৯৯ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমিরের পদ থেকে অবসরে গেলেও দলটির ‘তাত্ত্বিক গুরু’ হিসেবে তিনি সম্পৃক্ততা বজায় রাখেন।

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ২০১২ সালের ১১ ই জানুয়ারি তাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে বিচারকরা তাকে কারাগারে পাঠান। তখন থেকেই তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের প্রিজন সেলে রাখা হয়েছে।

গত বছরের ৯ জানুয়ারি গোলাম আযমের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে ৬১ টি ঘটনায় ৫ ধরনের অভিযোগ আনা হয়। এরপর ১১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনাল প্রসিকিউশনের অভিযোগ আমলে নিয়ে বিচারকাজ শুরু করেন।

প্রথম অভিযোগ : ষড়যন্ত্র

গোলাম আযমের বিরুদ্ধে গঠিত প্রথম ধরনের অভিযোগটি মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ। এ ধরনের অভিযোগে ছয়টি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- একাত্তরের ৪ এপ্রিল গোলাম আযম, নুরুল আমীন, মৌলভী ফরিদ আহমেদ, খাজা খয়েরউদ্দিন, একেএম শফিকুল ইসলাম, মাওলান নুরুজ্জামান, হামিদুল হক চৌধুরী, মোহসিনউদ্দিন আহমেদ, এটি সাদীসহ ১২ সদস্যের এক প্রতিনিধি দল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে নাগরিক শান্তি কমিটি গঠনের ষড়যন্ত্র করেন। আগের সাক্ষাতের সূত্র ধরে ৬ এপ্রিল গোলাম আযম আবারো টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেন এবং পূর্বোল্লিখিত ষড়যন্ত্রে অংশ নেন। ১৯ জুন এই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় গোলাম আযম রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের একটি বৈঠক করেন। ১ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডিতে আবারো ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষকে মোকাবিলার জন্য রাজাকার বাহিনীর শক্তি বাড়ানোর পরামর্শ দেন।

দ্বিতীয় অভিযোগ : পরিকল্পনা
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনার অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগে তিনটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়। ৪ এপ্রিল টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠকে সারা দেশে শান্তি কমিটি গঠনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৯ এপ্রিল গোলাম আযম ও অন্যরা ঢাকায় ১৪০ সদস্যের নাগরিক শান্তি কমিটি গঠন করেন। ৪ মে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে একিউএম শফিকুল ইসলামের বাসভবনে খাজা খয়েরউদ্দিনের সভাপতিত্বে শান্তি কমিটির সভা হয়, যেখানে গোলাম আযম উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন ইউনিয়নে শান্তি কমিটি গঠনের বিষয়ে পরিকল্পনা করা হয়।

তৃতীয় অভিযোগ : উস্কানি
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে উস্কানির ২৮ টি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। এসব ঘটনার মধ্যে রয়েছে- ৭ এপ্রিল গোলাম আযম এক যুক্ত বিবৃতিতে স্বাধীনতাকামী মানুষকে ‘ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, তাদের যেখানেই দেখা যাবে, সেখানেই ধ্বংস করা হবে। ২২ এপ্রিল শান্তি কমিটির সভা শেষে এক বিবৃতিতে গোলাম আযম অধীনস্থ সংগঠনগুলোর সদস্যদের ‘দেশপ্রেমিক নাগরিক’ উল্লেখ করে দেশের সাধারণ নাগরিকদের ধ্বংস করার আহ্বান জানান। ১৭ মে গোলাম আযম ঢাকায় এক সভায় স্বাধীনতা আন্দোলনকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ’ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ উল্লেখ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নমের সেনা অভিযানের প্রশংসা করেন। একাত্তরের ১৬ জুলাই রাজশাহী, ১৮ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ৪ আগস্ট খুলনা, ৭ আগস্ট কুষ্টিয়া প্রভৃতি এলাকায় আয়োজিত বিভিন্ন সভায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক ও উত্তেজনাকর বক্তব্য দেন। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের ২৫ তম আজাদী দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে, ১৭ ও ২৩ আগস্ট দলীয় সভায় এবং ২৬ আগস্ট পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত দলীয় অনুষ্ঠানে গোলাম আযম বিভিন্ন উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন। ১৭ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল এডুকেশন সেন্টারে শিক্ষা গ্রহণরত রাজাকারদের শিবির পরিদর্শন করে তাদের সশস্ত্র হওয়ার আহ্বান জানান। ৩ অক্টোবর ঢাকায় মজলিসে শুরার সভায় একই ধরনের উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন গোলাম আযম।


চতুর্থ অভিযোগ : সম্পৃক্ততা
গোলাম আযমের মানবতাবিরোধী অপরাধে সহযোগিতা বা সম্পৃক্ততার ২৩ টি ঘটনা উল্লেখ করা হয়। ৪ ও ৬ এপ্রিল টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে গোলাম আযমসহ অন্যরা সহযোগিতার আশ্বাস দেন। ৯ এপ্রিল গোলাম আযমের সহযোগিতায় নাগরিক শান্তি কমিটি গঠিত হলে ১৫ এপ্রিল এর নাম পরিবর্তন করে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি করা হয়। শান্তি কমিটির ২১ সদস্যের কার্যকরী কমিটির একজন সদস্য ছিলেন গোলাম আযম। ১৮ জুন লাহোর বিমানবন্দরে গোলাম আযম বলেন, জনগণ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করতে চায়। ১৯ জুন রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করে সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মোকাবিলার জন্য রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহের আহ্বান জানান। পরদিন লাহোরে জামায়াতের পশ্চিম পাকিস্তান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে দুষ্কৃতকারীরা সক্রিয় রয়েছে এবং তাদের প্রতিরোধে এবং শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য অস্ত্রসজ্জিত হওয়া উচিত।

পঞ্চম অভিযোগ : হত্যা ও নির্যাতন
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে হত্যা ও নির্যাতনের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, কুমিল্লার হোমনা থানার রামকৃষ্ণপুর গ্রামের সিরু মিয়া একাত্তরে ঢাকার মোহাম্মদপুর থানায় দারোগা (সাব-ইন্সপেক্টর) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ২৮ মার্চ তিনি স্ত্রী আনোয়ারা বেগম ও ১৪ বছরের ছেলে আনোয়ার কামালকে নিয়ে কুমিল্লার নিজ বাড়িতে যান। সেখানে সিরু মিয়া শরণার্থীদের ভারতে যাতায়াতে সাহায্য করতেন। ২৭ অক্টোবর সকাল ১০ টার দিকে কসবা থানার তদন্ত চেকপোস্টের কাছে সিরু মিয়া ও তার ছেলেসহ ছয়জন ভারতে যাওয়ার সময় রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। তাদের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে কয়েক দিন নির্যাতনের পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। স্বামী-সন্তানের ধরা পড়ার খবর পেয়ে সিরু মিয়ার স্ত্রী গোলাম আযমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সিরু মিয়ার ভগ্নিপতি ছিলেন গোলাম আযমের দুই ছেলে আজমী ও আমীনের শিক্ষক। তিনি গোলাম আযমের কাছে সিরু মিয়া ও তার ছেলেকে মুক্তি দিতে অনুরোধ জানান। গোলাম আযম ব্রাহ্মণবাড়িয়া শান্তি কমিটির নেতা পেয়ারা মিয়ার কাছে একটি চিঠি পাঠান, যাতে সিরু মিয়া ও তার ছেলেকে হত্যার নির্দেশ ছিল। চিঠি পাওয়ার পর ঈদের দিন রাতে সিরু মিয়াসহ ৩৯ জনকে পাকিস্তানি সেনারা রাজাকার ও আল বদরদের সহযোগিতায় কারাগার থেকে বের করে নিয়ে পৈরতলা রেলব্রিজের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে ৩৮ জন মারা গেলেও একজন প্রাণে বেঁচে যান।