দুই মাসের মাথায় ৪ মামলায় জামিনে মুক্তি
নিজস্ব প্রতিবেদক
মাত্র দুই মাসের মাথায় একে একে ৪ টি মামলায় জামিন পেয়ে কারাগার থেকে বের হয়ে গেছেন বহুল আলোচিত রোহিঙ্গা জঙ্গী সালাউল ইসলাম। মঙ্গলবার সর্বশেষ মামলায় জামিন পাওয়ার পর দ্রুত তাকে কারাগার থেকে বের করে নিতে খোদ ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতা দৌঁড়ঝাপ শুরু করেন। তাদের ব্যাপক তদবীরে মঙ্গলবার বিকালেই কক্সবাজার জেলা কারাগার থেকে তিনি বেরিয়ে যান বলে নিশ্চিত করেছেন ডেপুটি জেলার মোহাম্মদ জাবেদ।
কারাগার থেকে বের হওয়ার পর পরই তিনি মোবাইল ফোনে কথা বলেন মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে। এসময় তিনি দেশের বাইরে চলে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যেই তিনি দেশের বাইরে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। এদিকে মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে সালাউল ইসলামের মতো বহুল আলোচিত রোহিঙ্গা জঙ্গী জামিনে বের হয়ে আসায় নানা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে যে কোন মুর্হূতে এই জঙ্গী দেশ থেকে পালিয়ে যেতে পারেন বলে আশংকা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, সালাউল ইসলাম ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে মিয়ানমার বিদ্রোহী সংগঠন আরএসও’র সাথে জড়িয়ে যান। আরএসও’র অর্থায়নে তিনি কক্সবাজারের হ্নীলা জামেয়া দারুসুন্নাহ, জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়াসহ বেশ কয়েকটি মাদ্রাসায় পড়াশুনা করার পর সৌদি আরব চলে যান। আরএসও’র মাধ্যমেই সৌদি আরবের বিভিন্ন গোষ্ঠীর সাথে তার স¤পর্ক তৈরী হয়। এর পরই বাংলাদেশে আরএসও’র কার্যক্রমে মূল দায়িত্বে চলে আসেন সালাউল। মূলত: আরএসও’র সামরিক ও অর্থ বিভাগের সমন্বয় করতেন তিনি। এসব কাজ করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের ধনকুবের ও জঙ্গি গোষ্ঠীর আস্থাভাজন হয়ে উঠেন সালাউল। পরে মধ্যপ্রাচ্যের ধনকুবের ও জঙ্গি গোষ্ঠীর অর্থায়নে কক্সবাজার, উখিয়া, টেকনাফ, রামু ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকায় রোহিঙ্গাদের মাঝে কাজ শুরু করেন তিনি। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে কক্সবাজারের লিংক রোডের দক্ষিণ মহুরীপাড়া এলাকায় মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক আল হারামাইন সংস্থার (আল হারামাইন বর্তমানে দেশে ও বিভিন্ন দেশে জঙ্গী কর্মকান্ডের জন্য নিষিদ্ধ) আড়ালে তিনি আস্তানা গাড়তে শুরু করে। ওই এলাকায় কক্সবাজার শহরের টেকপাড়ার দানবীর দুলা মিয়ার কাছ থেকে মসজিদ স্থাপনের নামে ১০ শতক জমি চেয়ে নেয় সালাউল। আর ওই ১০ শতক জমিতে ভর করে দুলা মিয়া এবং এলাকার কয়েকশ মানুষের বসতবাড়ী উচ্ছেদ করে প্রায় ৩ একর সরকারী পাহাড়ী জমি দখল করে নেন তিনি।
নির্বিচারে পাহাড় কেটে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে ‘ইমাম মুসলিম (রা:) ইসলামিক সেন্টার’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে ছোট-বড় ও কাঁচা-পাকা ১১টি স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। পাহাড় কেটে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে সালাউলের প্রাসাদতুল্য বাড়ী। এসব দখল-বেদখল কাজে তিনি স্থানীয় একটি সন্ত্রাসী চক্রকে ব্যবহার করেন। সালাউল তাদের আরএসও’র অস্ত্র, অর্থ ও মোটর সাইকেল যোগান দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন অপরাধ সংঘঠিত করে সালাউলের আস্তানায় আশ্রয় নিয়ে থাকে। এসব সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের ভয়ে এলাকাবাসী তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পাননা বলে জানান এলাকার লোকজন। এছাড়া ক্ষমতাসীন দলের কয়েক জন নেতার সাথে সখ্য গড়ে তোলে তাদের ব্যবহার করেন তিনি। এলাকাবাসী অভিযোগ করে জানান, ওই প্রতিষ্ঠানে রাতের বেলায় জঙ্গি প্রশিক্ষণ চলে। নিয়মিত সেখানে আসা-যাওয়া করে রোহিঙ্গা এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের লোকজন। এদের চলাফেরাও সন্দেহজনক। এছাড়া ওই প্রতিষ্ঠানের মাদ্রাসা, হাফেজখানা এবং এতিমখানায় রোহিঙ্গাদের লেখাপড়া করানো হয়। সেখান থেকে অনেক রোহিঙ্গাকে জামায়াত-শিবিরের কর্মসূচীতে পাঠানো হয় বলে অভিযোগ করেন এলাকাবাসী। কক্সবাজার সরকারী কলেজ ছাত্রাবাসের সাবেক কর্মচারী হাকিম জানান, কলেজের ২/৩ জন কর্মচারীসহ শতাধিক পরিবারকে সালাউল সন্ত্রাসীদের দিয়ে উচ্ছেদ করিয়েছে। এলাকাবাসী তাদের জঙ্গি কার্যক্রমের প্রতিবাদ জানালে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রছায়ায় থাকা কিছু সন্ত্রাসীকে এলাকাবাসীর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয় তারা। এ ভাবে ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় থেকে এ অঞ্চলে সবচেয়ে বড় রোহিঙ্গা ঘাঁটি তৈরী করে নিয়েছে ছালাউল ইসলাম। আর কক্সবাজারের লিংক রোডের ‘ইমাম মুসলিম (রা:) ইসলামিক সেন্টার’ এর সেই আস্তানায় বসেই সালাউল টেকনাফে মাওলানা আফছার উদ্দিন, নাইক্ষ্যংছড়িতে শফিউল্লাহ, রামুতে ইউনুছ সহ আরো ১০/১২ জন সহযোগির মাধ্যমে তার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বছরে কয়েক দফা তিনি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করেন। এসব দেশ থেকে রোহিঙ্গাদের খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা ও পূর্নবাসনের জন্য বিপুল পরিমান টাকা দেশে আনা হয় হুন্ডির মাধ্যমে। এসব টাকার সিংহ ভাগ ব্যবহার করা হয় জঙ্গী কর্মকান্ডে। তার কর্মকান্ড নির্বিঘœ করতে তিনি কৌশলে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ব্যবহার করে থাকেন। এসব নেতাদের নগদ টাকা, গাড়ি, গরু-ছাগল থেকে শুরু করে অনেক কিছুই উপঢৌকন দিয়ে থাকেন বলে প্রচার আছে। যার কারণে সালাউল আটক হওয়ার পর পরই তাকে ছেড়ে দিতে তদবীর শুরু হয়। তাকে ছেড়ে দিতে টেকনাফ থানা থেকে শুরু করে কক্সবাজার সদর মডেল থানা ও জেলা পুলিশেও তদবীর চালানো হয়। কিন্তু উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা তাকে ছাড়তে রাজী হননি। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বাবুল আকতার জানিয়েছিলেন, সালাউলের মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা গুলো মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের। ওই সব বার্তায় সরকার পরিবর্তনের দোয়া সহ উদ্বেগজনক তথ্য পাওয়া গেছে। এসব জিঙ্গাসাবাদের জন্য রিমান্ডের পর জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলেও নেওয়া হয়েছিল জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। কিন্তু অসুস্থতার কারনে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব হয়নি। এসব অভিযোগ এখনো পুলিশ যাচাই-বাছাই করছে। এর মধ্যেই মাত্র দুই মাসের মাথায় ৪টি মামলায় দ্রুত জামিন পান ওই জঙ্গী। রাষ্ট্র পক্ষের নিয়োজিত আইনজীবী কক্সবাজারের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এডভোকেট মমতাজ আহমদ সাংবাদিকদের জানান, কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোকতার আহমদ আটক আসামী সালাউলের একে একে ৩ টি মামলার জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন। পুলিশের দুর্বল প্রতিবেদনই তার দ্রুত জামিনের কারণ বলে জানান তিনি।
এর পর কক্সবাজার সদর মডেল থানার আরো একটি মামলায় (জিআর-১১৪/১৩) গত রবিবার তাকে শ্যোন এরেষ্ট দেখানো হয়। সর্বশেষ মঙ্গলবার কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট নিলুফার শিরিন কক্সবাজার সদর মডেল থানার জিআর-১১৪/১৩ নম্বর মামলার জামিন মঞ্জুর করেন।
উল্লেখ্য, গত ২১ মার্চ কক্সবাজারের টেকনাফের একটি মাদ্রাসার গোপন বৈঠক থেকে পুলিশ তাকে আটক করেছিল। হাফেজ সালাউল ইসলাম (৫০) নামের এই রোহিঙ্গা জঙ্গীকে পুলিশ আদালতে চালান দিয়েছিল গত ১৫ ফেব্র“য়ারি কক্সবাজার শহরে জামায়াত-শিবিরের সহিংস ঘটনায় তিন জনের প্রাণহানি সহ বিষ্ফোরক ও সন্ত্রাস দমন আইনে দায়েরকৃত তিনটি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে। সেই সাথে জামায়াত-শিবিরের নাশকতায় অর্থ যোগান, রামুর বৌদ্ধ পল্লীর হামলা ও সহিংসতায় রোহিঙ্গা সরবরাহ, আন্তর্জাতিক জঙ্গী কানেকশন সহ আরো বিভিন্ন অভিযোগের কথাও পুলিশের ফরোয়ার্ডিংয়ে উল্লেখ করা হয়েছিল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন