আগামীতে কারা ক্ষমতায় আসবে

ডেস্ক রিপোর্ট : দেশে এখন সবচেয়ে জ্বলন্ত জিজ্ঞাসা এটিই যে, আগামীতে কারা ক্ষমতায় আসবে? সাধারণ মানুষকে এ প্রশ্নটি করলে তারা যেভাবে জবাব দেবেন এর একটি নমুনা এখানে পেশ করছি। তারা বলবেন, প্রধানবিরোধী দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বর্তমান সরকার আর আসতে পারবে না। জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করলে বিএনপিরই আসার সম্ভাবনা বেশি। দ্বিমুখী না হয়ে নির্বাচন তিনটি জোট ভিত্তিক হলে কাছাকাছি আসন পেয়ে তিন শক্তিই ঝুলে থাকবে, যে দু’জন মিলতে পারবে তারাই ক্ষমতা হাতে নেবে।
দেশে সংকটময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে জরুরি অবস্থা জারি করে বর্তমান সরকারই সংবিধান মতো আরো কিছু সময় থাকবে। সংবিধানের আওতায় অন্তর্র্বতী সরকার একতরফা নির্বাচন করলে আবারও আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় আসবে। সংবিধানের বাইরে কোন রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে সমন্বিত সরকার জাতীয় কিছু একটা হতে পারে। সেনা সমর্থিত জাতীয় সরকার ধরনের কিছুও  হতে পারে। সরাসরি সামরিক সরকার চলে আসতে পারে। সামরিক প্রকৃতির না হয়ে সিভিল তৃতীয় শক্তির সাথে সমন্বিত আর্মি ব্যাকড সরকার হতে পারে। এ ধরনের নানা মত ও ধারণাই সাধারণ নাগরিকরা আপনাকে দেবেন। কিন্তু আপনি যদি সংবিধানের বাইরে কিছু ভাবতে না চান, তাহলে আপনার সামনে এত অপশন থাকবে না। সংঘাতময় সময় এড়িয়ে যেতে চাইলে আবার যে কোন রকম সমাধানেই আপনাকে যেতে হতে পারে। যার নাম প্রয়োজনের তাগিদ। ডকট্রিন অব নেসেসিটি।

এখানে অবশ্য একটি ভিন্নরকম জবাবও আছে। যেটি হচ্ছে, মানুষ যে রকম চায়, সেরকমটিই হবে। আজ যদি নাও হয়, কাল অবশ্যই হবে। এ বিষয়ে কথা হয়, দেশের অন্যতম সেরা বুদ্ধিজীবী, রাজনীতি ও সমাজ বিশ্লেষকের সাথে। যিনি নিজেকে মিডিয়ায় প্রকাশ করতে অনীহা দেখিয়েছেন। নিজের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও গভীর পর্যবেক্ষণের আলোকে তিনি দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে বলেন, বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ যাদের পক্ষে থাকবে- ক্ষমতায় তারাই যাবে, তারাই থাকবে এবং তারাই আসবে। সে দল বা জোটের নাম যাই হোক। তারা গণতন্ত্রমনা হোক বা সামরিক ঘেঁষাই হোক। বাংলাদেশের কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মানুষ কী চায় সেটি যারা বোঝে তারাই ক্ষমতায় থাকার উপযুক্ত। তাদের জানতে হবে বাংলাদেশের ৪ লক্ষাধিক মসজিদ, হাজার হাজার মাদরাসা, শত শত পীর আওলিয়ার দরবার জনগণকে রাতদিন যে বার্তাটি দিয়ে চলেছে, তার সাথে তাদের রাজনীতির সুর কতটুকু মিশ খায়? সাধারণভাবে তাদের দলীয় নীতি আদর্শ কী পরিমাণ স্বাধীনতার সপক্ষে? কতটুকু শান্তি সুশাসন ও সামাজিক সহিষ্ণুতার পক্ষে? কতটুকু সভ্যতা শালীনতা ও উন্নয়নবান্ধব? তাদের ভাষা বক্তৃতা মন্তব্য বিবৃতি ও যুক্তি-তর্ক কতটুকু সততা নিষ্ঠা ভব্যতা ও বাস্তবতাপূর্ণ? একটি সহজ হিসাব দিয়ে তিনি বলেন, দেশে কওমী ও আলিয়া মাদরাসার সাথে যুক্ত বিভিন্ন পর্যায়ের আলেম ওলামার সংখ্যা এক কোটিরও বেশি। তাদের প্রত্যেকের পরিবার ও বন্ধুজন যদি গড়ে আরো দু’জন করেও ধরা যায় তাহলে এখানে তিন থেকে চার কোটি ভোট রয়েছে। এ তিন/চার কোটি ভোটই দলমুক্ত উড়ন্ত ভোট। এর বড় অংশটি যে দিক ঝুঁকবে বর্তমান বাস্তবতায় সে পক্ষই ক্ষমতায় যাবে। আগামী পঞ্চাশ বছর এ হিসাবের বাইরে ভোটের রাজনীতি যেতে পারবে না। ইসলামী রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের বাইরে বৃহত্তর ইসলামী সমাজচিন্তা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ বিবেচনায় এই তিন সাড়ে তিন কোটি ভোট হেফাজতে ইসলাম, কওমী ও আলিয়া মাদরাসা, জমিয়াতুল মোদার্রেছীন প্রভৃতি শিরোনামের আওতায় রয়েছে। দেশকে শান্তি, শৃক্সখলা, স্থিতি ও গতিশীলতার মাঝে রাখতে হলে বড় দুই দল, তৃতীয় কোন দল, যে কোন ধরনের সামরিক বেসামরিক নতুন শক্তি, দেশী-বিদেশী অভিপ্রায় কিংবা প্রভাব, যে ধরনের যাই হোক না কেন বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোর এই প্রভাবশালী নিয়ামক শক্তিকে আস্থায় না রেখে কেউই স্থায়ী কিংবা সফল হতে পারবে না।

এ বিষয়ে কথা হয় দেশের প্রধান আলেম উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রখ্যাত পীর শাহসূফি মাওলানা আমিনুল হক বদরুল আলমের সাথে। অশীতিপর এ বিদগ্ধ হাদীসবিদ বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে খাঁটি দেশপ্রেমিক শক্তি হচ্ছে এ দেশের লক্ষ লক্ষ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, আলেম, ইমাম ও পীর বুজুর্গ। যারা কোটি কোটি মানুষকে সাথে নিয়ে এ দেশের বুকে নিজেদের দীর্ঘ জীবনটি সাধনার ভেতর কাটিয়ে দেন। তারা অল্পতেই সন্তুষ্ট থেকে আল্লাহর শুকরিয়া করেন। দুর্নীতি অন্যায় অনাচার থেকে নিজেরা তো দূরে থাকেনই, দেশবাসীকেও অন্যায়, জুলুম ও অশ্লীলতা থেকে বিরত রাখেন। বাংলাদেশ ছাড়া এদের আর কোন ঠিকানা নেই। বিদেশে অর্থবিত্ত পাচার বা সেকেন্ড হোমের ধারণাও তাদের মাঝে পরিচিত নয়। তারা দলীয় রাজনীতি থেকেও সচেতন দূরত্বে থাকেন। ইসলাম, স্বাধীনতা, দেশ ও মানুষের স্বার্থের নিরিখে তারা সাময়িক রাজনৈতিক পক্ষ বেছে নেন। ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের গুরুত্ব তাদের কাছে সবচেয়ে বেশি। বৃটিশ, পাকিস্তান, বিএনপি, আওয়ামী লীগ বা সামরিক সরকার সব সময়ই তারা কেবল তাদের শিক্ষা, আদর্শ, নৈতিকতা, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের সুরক্ষা, চর্চা এবং প্রচারকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।

সাম্প্রতিক কিছু প্রসঙ্গ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নাস্তিক ব্লগারদের পক্ষাবলম্বন করে সরকার নিজের যে ক্ষতি করেছে তা কোনদিনও তারা পোষাতে পারবে না। মহানবী (সা.)-এর অবমাননার প্রতিকারে শেখ হাসিনার ভূমিকা স্পষ্ট সাহসী ও ঈমানদীপ্ত ছিল না, যার মন্দ প্রভাব তার রাজনীতির উপর পতিত হয়েছে। হেফাজতবিরোধী ভূমিকাও তার ত্রুটিপূর্ণ। যেগুলোর ফলে তার ইমেজ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। মনে হয় না যে তিনি সহসাই তা কাটিয়ে উঠতে পারবেন। ইসলাম ও মুসলমানদের সপক্ষে বেগম জিয়ার অবস্থানও যথেষ্ট বলিষ্ঠ নয়। তাকে আরো স্পষ্ট হতে হবে। দুই নেত্রীর মধ্যে যিনি বেশি ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সামাজিক সুস্থতার প্রবক্তা হবেন, আন্তরিকতার পরিচয় দেবেন, তার ভবিষ্যতই তত ভাল হবে।

মাদরাসায় জঙ্গীবাদ লালন প্রসঙ্গে তিনি মন্তব্য করেন, আবহমানকাল থেকে মানুষ জানে যে, মসজিদ মাদরাসা শান্তির ঠিকানা। এসব জায়গায় কখনো জঙ্গীবাদ বা সন্ত্রাস ছিল না। কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা পাওয়া গেলে  তা ব্যতিক্রম বলেই বিবেচিত হবে। কেউ অপরাধ করে থাকলে তার প্রতিকার হতে পারে কিন্তু গোটা ধর্মীয় অঙ্গনকে বিতর্কিত ও সমালোচিত হতে দেয়া যাবে না। অপপ্রচার বা রাজনৈতিক সুবিধাবাদের দ্বারা কখনোই সফলতা আসে না। এসব স্ট্যান্টবাজি মানুষ ধরে ফেলে। অপপ্রচার হাওয়ায় মিশে যায় আর মহৎ প্রতিষ্ঠান মহতই থাকে।

দেশের অন্যতম শীর্ষ ইসলামী গবেষক ও বিশিষ্ট লেখককে প্রশ্ন করা হয় যে, বাংলাদেশে কেমন শক্তি ক্ষমতায় আসবে। তিনি নাম প্রকাশ না  করার শর্তে জবাব দেন, মানুষ এমন একটি শক্তিকেই স্বাগত জানাবে, যারা এ মুহূর্তে ইসলাম প্রতিষ্ঠা না করলেও দেশবাসীর জীবন থেকে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে না। ইসলাম প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করবে না। ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোয় গড়ে উঠা জীবনবোধকে ধর্মবিহীন বানাতে চেষ্টা করবে না। মসজিদ, মাদরাসা, আলেম, ওলামা ও ধর্মীয় নিদর্শনগুলোর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবে না। নাটক, সিনেমা ও মিডিয়ায় ইসলাম, কোরআন সুন্নাহ তথা নবী (স.)-এর সুন্নতকে উপহাস করার প্রবণতাকে প্রশ্রয় দেবে না। সর্বগ্রাসী মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ঘুষ দুর্নীতি মাদক ও বেহায়াপনার বিরুদ্ধে জনগণকে নিয়ে সামাজিক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে। বিদেশী আগ্রাসন ও অপশক্তির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা নেবে। সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, অনৈক্য, হানাহানি, অপসংস্কৃতি, নাস্তিক-মুরতাদদের ধর্মবিদ্বেষী কর্মকা- দমনে কঠোর পদক্ষেপ নেবে।

বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তার একটি মূল্যায়ন শুনতে চাইলে তিনি বলেন, যে যাই বলুক আর যাই ভাবুক, ইসলামই বিশ্বমানবতার অনিবার্য গন্তব্য। পৃথিবীতে শান্তি ও পরকালে মুক্তি পেতে হলে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শিক্ষা ও আদর্শের বিকল্প নেই। বিশ্বের জ্ঞানীগণ বলে গেছেন, আগামী দিনের আদর্শ ইসলাম। বিশ্ববাসী যদি শান্তি চায় তাহলে তাদের কর্তৃত্বভার হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর হাতে ন্যস্ত করতে হবে। জর্জ বার্নার্ড শ তো স্পষ্ট করেই বলেছেন, বিশ্বের সকল জাতি এক ও অসম শৃক্সখলায় এসে পরম তৃপ্তি ও সুখে থাকার পথ একটাই, যদি তারা নিজেদের সব ভালোমন্দের ভার ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর হাতে তুলে দেয়, আর তিনি ডিকটেটরের ন্যায় তাদের পরিচালিত করেন। পাশ্চাত্য মনীষীর এ উক্তিটির সম্পূরক একটি কথা বলে নেয়া ভাল যে, আল্লাহ ও তার সম্মানিত রাসূল (সা.)-এর কর্তৃত্ব ও হুকুম নির্দ্বিধায় মেনে নেয়ার নামই ইসলাম। আর নবী করিম (সা.)-এর নীতির উপর যে শাসন মুসলমানেরা বরণ করে নেয় তাতে কোন ডিকটেটরের স্থান নেই। এখানে আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশ নিরংকুশভাবে শিরোধার্য, যা মুসলমানেরা আবেগ, ভালোবাসা, আনুগত্য ও মমতার সাথে পালন করে নিজেকে ধন্য মনে করেন। মনের বিরুদ্ধে জোরজবরদস্তি কোন জীবন মুসলমানের অভিধানে নেই। মনের টান, প্রীতি, ভালোবাসা ও গভীর আবেগে মানুষ আল্লাহ-রাসূল তথা শরীয়ত তরীকত ও মারেফতের ভক্ত হয়ে ইহ ও পরজীবনের হাকীকত পর্যন্ত পৌঁছে যায়। বাংলার কবি কাজী নজরুল ইসলাম যাকে বলেছেন, তোর প্রেম দিয়ে কর সারাজাহান ইসলামে মুরিদ। এক ব্যক্তি থেকে শুরু হয়ে পাক ভারত বাংলা উপমহাদেশে আজ ৭০ কোটি মুসলমান এ নীতিরই ফসল।

ইসলামের সুন্দর আদর্শই বিশ্বের ১৭০ কোটি মানুষকে ইসলামের ছায়ায় ধরে রেখেছে। বিশ্বের বাকি মানুষেরাও জেনে না জেনে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইসলামের তথা নবী-রাসূলদের আদর্শই অনুসরণ করছে। পৃথিবীর সকল ধর্ম ও দর্শনে নীতি নৈতিকতা রীতি ও সামাজিকতার প্রতিটি ভালো দিক ইসলামের চিরন্তন সৌন্দর্যেরই বহিপ্রকাশ। বাংলাদেশ এই মহান জীবন ব্যবস্থার শান্তিময় উর্বর লালনক্ষেত্র। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ইসলামী রাষ্ট্র, শাসন ও বিচারব্যবস্থা কেউ চালু করবে, এমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এবং তাদের সাথে যুথবদ্ধ ১৪ কিংবা ১৮ দল, এরা কেউই ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা চালু করবে বলে মনে করার কোন কারণ নেই। বিশ্বপরিস্থিতি ও দেশীয় বাতাবরণও এই মুহূর্তে এর অনুকুলে নয়। পরিবেশ পরিস্থিতি পাল্টে গেলে এসব দলেরও ইসলামী রাষ্ট্র সরকার ও বিচার ব্যবস্থা চালুর কাজে আত্মনিয়োগ করা বিচিত্র কিছু নয়। পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মুসলমান অধ্যুষিত ৫৭টি মুসলিম রাষ্ট্রই রাষ্ট্র, রাজনীতি ও কর্মকৌশলের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য পদ্ধতি অনুসরণ করে চলেছে। যদিও জনগণের জীবনবোধ ও দৈনন্দিন সাংস্কৃতিতে ইসলামের প্রভাব অকল্পনীয়। এককথায় রাজনীতি ও বিশ্বব্যবস্থা বাদ দিলে বিশ্বের ১৭০ কোটি মুসলিমের জীবনে শরীয়তের নির্দেশনার প্রভাব অসাধারণ। মুসলমান সে যে দেশেই যে শাসন ব্যবস্থায়ই বাস করুক, তার জীবন ও সংস্কৃতির মূল নিয়ন্তা আল্লাহ ও রাসূল (সা.)- নির্দেশিত ইসলামী জীবনব্যবস্থা তথা ধর্মীয় মূল্যবোধ। ইসলামী খেলাফতের পর বৃটিশ, ফরাসী উপনিবেশ এমনকি সোভিয়েত শাসনাধীন মুসলিম জাতিসমূহ ক্ষেত্রভেদে একশ, দু’শ আড়াই’শ বছরব্যাপী বৈরি শাসনব্যবস্থার অধীনে থেকেও নিজেদের ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে দুনিয়াতে টিকে রয়েছে। রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থায় ইসলামী ভাবধারা বহাল হলে তারা বরং সুখীই হবে। বিচার ব্যবস্থায় দ্বীনি আদর্শ চালু হলে তারাই দ্রুত ন্যায় ও সুবিচার পাবে। সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যবস্থায় ইসলামী নীতি আদর্শ চালু হলে মুসলমানদেরই শান্তি নিরাপত্তা ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। আজ হোক কাল হোক পৃথিবীর সামনে এ সময়টি আসবেই। এটাই মানববিশ্বের অবধারিত নিয়তি।

বাংলাদেশে ইসলামে বিশ্বাসী মানুষ মূলত বৃহৎ অর্থে এ পথটিকেই পছন্দ করেন। তারা চান পূর্ণাঙ্গভাবে ইসলামের অনুসরণ। যতটুকু তাদের সাধ্যের ভেতর ততটুকু তো অবশ্যই। যতটুকু নেতৃবর্গের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল তা নিয়ে জনগণ আশাপোষণ ছাড়া আর কিইবা করতে পারে। তবে ব্যক্তিগত কিংবা পরিবার ও সমাজ জীবনে তারা ধর্মীয় মূল্যবোধ তথা ইসলামী জীবন ব্যবস্থার পবিত্র আবহেই থাকতে চায়। প্রচলিত ধারায় উদার গণতন্ত্র বা পরিশীলিত সেনা শাসন, যাই হোক না কেন দেশ ও জনগণের শান্তি ও সমৃদ্ধিই সাধারণ মানুষের কাম্য। বিশেষ করে ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের সুরক্ষা তাদের প্রধান স্বপ্ন। এককথায় মানুষ তার ধর্ম বিশ্বাস, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও চিরায়ত জীবনবোধের নিরাপত্তা চায়। এমনকি যারা কট্টর ইসলামপন্থী বা ধর্মীয় জীবনাচরণ বাস্তবায়নে প্রবলভাবে বিশ্বাসী তারা এখনই এই মুহূর্তে জনগণের উপর শরীয়তী রাষ্ট্র, সরকার ও শাসনব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়ার কথা বলেন না। তারাও জনগণের সামনে নিজেদের আদর্শ প্রচার করতে চান, নেতৃবর্গকে এ আদর্শ বাস্তবায়নের দাওয়াত দিতে চান, যখন মানুষ এটি গ্রহণ করবে তখনই দেশের সর্বস্তরে তা চালু করা সম্ভব। যেমনটি একজন মানুষের ঈমান আনা বা মুসলমান হওয়ার বেলায়ও প্রযোজ্য।

একটি রাষ্ট্র বা সমাজের ক্ষেত্রেও আদর্শ বেছে নেয়ার অধিকার এমন পদ্ধতিতেই স্বীকৃত। ইসলাম চাপিয়ে দেয়ার বা জোরজবরদস্তির বিষয় নয়। তবে কোন সমাজে যখন নিজের আদর্শ প্রচার বাধাগ্রস্ত হয় তখন এর অনুসারীরা স্বভাবতই নিজেদের বঞ্চিত ও নিগৃহীত বলে ভাবেন। এটা বস্তুত তাদের সাংবিধানিক অধিকারেরও লক্সঘন। সম্প্রতি কথা উঠেছে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করার। এটি একধরনের নিবর্তন। ধর্মহীন শক্তি তাদের প্রতিপক্ষের সাথে যুক্তিতে বা জনপ্রিয়তায় না পেরে অপর পক্ষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে। মানুষ যদি না চায় তাহলে ধর্মীয় রাজনীতি চলবে না। কিন্তু-নাস্তিক্যবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মবিদ্বেষ, সেকুলারিজম যে সমাজে চলবে সেখানে ধর্মীয় রাজনীতি চলতে দেয়া হবে না, এটা স্পষ্ট হঠকারিতা। গায়ের জোরে একটি পক্ষকে নক আউট করে দেয়া। গণতন্ত্রে সবাইকে মাঠে থাকতে দিতে হবে। জনগণ চাইলে তারা এগুবে না চাইলে পিছিয়ে পড়বে।

ইদানিং ঢাকায় ভারত ও পাকিস্তানের কিছু অতিথি নিয়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতির উপর সেমিনার অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এতে কিছু প্রসঙ্গ এমন এসেছে যা আলোচনা না করলে আমার বক্তব্য স্পষ্ট হবে না। আপনারা লক্ষ্য করে থাকবেন, খুব প্রবীণ, ধীরস্থির প্রকৃতির ক’জন দেশীয় বুদ্ধিজীবী ও গুণীজন এসব সেমিনারে বক্তব্য রেখেছেন। যারা বড় বড় অন্যায়, দুর্নীতি, কেলেংকারি, দমন-পীড়ন, দেশবিরোধী কার্যক্রম নিয়েও জোরে কথা বলেন না, তারা সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় রাজনীতি নিয়ে ছিলেন দৃষ্টিকটূ উচ্চকণ্ঠ। মনে হচ্ছিল তারা বেশ উত্তেজিত ও ক্ষিপ্ত। অথচ লক্ষ্য করলে দেখবেন, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সদ্ভাব প্রবাদতুল্য। ধর্মীয় রাজনীতি এদেশে রয়েছে নামমাত্র । বড় দুটি দলই বরং ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করছে। রাজনীতি ও নির্বাচনে ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করছে।  এসব না বলে ধর্মীয় নেতাদের বিরুদ্ধে অন্যায় বিষোদগার করলে জনগণ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠে। এসব বুদ্ধিজীবীদের তখন মানুষ আস্থায় নেয় না। এদের মনে করে দলীয় আজ্ঞাবহ বুদ্ধিজীবী। বিদেশী হালুয়া রুটির জন্য যারা ঢেকিও গিলতে পারেন। সাদাকে কালো বলতে পারেন। ঘোড়াকে বানাতে পারেন গাধা।

বিগত সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের কিছু কাজ সফলতার পরিচায়ক হলেও তাদের ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী। এর পেছনে প্রধান কারণ ছিল, দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষকে তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ সুরক্ষার বিষয়ে অভয় দিতে না পারা। কথায় ও আচরণে তাদের অনুভূতিকে নিরন্তর আহত করা। তাদের মনস্তত্ত্ব বা হৃদয়ের স্পন্দন ধরতে না পেরে কারণে অকারণে তাদের অন্তরে আঘাত লাগে এমন আচরণ ও মন্তব্য করা। গোটা আলোচনার মূল সুরটি ধরতে সক্ষম হলে গণবিরোধী এসব ছোট খাটো অথচ মারাত্মক ক্ষতিকর মন্তব্য, সিদ্ধান্ত ও আচরণ থেকে তারা সবাই বেঁচে থাকতে পারবেন, চলায় বলায় সতর্ক থাকতে পারবেন। যারা আগামী দিনে বাংলাদেশের ক্ষমতায় যেতে, থাকতে বা আবার আসতে চান সমাজ ও নাগরিক ধারার প্রভাবশালী নিয়ন্তা ধর্মীয় নেতৃত্বের শক্তি এবং উড়ন্ত সুবিবেচক ও কৌশলগত তিন/চার কোটি ভোটারের ক্ষমতাও তাদের সবসময়ই মনে রাখা চাই। ইনিকিলাব 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন