নতুন বার্তা: বাংলাদেশের সহিংস এবং অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সৃষ্ট সংঘাত-সংঘর্ষের পরিবেশ এবং এর মধ্যে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ সামগ্রিক ও সার্বিক জটিল বিষয়টি এখন আর কোনোক্রমেই অভ্যন্তরীণ নেই। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এবং দুঃখজনক হলেও এটা এখন পরিপূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এই প্রথম বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সঙ্কট এবং এ কারণে সৃষ্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে পড়লো। স্বাধীনতার পর থেকে মাত্র কিছুদিন আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্কটটিকে দেশের নিজস্ব এবং অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে গণ্য, চিহ্নিত করা হলেও এখন পরিস্থিতি পুরোটাই পাল্টে গেছে – বরং বলা যায় পাল্টে দেয়া হয়েছে। আগে যে বহিঃদেশীয় শক্তির ঘুটি চালাচালি এই দেশের রাজনীতি নিয়ে হয়নি তা নয়, কিন্তু তা কখনও স্পষ্ট, প্রকাশ্য ও সরাসরি ছিল না। যা হয়েছে তা রাখঢাক করে হয়েছে, হয়েছে এক প্রকার পর্দার অন্তরালে। জানাজানি হলেও তা অস্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু এবারে পরিস্থিতি যে ভিন্ন তা বোধকরি সবাই উপলব্ধি করতে পারছেন। এ কারণেই বাংলাদেশের জন্য ২০১৩ অন্যান্য যেকোনো বছরের তুলনায় ভিন্ন হবে, ভিন্নভাবে বিশ্লেষিত হবে।
মাত্র কিছুদিন আগেও বিদেশি দাতা বা কোনো রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের যেকোনো রাজনৈতিক সঙ্কট হলেই স্পষ্টভাবে বলে দিতেন – এটা বাংলাদেশের নিজস্ব ও অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু এখন আর সে ধরনের কথা খুবই কম মাত্রায় ব্যবহৃত হয়, বলতে গেলে কানেই বাজে না।
বাংলাদেশ এমন এক জটিল সঙ্কটে পড়েছে যে, এ সঙ্কট আর অভ্যন্তরীণভাবে সমাধান বা মোকাবেলা করা হচ্ছে না বলেই বিদেশিরা পথ পেয়ে গেছে আমাদের সমস্যার সমাধান করে দেয়ার জন্য।
জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো কয়েক দফায় বাংলাদেশ সফর করলেন। প্রথমদিকে সরকারের কেউ কেউ তার সফরকে রুটিন বলে প্রকাশ্যে বলতেন, মন্তব্য করতেন। কিন্তু এবারের অর্থাৎ ৬ ডিসেম্বরের সফরটিকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করতে হবে। যদিও এখনও সরকারের নির্দেশে পররাষ্ট্র দফতরের কোনো কোনো কর্মকর্তা জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের সব শেষ দেয়া চিঠিকে রুটিন বলে উল্লেখ করেছেন।
মহাসচিব বান কি মুন তার ওই চিঠিতে ‘বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে, সংঘাতবিহীন, অবাধ-নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য’ একটি নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছেন। এর আগেও মহাসচিবের চিঠি এবং অস্কার তারানকোর সফরকালে সব দলকে নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা বার বার বলা হয়েছে। মহাসচিবের নির্দেশেই জাতিসংঘের রাজনৈতিক বিভাগের সহকারী মহাসচিব তারানকো বাংলাদেশ সফর করেন।
জাতিসংঘ মহাসচিব তার চিঠিতে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার সঙ্গে একটি মাত্র দেশ ছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সব দেশ, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমী দুনিয়ার দেশগুলো এবং উন্নত দেশগুলোর মনোভাবের যথেষ্ট মিল রয়েছে। কারণ এসব দেশও সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা বলেছে এবং এতে তারা এখন পর্যন্ত স্থির রয়েছে। এমনকি যে চীন অন্য কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সাধারণত কথা বলে না, সে চীনও সরব হয়েছে এবং তাদের মনোভাবও ওই একই।
তারানকোর ইতোপূর্বের সব সফর ব্যর্থ হয়েছে। তিনি প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলীয় নেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতসহ সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা করেছিলেন। তার সফরের এ ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ মহাসচিব সরাসরি নিজের অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে ভূমিকা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলীয় নেত্রীর সঙ্গে কথা বলা, চিঠি দেয়ার কাজগুলো সম্পন্ন করেছেন। নতুন করে আবার চিঠি দিয়েছেন- যাতে সমস্যাটি নিজেরা নিজেরা মিটিয়ে ফেলা হয়। একই সঙ্গে তিনি শেষ চেষ্টা হিসেবে আবারও তার বিশেষ দূতকে পাঠাচ্ছেন। একটি কথা মনে রাখতে হবে, জাতিসংঘের মহাসচিবের উদ্যোগ একান্তই তার ব্যক্তিগত, এটা যারা মনে করে থাকেন তারা দিন-দুনিয়ার খবরা-খবর রাখেন না। বর্তমান সরকারের দিক থেকে অন্তর্গতভাবে যাই হোক, প্রকাশ্যভাবে বোঝা যায় না যে, তারা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে এবং বিষয়টি যে গুরুতর তাও উপলব্ধি করতে পারছে।
বিশ্বের বহু দেশে নির্বাচন নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হলে জাতিসংঘ নানাভাবে বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিয়ে থাকে। যেসব দেশে অভ্যন্তরীণভাবে বিরোধ নিষ্পত্তি সম্ভব হয় না, সেক্ষেত্রে বিবদমান পক্ষ, পক্ষগুলো বা বহু পক্ষের মধ্যে আলোচনা করে জাতিসংঘের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের নজির রয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল, আফগানিস্তান, ইরাক, সুদান, তিমুরসহ বহু স্থানেই এমন নির্বাচনের ঘটনা ঘটেছে। আর তারপরেও শান্তি প্রতিষ্ঠা না হলে ওই সব দেশের ভাগ্যে আন্তর্জাতিকভাবে খুব একটা ভালো ফল জোটেনি, বরং জুটেছে বিপর্যয়ের কালো চিহ্ন।
এ কথা মনে রাখতে হবে, জাতিসংঘ বা এর মহাসচিব এককভাবে কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন না, উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা সাপেক্ষে এবং তাদের অনুমোদন নিয়েই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যা হচ্ছে তার প্রতিটি পদক্ষেপ ওভাবেই নেয়া হয়েছে। এবং হিসাবের খাতায় রাখা হয়েছে ব্যর্থ উদ্যোগগুলোর – যা কিনা পরবর্তীকালের হিসাব-নিকাশে খুবই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচিত হবে ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে। কাজেই জাতিসংঘ মহাসচিবের চিঠি এবং তারই দূত তারানকোর সফরকে যারা রুটিন সফর বলছেন, তারা আর যাই হোক সঠিক হিসাবটি করছেন না, মস্তবড় এক ভুলের রাজ্যে বসবাস করছেন।
জাতিসংঘ সহকারী মহাসচিব তারানকো ইতোপূর্বে সংলাপ এবং সমঝোতার মাধ্যমে সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের কথা ঢাকায় এসে জনে জনে বলে গিয়েছিলেন। বিশেষ করে সরকারী পক্ষকে তিনি বার বার বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন এ সম্পর্কে। জাতিসংঘ মহাসচিবের সর্বসাম্প্রতিক চিঠিতেই এমনটা ইঙ্গিত মেলে যে, ছাড় দিয়ে সব পক্ষকে নিয়ে নির্বাচন না করলে, সে নির্বাচনটি জাতিসংঘসহ কেউই মানবে না। এক্ষেত্রে ভিন্ন পথে যাওয়ার ইঙ্গিতও তিনি দিয়ে ফেলেছেন সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে ইতোমধ্যে। আর সে ইঙ্গিতের বার্তা বহন করে নিয়ে আসছেন তারই দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। যে ইঙ্গিতটি দেয়া হয়েছে এবং তারানকোর পক্ষ থেকে সরাসরি দেয়া হবে – বাংলাদেশে যদি সংলাপ-সমঝোতার মাধ্যমে সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হয়, তাহলে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হতে পারে। ঢাকায় কূটনৈতিক মহল এ নিয়ে ইতোমধ্যে আলাপ-আলোচনা করেছেন এবং করছেন। জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব দুই পক্ষকে সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যায় কিনা তার শেষ চেষ্টাটি করবেন। আর না হলে বিকল্প পথে যে তাদের যেতে হবে তাও স্পষ্ট করে বলে দিয়ে যাবেন।
জাতিসংঘ এবং পশ্চিমী দুনিয়ায় বাংলাদেশ নিয়ে যে দৌড়-ঝাপ চলছে তাতে বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে তারা যে দিনে দিনে ব্যাপক মাত্রায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, সব আলোচনা হবে, প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর সফরের সময়েই, এমনটা নয়। যে উদ্যোগ চলছে তাতে তারানকোর সফরের আগেই হয়তো আমরা অনেক কিছু দেখতে পাবো। এই সপ্তাহটা খুবই মনোযোগ দিয়ে চোখ-কান খোলা রেখে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
প্রধানত জাতিসংঘের রাজনৈতিক বিভাগ দেশে দেশে রাজনৈতিক বিরোধ এবং ওই বিরোধ থেকে সৃষ্ট জটিল পরিস্থিতি যদি একটি অবাধ, স্বাধীন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে বাধা সৃষ্টি করে এবং সে বাধাটি যদি অভ্যন্তরীণভাবে মিমাংসা করা না যায়, সেখানে জাতিসংঘ সরাসরি বা অন্য উপায়ে নির্বাচনটি অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত একশ’রও বেশি দেশ জাতিসংঘের কাছে নির্বাচনের বিষয়টি তদারকির জন্য অনুরোধ জানিয়েছিল। ২০১৩ পর্যন্ত এ সংখ্যা অনেক বেশি হবে। আর ইতোমধ্যে বেশ কিছু দেশে জাতিসংঘের সরাসরি তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে জাতিসংঘের রাজনৈতিক বিভাগের একটি শাখা রয়েছে – Electrol Assistance Group (EAD) বা নির্বাচনী সহায়তা বা সহযোগিতা গ্রুপ। পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালসহ যে সব দেশে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তা রাজনৈতিক বিভাগ ও গ্রুপ সম্পন্ন করেছে। পরে রাজনৈতিক বিভাগ সরাসরি জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে সামগ্রিক বিষয়টি অবহিত করে। জাতিসংঘ মহাসচিব প্রয়োজনে বিষয়টি সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে জানিয়ে দেন।
যদি ওই নির্বাচনে বিবদমান পক্ষগুলোকে বা কোনো পক্ষকে রাজি করানো না যায় এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনটি অনুষ্ঠান করা সম্ভব না হয়, তাহলে জাতিসংঘ মহাসচিব তার উদ্যোগ সফল হয়নি এমনটা জানিয়ে, বিষয়টি সাধারণ পরিষদকে অবহিত করেন। সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী পরবর্তী কার্যক্রম নির্ধারিত হয়। এর মধ্যে একটি করণীয় রয়েছে, যেমন বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদের পাঠানো হবে কি না তা নির্ধারণ করা। এবং বিষয়টি সাধারণ পরিষদের মাধ্যমেই নির্ধারিত হয়। যদি নিরাপত্তা পরিষদে পাঠানো হয় তাহলে জাতিসংঘের চার্টার (Charter) vii অনুযায়ী ওই পরিষদ ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। তবে নিরাপত্তা পরিষদে যাওয়ার পর ওই বিরোধ সম্পর্কে পর্যালোচনা, বিশ্লেষণ করার জন্য যে ওয়ার্কিং গ্রুপ রয়েছে তাতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হয়। এর পরে যদি তারা দেখতে পান শান্তির প্রতি হুমকি, স্থিতিশীলতা ও শান্তির শর্তাবলী ভঙ্গ করাসহ সামগ্রিকভাবে একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে, তাহলে ব্যবস্থা গৃহীত হয়ে থাকে। এ ব্যবস্থার মধ্যে সতর্ক করা থেকে নানা মাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়গুলো রয়েছে। এটা ওই পক্ষ বা দেশটিকে চলাচলে, যাতায়াত, ভ্রমণ থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্র পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে। শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনও এই প্রক্রিয়ারই অংশ।
সোমালিয়ায়ই প্রথম দেশ যার বিরুদ্ধে ১৯৯২ সালে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। এরপরে সুদানসহ কয়েকটি দেশ এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ে গিয়েছিল। যদিও ২০০৫ সালের জাতিসংঘ গৃহীত এক প্রস্তাব অনুযায়ী ওই নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে কিছু সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। নিষেধাজ্ঞা আরোপের সরাসরি বেশ কিছু প্রতিক্রিয়া তো থাকেই, সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি। এসব বিষয় আলোচনা করা হলো জাতিসংঘ কিভাবে তার কার্যক্রম চালায়, তার একটি মোটামুটি ধারণা দেয়ার জন্য। এটা কোথায় হবে কি হবে না – সে বিষয়টি বিবেচ্য নয়।
অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর সফরটি নানা কারণে এ দফায় গুরুত্বপূর্ণ। যদি সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে দেশটি এগিয়ে না যায় এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনের প্রস্তাবটি যদি সম্মুখে চলে আসে তাহলে তাকে কি বর্তমান সরকার মানবে? যদি মেনে নেয়া না হয় এবং যার সম্ভাবনাই বেশি ,তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন হবে। না মানার যে সব কারণগুলো রয়েছে তার মধ্যে – তত্ত্বাবধায়ক সরকারটি যে কারণে বিলুপ্ত করা হলো এবং একদলীয় নির্বাচনের পথে যাত্রার জন্য যেসব কারণ বিদ্যমান রয়েছে, তার এক বিন্দুও পরিবর্তিত হয়নি। পরিবর্তন না হওয়ার পেছনে অভ্যন্তরীণভাবে বর্তমান সরকারের জনপ্রিয়তায় ধস এবং এ কারণে আগামী নির্বাচনে জয়লাভের খুবই সীমিত সম্ভাবনার বিষয়টি কাজ করছে। আর যে বহিঃশক্তিটি মনে করছে, বাংলাদেশের সরকার বদলে ভূ-রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তা কৌশলগত দিক দিয়ে তাদের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে তারাও এক ইঞ্চিও ছাড় দিয়েছে, এখন পর্যন্ত এমন খবর পাওয়া যায়নি। কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায় সকল পক্ষেরই একটি সমঝোতায় পৌঁছা বাঞ্ছনীয় দেশের এবং জনগণের স্বার্থেই।
সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে তাই ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের ৪ ডিসেম্বরের সংক্ষিপ্ত সময়ের ঢাকা সফরকেও খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমী দুনিয়া, চীনসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রধান শক্তিকে বাংলাদেশ প্রশ্নে স্থায়ী প্রতিপক্ষ তারা বানাতে চায় কিনা – তাও বিবেচ্য বিষয়। এ ব্যাপারে ভারতীয় মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি সরকারকে এ সফরকালে অবহিত করা হবে বলে ধারণা করা যায়।
টিকফাসহ যতো কিছুই হোক না কেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমী দুনিয়ার মনোভাবের পরিবর্তন হয়েছে এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। চীনের ভূমিকা আরো কঠোর। চিরাচরিত চীনা প্রথা ভেঙে ওই দেশটিও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রশ্নে প্রকাশ্যে কথা বলছে। চীনের রাষ্ট্রদূত ঢাকায় সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন যে, চীন বাংলাদেশকে একটি ‘স্বাধীন’ স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ দেখতে চায়। প্রায় একই সঙ্গে চীনা পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্রের মন্তব্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর সর্বসাম্প্রতিক যে মনোভাবের কথা ব্যক্ত করেছে তাহচ্ছে – সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেই তা বৈধতা পাবে।
এই পরিস্থিতিতে এবং সামগ্রিক দিক বিবেচনায় বাংলাদেশের বর্তমান সরকার এবং এর প্রধানমন্ত্রী একা, একক পথে একটি ভয়ঙ্কর যাত্রা কেন শুরু করলেন, আর এ যাত্রা তিনি অব্যাহত রাখবেন এমন কঠোর মনোভাবেই বা কেন স্থির রয়েছেন – তাও এখন বড় একটি প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে। তার এ যাত্রার সঙ্গে দেশের এবং দেশটির জনগণের ভাগ্য যে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে তা উপলব্ধি করার বোধশক্তিটুকুও কি লোপ পেয়েছে? যদি লোপ পায়, তা হবে সত্যিকার অর্থেই বিপজ্জনক, ভয়ঙ্কর এবং মহা-আতঙ্কের।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন