ঘোরতর সংকটে কওমি মাদরাসা শিক্ষা

আবদুল হালিম: 
ঢাকায় ৫ মে হেফাজত ইস্যুতে সৃষ্ট সহিংসতা, সহিংসতা পরবর্তী মামলা এবং গ্রেফতারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন দেশের কওমি মাদরাসার অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষার্থী। মাদরাসায় শিক্ষক না আসা এবং অনেক মাদরাসা বন্ধ থাকায় ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক পাঠদান কার্যক্রম।


এদিকে আগামী ১১ জুন থেকে মাদরাসাগুলোতে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা লুকিয়ে, পালিয়ে এবং আত্মগোপনে থাকায় পরীক্ষা নিয়ে তৈরি হয়েছে শঙ্কা। পরীক্ষার দিন যত এগিয়ে আসছে ততই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অভিভাবকদেরও বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। পরীক্ষা আদৌ হবে কীনা বা হলে কীভাবে হবে, শিক্ষার্থীরা কীভাবে অংশ নেবে এসব বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থীদের মতো যারপরনাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অভিভাবকরাও।

শিক্ষক-ছাত্রদের গ্রেফতার আতঙ্কের পাশাপাশি হেফাজতের সমাবেশের দিন ঢাকার সহিংসতা দেখে অনেক অভিভাবকও কওমি মাদরাসা থেকে তাদের সন্তানদের সরিয়ে নিচ্ছেন পরীক্ষার কথা চিন্তা না করে। ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা শঙ্কিত। তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। সবমিলিয়ে ঘোর সংকটে পড়েছে দেশের কওমি মাদরাসা শিক্ষা।

৭টি স্তরে কওমি মাদরাসার কেন্দ্রীয় পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। ২৩ মে কওমি মাদরাসা কর্তৃপক্ষ প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের সঙ্গে দেখা করে ৭০ হাজার পরীক্ষার্থী নিরসনে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকুর সঙ্গেও তারা দেখা করেছেন। প্রতিমন্ত্রীর পক্ষ থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের হয়রানি করা হবে না মর্মে আশ্বাস দেওয়া হলেও তারা আশ্বস্ত হতে পারছেন না।

গত ৫ মে হেফাজতের রাজধানীর মতিঝিলের সমাবেশকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া সহিংসতায় ৫ শতাধিক ব্যক্তির নাম উল্লেখসহ দেড় লাখের বেশি শিক্ষক শিক্ষার্থীর নামে সারাদেশে ৪৫টি মামলা হয়েছে। এরই মধ্যে কিছু শিক্ষক গ্রেফতার হয়েছেন। পালিয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকে। এ আতঙ্ক বিরাজ করছে দেশের সর্বত্র। এ বিষয়ে সরকার বলছে, ঢাকায় হেফাজতের অবস্থান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংস ঘটনার সঙ্গে সুনির্দিষ্ট মামলায় গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত থাকবে। তবে এটা মাদরাসা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান বা ব্যবস্থা নয় বলেও সরকার স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে।

দেশের কওমি মাদরাসাগুলোর নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে নেই। ফলে নেই কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণ কাঠামো। তবে মাদরাসাগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে বেসরকারি উদ্যোগে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড। ঢাকার বাইরে ৫টি আঞ্চলিক শিক্ষাবোর্ড রয়েছে। ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত বোর্ডের চেয়ারম্যান আল্লামা আহমদ শফী। তারই নেতৃত্বে হেফাজতে ইসলাম সম্প্রতি লংমার্চ, ঢাকা অবরোধসহ অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। অবস্থান কর্মসূচির দিনে রাজধানী ঢাকায় স্মরণকালের ইতিহাসে ব্যাপক সহিংস ঘটনা ঘটে। পুরানা পল্টন, দৈনিক বাংলা, বায়তুল মোকারম মার্কেট এবং মতিঝিলে উন্মত্ত তান্ডব চলে। ওই ঘটনার পর থেকে হেফাজত নিজেদের নির্দোষ দাবি করে আসছে। তাদের দাবি এ ঘটনা ছাত্রলীগ ও যুবলীগ ঘটিয়েছে। অন্যদিকে সরকার বলছে এ ঘটনায় হেফাজতের উগ্র একটি অংশের সঙ্গে বিএনপি এবং জামায়াত ও শিবিরও জড়িত। বিএনপি-জামায়াতের যোগসাজশে হেফাজত এই তান্ডব চালিয়েছে। তবে এখনো পর্যন্ত হেফাজতের পক্ষ থেকে তাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিখোঁজ থাকার বিষয়ে কোনো দাবি জানানো হয়নি।

এমনকি তারা নিখোঁজদের কোনো তালিকাও দেয়নি। যদিও বিভিন্ন মহল থেকে ৫ মে রাতে ‘অপারেশন শাপলা চত্বরে’ সহস্রাধিক (এমনকি তিন থেকে সাড়ে ৩ হাজার) হেফাজত কর্মীকে হত্যার অভিযোগ তোলা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগের সপক্ষে তালিকা দিতে বললেও হেফাজত এখনো তালিকা দেয়নি।

অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বিবিসিকে বলেছেন, ‘মাদরাসার বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঢালাও কোনো অভিযোগ নেই। যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে কেবল তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।’

কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের মহাসচিব মাওলানা আবদুল জব্বারও স্বীকার করেছেন, শিক্ষক, ছাত্রদের মধ্যে গ্রেফতার আতঙ্কের কারণে তাদের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রমে সমস্যা হচ্ছে। মামলার ভয়ে অনেক মাদরাসায় শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আসছে না। মামলার বিষয়ে আবদুল জব্বার বলেন, ‘মামলায় সুনির্দিষ্টভাবে কয়েকশ জনের নাম আছে। আর নাম ছাড়া অভিযুক্তের সংখ্যা ১০ হাজার।’ এ কারণে সবার মধ্যে ভীতি ও আতঙ্ক কাজ করছে বলে তিনি মনে করেন। তবে ধরপাকড়ের ভয়ে দু-একটি মাদরাসা বন্ধ থাকার কথা তিনি শুনেছেন বলে জানান।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কোনো তথ্য নেই : দেশের কওমি মাদরাসা ও এর শিক্ষা নিয়ে সরকারের কাছে কোনো তথ্য নেই। ব্যানবেইসের গবেষণায় দেখা গেছে দেশে কওমি মাদরাসার সংখ্যা ৫ হাজার ২০০। এতে অন্তত ১৪ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। এসব মাদরাসা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ১৯টি শিক্ষাবোর্ড রয়েছে। ওই গবেষণার সুপারিশে কওমি শিক্ষা ব্যবস্থাকে সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার মতো সরকারের আওতায় আনার কথা বলা হয়েছিল।

গবেষণায় সহায়তা করে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। ব্যানবেইস কওমি মাদরাসাগুলোর ওপর নমুনা জরিপে আরো দেখতে পায়, মাদরাসাগুলোর মধ্যে ৭৫ ভাগ মাদরাসায় কেবল ছাত্র এবং ২১ দশমিক ৬৯ শতাংশ ছাত্রীরা পড়ে। ৩ দশমিক ৩১ শতাংশ মাদরাসায় ছেলেমেয়ে একসঙ্গে পড়াশোনা করে। আর মাদরাসার মোট শিক্ষকের মধ্যে ১০ দশমিক ২১ শতাংশ নারী শিক্ষক রয়েছেন। তবে ব্যানবেইসের কর্মকর্তারা এ জরিপ দিয়ে দেশের কওমি মাদরাসার প্রকৃত চিত্র বোঝা সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেছেন। একেক মাদরাসায় একেক ধরনের চিত্র পাওয়া যাওয়ায় সামগ্রিকভাবে এই জরিপের ফলাফলে দেশের কওমি শিক্ষা ব্যবস্থার একটি সাধারণ ধারণা পাওয়া যায় মাত্র।

হেফাজত নেতারা গ্রেফতার : খুলনায় গ্রেফতার হয়েছেন ঢাকা মহানগর হেফাজত নেতা মাওলানা মামুনুল হক, ১৯ মে ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন লালবাগ মসজিদের খতিব ও মিরপুর খাদেমুল ইসলাম মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা ইমরান মাজহারী, ভাইস প্রিন্সিপাল মিজানুর রহমান ও জামিউল উলুম মাদরাসার প্রিন্সিপাল আবুল বাশার। হেফাজত কর্মকান্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় মিরপুরের একটি মসজিদের খতিব ও ইমামকে বহিষ্কার করেছে মসজিদ কমিটি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসায় কোনো সমস্যা না হলেও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় মাদরাসায় পুলিশি হয়রানির অভিযোগ করেছেন অনেকে।

কক্সবাজার জেলার শতাধিক মাদরাসা শিক্ষক মামলার আসামি হয়েছেন। আটক হয়ে কারাগারে রয়েছেন অর্ধশতাধিক মাদরাসা শিক্ষক। গ্রেফতার আতঙ্কে আত্মগোপনে রয়েছেন আরো কয়েকশ শিক্ষক ও ছাত্র। ফলে হাজার হাজার মাদরাসা শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। শুধু শিক্ষক নয় আসামি হয়েছে কয়েকশ মাদরাসা ছাত্র।

, ঢাকা অবরোধ কর্মসূচির পর থেকে মামলা আর পুলিশি হয়রানির ভয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চরম আতঙ্কে ভুগছেন হেফাজত ইসলামের নেতাকর্মী। এখনো চিকিৎসাধীন আছেন সংগঠনের অনেক নেতাকর্মী। পরবর্তী কর্মসূচি এড়িয়ে চলার কথা ভাবছেন তাদের কেউ কেউ। অন্যদিকে কঠোর গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে নেতাদের।

যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছবি চাঁদে দেখা গেছে এমন গুজব ছড়িয়ে জামায়াত-শিবির ৩ মার্চ বগুড়ায় ব্যাপক সহিংসতা চালায়। জেলার বিভিন্ন প্রান্তে সংঘটিত এসব সহিংস ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আসামির তালিকায় রয়েছেন শতাধিক মাদরাসা শিক্ষক। এ তালিকায় কয়েকজন স্কুল শিক্ষকও রয়েছেন। মামলা দায়েরের পর থেকেই শিক্ষকদের অধিকাংশই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত রয়েছেন। ফলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

আমাদের যশোর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, হেফাজত ইসলামের মহাসমাবেশে ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগসহ শাপলা চত্বর এলাকায় ক্ষয়ক্ষতির ঘটনায় যশোরের ২ মাদরাসা শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং আরো ১১৭ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে। এ ঘটনায় ওইসব শিক্ষক চাকরি নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।

হেফাজত ইসলামের আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন ময়মনসিংহের কওমি মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি, পুলিশি তল্লাশিতে গ্রেফতার আতঙ্ক বিরাজ করছে মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে। ফলে অনেকেই নিয়মিত মাদরাসায় যেতে পারছেন না। এতে আসন্ন বার্ষিক পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ছন্দপতন ঘটেছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের।

জানা গেছে, হেফাজত ইসলামের মতিঝিল ইস্যুতে দেশের লক্ষাধিক নেতাকর্মীকে আসামি করে রাজধানীতে মামলা হয়। এ মামলার পর থেকেই গ্রেফতার আতঙ্কে দিন-রাত কাটাচ্ছেন ময়মনসিংহের কওমি মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তবে ময়মনসিংহে হেফাজতের নামে কোনো কমিটি নেই।

গাইবান্ধায় স্কুল-কলেজ ও মাদরাসার শতশত শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান প্রধান গ্রেফতারের ভয়ে এখন গা-ঢাকা দিয়ে আছেন। তারা নিয়মিত প্রতিষ্ঠানে হাজির হন না। তাই ওইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন শিক্ষক সংকটে পড়েছে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম বিঘিœত হচ্ছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন