‘হলুদ ফুলের দেশ’ কক্সবাজার

ডেস্ক রিপোর্ট :
সারা বিশ্বের দরবারে অতি সুপরিচিত নাম কক্সবাজার। সারা বছরই দেশী-বিদেশী পর্যটকদের পদচারণায় মুখর থাকে এই সুদীর্ঘ বালুকাময় বেলাভূমি। গভীর অরণ্য আচ্ছাদিত অনুচ্ছ শৈলশ্রেণী, নদী আর সাগর কক্সবাজারকে করেছে মোহনীয়। কক্সবাজারের প্রাচীন নাম ছিল ‘পালংকী’।

অনেকের মতে এর নাম ছিল প্যানোয়া অর্থাৎ হলুদ ফুলের দেশ। ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দ ইংরেজ অফিসার ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স এর স্মরণে এর নামকরণ করা হয় কক্সবাজার। আরাকান রাজবংশীয় উপাখ্যান রাদজা-তুয়েতে এরূপ তথ্য পাওয়া যায় যে, আরাকান রাজ সুলথ ইঙ্গ-চন্দ্র ‘সুরতন’ বিজয়ে অভিযান পরিচালনা করেন এবং সেখানে একটি বিজয় ¯ত্মম্ভ স্থাপন করেন। উক্ত ¯ত্মম্ভে রাজা কর্তৃক ‘চেত্তগৌং’ বাক্যটি উৎকীর্ণ করা হয়। এর অর্থ ‘যুদ্ধ করা অনুচিত’ এ ঘটনার সময় নিরূপণ করা হয়েছে ৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ। অতএব, দেখা যায় নবম শতাব্দীতে কক্সবাজারসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাšিত্ম দেবের অধীন এবং দশম শতাব্দীতে আরাকান রাজ্যের শাসনাধীন ছিল। তাই সাংস্কৃতিক জীবনধারায় প্রভাবিত হয় কক্সবাজারের আদি জনগোষ্ঠী বিশ্বাস-চেতনা, নৈতিকতা ও প্রত্যয়, রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান, উৎসব-অনুষ্ঠান, পোশাক-পরিচ্ছদ, পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতায় তাদের জীবন নিয়ন্ত্রিত হয়। এর ইতিহাস আরাকান, ত্রিপুরা বা বাংলার ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বৃহত্তর চট্টগ্রামের একটি জেলা কক্সবাজার। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যšত্ম আরাকান রাজ্যের অধীন ছিল। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানÑ এ চার ধর্মাবলম্বীর আবাসভূমি কক্সবাজার। নৃতত্ত্ববিদ প-িতদের মতে, সুপ্রাচীনকালে আলপাইন, অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, ভোট চীনা, মঙ্গোল প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে কক্সবাজারসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের আদিম জনগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। প্রাচীন যুগে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী বা উপজাতিসমূহের মধ্যে পাহাড় জঙ্গল কিংবা নদী তীরে বসতি স্থাপন করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। পাহাড়-জঙ্গলে কিংবা নদী তীরবর্তী স্থানে খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ বা উৎপাদন করা সহজসুলভ ছিল বলেই এরা এসব স্থানে বসবাস করতে প্রলুব্ধ হয়েছে। এ কারণে প্রাচীনকালে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর লোকজন খাদ্যদ্রব্যের সন্ধানে এক স্থান অন্য স্থানে গমনা গমনে অভ্য¯ত্ম ছিল। তাদের জীবনযাত্রা ছিল অনেকটা যাযাবর প্রকৃতির। লেখক মাহবুবুল আলমের মতে, উত্তর দিক থেকে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর লোকজন দক্ষিণগামী জনগোষ্ঠীর লোকজন চট্টগ্রাম-কক্সবাজার তথা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসতি স্থাপনে বাধ্য হয় এবং তাদের যাযাবর জীবনেও অনেকটা সুস্থিরতা নেমে আসে। কালে কালে এসব জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে এতদঞ্চলে কিছু কিছু ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের গোড়াপওন হয়। বার্মা দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে তেলে ইঙ্গ জাতিগোষ্ঠীর ‘মান’ নামক একটি শাখার প্রবল বাধার মুখে আরাকান থেকে উত্তরদিকে গমনোদ্যত ‘খউংখা’ জাতিগোষ্ঠী কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করতে বাধ্য হয়। তবে এসব জাতিগোষ্ঠীর ইতিহাসও অনেকটা অস্পষ্ট। উল্লিখিত বিবরণী থেকে এটা নিশ্চিতভাবে ধারণা করা যায় যে, দক্ষিণের আরাকান এবং উত্তরের ত্রিপুরা-চট্টগ্রাম অঞ্চলের লোকজনের মিলন কেন্দ্র ছিল কক্সবাজার। বাঙালির প্রার্থিত স্বাধীনতা অর্জনের পর সারা দেশে সাংস্কৃতিক নাট্যাঙ্গনে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে তার দোলা কক্সবাজারেও এসে লাগে। স্বাধীনতার পর অনেক তরুণ ও প্রতিশ্রুতিবান যুবকরা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আবির্ভূত হয়। এদের মধ্যে যে সংগঠনটি গড়ে ওঠে সেটি হলো ‘পিনাক শিল্পীগোষ্ঠী’।
তার পরপরই এ সংগঠনের মাঝ থেকে জন্ম নেয় কক্সবাজারে প্রথম গ্রুপ থিয়েটার সংগঠন ‘ব্যতিক্রম’। তখন কক্সবাজারের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের একমাত্র কেন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরি হল হয়ে ওঠে কর্মচাঞ্চল্যমুখর। সত্তর দশকে আরো কয়েকটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। সেগুলো হচ্ছে রংবেরং নাট্য সম্প্রদায়, ঝঙ্কার শিল্পীগোষ্ঠী, গাঙচিল, এক পা সামনে, ঝিনুক শিল্পীগোষ্ঠী, সমকাল নাট্য ও সাহিত্য সম্প্রদায়, সপ্তরূপা, পূর্বাচল প্রভৃতি। এর পাশাপাশি কক্সবাজার কলেজ ও মহকুমা প্রশাসনের উদ্যোগে বিভিন্ন জাতীয় দিবস উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন সাংস্কৃতিক ভুবনকে আরো সমৃদ্ধ ও প্রসারিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কক্সবাজার জেলার ৮টি উপজেলার মধ্যে রামু ও চকরিয়া উপজেলার সাংস্কৃতিক কর্মকা- অত্যšত্ম আশাব্যঞ্জক। চকরিয়ার মালঞ্চ সঙ্গীত একাডেমি কবি অধ্যাপক রাহগীর মাহমুদের পরিচালনায় প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যেই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। জেলার মধ্যে ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে রামুর স্থান দ্বিতীয়। দূর্বার শিল্পীগোষ্ঠী, সলো শিল্পীগোষ্ঠী, হেমšিত্মকা শিল্পীগোষ্ঠী, রামুর সাংস্কৃতিক অঙ্গনের উজ্জ্বল নাম। সুষ্ঠু আবৃত্তি ও পরিশীলিত উচ্চারণ শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে ১৯৮৫ সালে স্থাপিত হয় কক্সবাজার শব্দায়ন একাডেমি। জানা গেছে, কক্সবাজার জেলার নাট্যচর্চার সূচনা হয়েছিল রামুতে। রামু সবচেয়ে পুরাতন জনপদ এবং আরাকান ও মোগল রাজাদের প্রাণকেন্দ্র ছিল। তাই রামুর সামাজিক অবস্থানই সাংস্কৃতিক চর্চায় রামু অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। রামুর কালীবাড়িকে কেন্দ্র করেই নাট্যচর্চা শুরু হয়। দীর্ঘকাল ধরে কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকভাবে পদানত করা সম্ভব হলেও সাংস্কৃতিক রক্ত বীজ পুরোপুরি উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি। তাই সাংস্কৃতিক বিকাশের ধারা এখনো অব্যাহত আছে। কক্সবাজারকে বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণীয় শহর হিসেবে গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগ। সম্প্রতি রাজারকুলের বন বিভাগের উদ্যোগে নির্মিত হচ্ছে ইকোপার্ক। আর্মি ক্যাম্প, বিজিবি ক্যাম্প, নারিকেল বীজ বাগান, রাবার বাগান, বৌদ্ধ মন্দির রামকোর্ট ও মহেশখালীতে আদিনাথ মন্দির, সোনাদিয়া দ্বীপ, কুতুবদিয়া বার্তি ঘর এবং কক্সবাজারের পর্যটন এরিয়া হিমছড়ি, ইনানী, দরিয়ানগরকে পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তুললে সরকারের রাজস্ব খাত বৃদ্ধি পাবে।