তালগাছ ঠিক থাকলে সবাই রাজি



আমাদের সময় ডটকম: যতই রাজনৈতিক সংকট ঘনিয়ে আসুক, সংঘাতের বিজলী চমকে উঠুক, বিচার মানি তালগাছ আমার এ পদ্ধতিতে সকল রাজনৈতিক দল অগ্রসর হচ্ছে। বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচাগ্র মেদিনী, এ সংকল্পে দৃঢ় থেকে সকল রাজনৈতিক দলের নেতারা হাসছেন ও টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে অগ্নিঝড়া আপোষহীন বক্তব্য রাখছেন। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার অতন্দ্র প্রহরীর মত নিশান বরদার হয়ে আছেন তারা। ফলে সংঘাত আরো প্রলম্বিত হচ্ছে, টানা অবরোধ আর সিরিজ হরতাল অপেক্ষা করছে সামনে। 


আপাত দৃষ্টিতে প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে প্রথম দফার ফোনালাপ সেরে নিলেও সংলাপে ইস্যুতে জামায়াতকে ছাড় দেবে না সরকার। তা সরকারের তরফ থেকে পরিস্কার করে জানিয়ে দেয়া হয়েছে সিপিবি ও বাসদ নেতাদের। বড় আশা নিয়ে গিয়েছিলেন তারা গণভবনে। এ আশায় গুড়ে বালি পড়বে জেনেও বিএনপি’কে বামধারার দল দুটির পক্ষ থেকে বুধবার রাতে একই আহবান জানিয়েছে। জামায়াত ছেড়ে আসতে চাইবে না বিএনপি বিষয়টি কারো অজানা নয়। তবুও রাজনৈতিক দলগুলো সবার কাছে একটা প্রচেষ্টা খাড়া করবার অথবা ভোটারদের মন রক্ষা করে তাদের আগামী নির্বাচনে কাছে টানার কৌশল হিসেবে এসব করছে। 

এতে দ্বিধাবিভক্ত রাজনীতির পথ বন্ধ হবে না। আরো বাড়বে। মৌলিক কিছু ইস্যু নির্ধারণ করে সকল রাজনৈতিক দল তাতে সায় দিয়ে আগাতে পারছে না। জাতীয় স্বার্থ, ভূ-কৌশলগত অবস্থান, সমুদ্র থেকে ভূমি উদ্ধার, প্রবাসীদের ক্ষুদ্র থেকে মাঝারি উদ্যোক্তা হিসেবে বিকাশ, মানবসম্পদ ব্যবহারে সর্ব্বোচ্চ নজর, সম্পদ সৃষ্টির কৌশল, স¯ত্মায় জ্বালানী উৎস খুঁজে বের করে রফতানিকারকদের সক্ষমতা বৃদ্ধির মত বিষয়গুলো নিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এক ও অভিন্ন চিšত্মাই করতে পারছে না। ফলে এসব পথ পরিক্রমা নির্ধারণ করে দিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদীদের এক ধরনের দোসর কিংবা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর এদেশীয় স্বার্থরক্ষাকারী শ্রেণী গোষ্ঠী। যে কারণে ইপিজেড বাড়ে কিন্তু বিসিক শিল্পের বিকাশ হয় না। 

অর্থনীতিতে উদ্যোক্তাবিহীন পরিবেশের পাশাপাশি রাজনীতিতে উন্নয়নের চাকচিক্যের আড়ালে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র সহ অনেক দেশই এখানে কোনো রকম স্থিতিশীল আর একটা গোঁজামিলের ব্যবস্থাপনায় নিজেদের স্বার্থকে সমুন্নত রাখতে চাইছে কেবল। এর সঙ্গে রয়েছে ভূ-কৌশলগত অবস্থান। জাতীয় নেতৃত্ব এবং রাষ্ট্রনায়োকচিত দূরদর্শিতার অভাবে একদিকে যেমন সংসদকে কার্যকর করে তোলা যায়নি তেমনি আগামী দিনের বাংলাদেশের ভবিষ্যত নতুন প্রজম্মের কাছে পরিস্কার করে তোলা হয়নি। এরফলে রাজনীতিতে অতীতের বিষয় টেনে এনে জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করে রাখার কৌশল নিয়ে রাজনীতিকরা শুধু পারস্পরিক দোষারোপ আর নিজেদের আখের গোছানোর মত চিšত্মায় ডুবে আছেন। এ অবস্থায় ক্ষমতার পট পরিবর্তন হলেও প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হচ্ছে না।  

সংলাপের নামে কিভাবে সংলাপ বাধাগ্র¯ত্ম হয় সেটাই যেন উভয় পক্ষের কাছে মোহনীয় হয়ে উঠেছে। এখানে ক্ষমতায় টিকে থাকা কিংবা ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের রাজনীতিতে রাজনীতি এতই ব্য¯ত্ম যে পরিস্থিতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আগামীদিনে দেশ পরিচালনায় নীতি ও কৌশল কি হবে তা ভোটারদের কাছে কোনো রাজনৈতিক দলই পরিস্কার করছে না। ভোটারদের একটা প্রস্তুতির মধ্যে ফেলে দিয়ে তাদের পছন্দসই প্রার্থী বেছে নেয়ার মত সুযোগ নেই কারণ কোনোধরনের ছায়া সরকার গত ৫ বছরে অনুপস্থিত ছিল। সমালোচনার রাজনীতি আছে কিন্তু বিকল্প পন্থা উদ্ভাবনের রাজনীতি নেই। বলতে হচ্ছে, তাই আগামীদিনে নতুন রাজনীতির কথা বলা হচ্ছে কিন্তু তা জনগণের কাছে পরিস্কার করা হচ্ছে না। 

লক্ষহীন রাজনীতিতে তাই দ্বিধাবিভক্ত রাজনীতিই ভরসা হয়ে উঠেছে। এজন্যে সংলাপের প্রয়োজন পড়ে না কিন্তু জনগণকে দেখাতে হয় যে সংলাপ নিয়ে উভয়পক্ষের আগ্রহ রয়েছে। এসব দেখতে দেখতে জনগণ একটা পর্যায়ে হাঁপিয়ে উঠবে এবং কোনো রকমে একটা নির্বাচন হয়ে গেলে যেন দায়বদ্ধতাহীন রাজনীতিতে অন্ধভক্তের মত ভোট দিয়ে সমর্থিত প্রার্থীর জয় পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য শেষ হয়ে যাবে। গণতন্ত্রের এ নমুনা কখনই এর প্রাতিষ্ঠানিক ভিত গড়ার ব্যাপারে সহায়ক নয়।  

এ পরিস্থিতিতে সরকার বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপে জামায়াতকে কোনোভাবেই গ্রহণ করতে রাজি নয়৷ এদিকে বিএনপির ওপর জামায়াত চাপ দিচ্ছে যে, তাদের নিয়েই সংলাপে যেতে হবে৷ তবে বিএনপি নেতারা বলছেন নতুন করে সংলাপের আমন্ত্রণ পেলেই তারা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন৷

বিএনপির প্রতিটি সমাবেশে জামায়াত শিবিরের নেতা কর্মীদের অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে আয়োজনটি পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। কখনো কখনো মঞ্চের সামনে আসন কিংবা স্থান দখল নিয়ে দুটিদলের কর্মীদের মধ্যে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের সংঘর্ষ ঘটে। যা রাজনৈতিক খুনসুটির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। ১৮ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে  সরকার-বিরোধী আন্দোলনে বিএনপি জামায়াতের ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে৷ ২৫ অক্টোবর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৮ দলের সমাবেশে সামনের দিকেই অবস্থান নিয়েছিল জামায়াত শিবিরের কর্মীরা৷ সমাবেশ শুরু হয়েছিল শিবির নেতার বক্তব্য দিয়ে৷ সমাবেশে জামায়াত নেতারা জোর দিয়েই বলেছেন সংলাপ হতে হবে ১৮ দলীয় জোটের সঙ্গে৷ আর খালেদা জিয়া তাঁর বক্তৃতায় বলেন ক্ষমতায় গেলে আটক রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি দেয়া হবে৷ সেদিন জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা যুদ্ধাপরাধের দন্ডপ্রাপ্ত শীর্ষ জামায়াত নেতাদের মুক্তির দাবিতে তাদের ছবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ডে ভরে ফেলে সমাবেশ স্থল৷

রাজনৈতিক এ বা¯ত্মবতায় মহাজোট সরকারের অংশীদার হয়ে বাম ঘরানার দলগুলো সরকারকে কতটা সঠিক বুদ্ধি ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে এবং গণতন্ত্রের জন্যে তা কতটা সহায়ক সে নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সরকারের অনেক সিদ্ধাšেত্মর প্রকাশ্যে মৃদু সমালোচনা করে দায়িত্ব শেষ করেছে ক্ষমতার অংশীদার বামদলগুলো। এসব দলের কাছ থেকে রাজনৈতিক সংকট নিরসনে ও সকল দলের অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে একটা অর্থবহ নির্বাচন করার একটা কৌশল রচনায় আরো বড় ধরনের ভূমিকা আশা করছিলেন অনেকে। 

সকল দলের অংশগ্রহনের মধ্যে দিয়ে আগামী নির্বাচন যাতে না হয় সেজন্যে বিএনপি ভেঙ্গে নতুন আরেকটি বিএনপি করার একটা প্রক্রিয়া মাঝে মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। যে পাকি¯ত্মানে সামরিক শক্তি রাজনীতির দাবা খেলতে যেয়ে দেশটির রাজনীতির বারোটা বাজিয়ে আপাতত ক্ষাšত্ম দিয়ে বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি অনুসরণ করে একটি সফল নির্বাচন করার ব্যাপারে সায় দিয়েছে, অথচ বাংলাদেশে রাজনীতিতে এধরনের অহেতুক আগ্রহ এখনো শেষ হয়নি। গণতন্ত্র চাইলে সকল দলকেই রাজনীতিতে একটা অভিন্ন পথে হাঁটতে শিখতে হবে তা হচ্ছে জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে কোনো আপোষ না করা। এ পরিক্রমা তৈরি না হলে বাইরের এবং ভেতরে তাদের এজেন্টরা রাজনীতিতে মাথা ঘামাবার চেষ্টা করবেই। কখনো কখনো তারা সংস্কারপন্থী হয়ে উঠবেন। মাইনাস টু কিংবা মাইনাস ওয়ান ফরমুলা দেবার অপচেষ্টা করবেন। 

এতকিছুর পরও যদি বর্তমান সংবিধানের অধীনেই আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে ধরে নিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে থাকে নির্বাচন কমিশন, তা হবে নির্ধারিত সময়েই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি। এজন্যে অনুগত রাজনৈতিক দলগুলোর একটা প্রস্তুতি প্রয়োজন। তবে সংসদ বহাল থাকবে এবং মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা পদে থেকেই নির্বাচন করতে পারবেন৷ আর তা বিবেচনায় রেখেই নির্বাচনে প্রার্থীদের খসড়া আচরণবিধি প্রকাশের পর নতুন করে একই দলের প্রার্থীদের মধ্যে রেষারেষি ও সংঘর্ষের পথও তৈরি করে দেয়া হয়েছে। দলের মনোনয়ন পেলেও মাঠের রাজনীতিতে এগিয়ে থাকা ও পিছিয়ে থাকা প্রার্থীদের মধ্যে ফাইনাল রাউন্ড এখনো শুরু হয়নি। শুধু বলা হচ্ছে, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যরা যাঁরা পদে থেকে নির্বাচন করবেন তাঁরা সরকারি সুযোগ সুবিধা ব্যবহার করে নির্বাচনি প্রচার প্রচারণা বা নির্বাচনি কোনো ধরণের কাজ করতে পারবেন না৷ তাঁরা যখন সরকারি কোনো কাজে যাবেন তখনও নির্বাচনের কাজ করতে পারবেন না৷

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ আস্থায় রয়েছেন এই ভেবে যে নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচন এবং গেজেট প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত সরকার কেবল তার রুটিন কাজ করবে, কোনো নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না৷ প্রশাসনে কোনো রদবদল বা পরিবর্তন হবে নির্বাচন কমিশনের পরামর্শে৷কিন্তু সে গ্যারান্টি তাকে কে দিয়েছে তা বলা মুস্কিল। তবে এই নির্বাচন কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহ ও বিরোধী দলের কাছে তাদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই, বিষয়টি এখন পরিস্কার৷ 

এদিকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মনোনয়নের কাজ শুরু করে দিয়েছে৷ দলের নেতা তোফায়েল আহমেদ জানিয়েছেন সরকার নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে৷ এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয়েছে৷ বিএনপি চাইলে এই সরকারে যোগ দিতে পারে৷ অন্যদিকে, বিএনপি সরকার বিরোধী আন্দোলন আরো তীব্র করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ তিন দিনের হরতালের পর ৪ নভেম্বর থেকে টানা তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচিতে যাচ্ছে বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী ১৮ দলীয় জোট৷ তারা শুধু নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় নয়, একতরফা নির্বাচন প্রতিহত করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী অšত্মর্বর্তী সরকারের প্রধান না হয়ে সরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কারণ তিনি এর আগে কখনো বলেননি যে তার অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। সেখানে দায়িত্ব নিতে পারেন রাষ্ট্রপতি কিংবা স্পিকার। তা যদি বিরোধীদলের কাছে গ্রহণযোগ্য না হয় তাহলে অনুগত বিরোধীদলগুলোই সরকারের একমাত্র ভরসা। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন