রাজনৈতিক সহিংসতায় কক্সবাজারে পর্যটন ব্যবসা লাটে


ফরিদুল মোস্তফা খান, (আমাদের সময় .ডটকম): একের পর এক হরতাল ও রাজনৈতিক সহিংসতায় পর্যটক শূন্য কক্সবাজারে থমকে গেছে সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য। টেকনাফ স্থলবন্দরে বিরাজ করছে স্থবিরতা। বন্ধ হয়ে পড়েছে ২ শতাধিক হোটেল-মোটেল, গেষ্ট হাউজ ও রেস্টুরেন্ট। একই সাথে সেখানে কর্মজীবী ৩০ হাজারেরও বেশি শ্রমিক এখন বেকার। পাশাপাশি কক্সবাজার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে পড়ে আছে হাজার কোটি টাকার মাছ। ব্যবসায়ীরা বলছে, গত কয়েক দিনের হরতালে পর্যটন শহর কক্সবাজারে হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুকে কেন্দ্র করে গত এক সপ্তাহে কক্সবাজারে ৪ দিনের হরতাল দিয়েছে ১৮ দলীয় জোট। বেগম জিয়ার ডাকে দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা ৩ দিন হরতাল চলাকালে ২৫ অক্টোবর চকরিয়ায় ৩ বিএনপি কর্মী ও ২৯ অক্টোবর কুতুবদিয়ায় ৫ জামায়াত কর্মী হরতাল বিরোধীদের গুলিতে নিহত হন। ফলে তাদের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে কক্সবাজার জেলায় বৃহস্পতিবার আরও একদিন হরতাল দেয় জামায়াতে ইসলামী। এতে সমর্থন দেয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। ফলে ঈদুল আযহার পর এক সপ্তাহের ব্যবধানে পর্যটন শহর কক্সবাজারে ৪ দিনের হরতাল পালিত হওয়ায় শুধু অর্থনৈতিক ভাবেই ক্ষতিগ্র¯ত্ম হয়নি, ক্ষতিগ্র¯ত্ম হয়েছেন সহস্রাধিক পরিবার। 


হরতাল বিরোধীদের নির্বিচার গুলিতে কেউ হারিয়েছেন স্বজন, আবার কেউ এসব হত্যাকান্ডের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানাগুলোতে রুজুকৃত পুলিশের মামলায় গ্রেপ্তারও হয়েছেন। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহতদের জন্য ইতোমধ্যে যে সম¯ত্ম থানায় মামলা হয়েছে, সেখানে মৃত ব্যক্তি এমনকি নিহতের নিকট আত্মীয় স্বজনদেরও আসামি করা হয়েছে। পুলিশ রাজনৈতিক অজুহাতে খুনের ঘটনায় জড়িত সন্ত্রাসীদের বাদ দিয়ে ১৮ দলীয় নেতাকর্মীদের মামলায় ঢালাওভাবে আসামি করছে। তাই কক্সবাজারে এসব মামলায় যে ক’জন গ্রেপ্তার হয়েছেন তার চেয়ে বেশি ১৮ দলীয় নেতাকর্মীরা এখন পুলিশের গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে যে সম¯ত্ম উপজেলা সমূহে হরতালের বলি হয়ে যে সব লোকজন প্রাণ হারিয়েছেন, সে সব উপজেলায় বর্তমানে পুরুষ শূন্য। যার কারণে এ সম¯ত্ম এলাকার ভুক্তভোগী পরিবার-পরিজন নিজেদের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন।

কুতুবদিয়ার এক গৃহিনী জানান, মাত্র ৫ দিন আগে তার সšত্মান হয়েছে। বাড়িতে একমাত্র উপার্জনক্ষম স্বামী ছাড়া তার অন্য কোন আপনজন নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্য, হরতালের দিন এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ৫ ব্যক্তি মারা যাওয়ায় পুলিশ যে মামলাগুলো রেকর্ড করেছে সেখানে তার স্বামীকে জড়িয়ে দিয়েছে। ওই গৃহিনী আরও বলেন, তার স্বামী হরতালের পিকেটিং কিংবা কোন নাশকতায় জড়িত ছিলেন না। ঘটনার দিন তিনি সদ্য ঔরসজাত সšত্মান ও স্ত্রী নিয়ে হাসপাতালে ছিলেন। শুধু বিএনপি’র রাজনীতি করেন বলেই পুলিশ তার স্বামীকে সম্পূর্ণ অন্যায় ভাবে মামলায় আসামি করায় সে এখন পলাতক। এ কারণে দুগ্ধপোষ্য শিশু নিয়ে একলা ঘরে বর্তমানে তিনি চরম বেকায়দায় জীবন-যাপন করছেন বলে জানিয়ে হাউ-মাউ করে কেঁেদ উঠেন। 

কুতুবদিয়ার শুধু এই গৃহিনীটি নয়, রাজনৈতিক সহিংসতা ও হরতালে হত্যাকাণ্ডের কারণে চকরিয়াসহ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে অসংখ্য পরিবারে এ অবস্থা বিরাজ করছে।

এছাড়া সবমিলিয়ে কক্সবাজারের জন্য টানা ৪ দিনের হরতালে হাজারো পর্যটক আটকা পড়ে। তাদের অনেকেই এখনো কক্সবাজারের বিভিন্ন পর্যটন এলাকায় চরম উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় রয়েছেন। 

হোটেল মিডিয়া ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক ইমতিয়াজ আলম চৌধুরী জানান, রাজনৈতিক সংঘাতের কারণে শুধু এই ৪ দিন কেন, পুরো বছরটিই কেটেছে পর্যটক শূন্যতায়। এ কারণে তিনি সহ অন্যান্য হোটেল-মোটেল, গেষ্ট হাউজ ও রেস্টুরেন্ট মালিকদের অনেকেই কর্মচারীদের বেতন দিতে না পেরে প্রায় ৩০ হাজারেরও অধিক কর্মচারি ছাঁটাই করেছেন। বর্তমানে তারা বেকার হয়ে পড়ায় মানবেতর জীবন যাপন অথবা নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। হোটেল মিডিয়া ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক ইমতিয়াজ আরো জানান, তার হোটেল থেকে চাকুরিচ্যুত কয়েকজন কর্মচারির এলাকায় খবর নিয়ে তিনি জেনেছেন, এ সম¯ত্ম বেকার যুবকদের অনেকে চাকরি হারানোর পর থেকেই পেটের তাগিদে সড়ক ও নৌ পথে ডাকাতির মত ঘৃণ্য কাজে জড়িয়ে পড়েছেন। আবার কেউ কেউ বিরোধী দলের আন্দোলনে যোগ দিয়ে দেশের মাঠ-ঘাট গরম করে রেখেছেন।

আরেক তারকা হোটেল লং বিচ-এর জেনারেল ম্যানেজার ফরিদুল ইসলাম টিটু জানান, সাম্প্রতিক হরতালের কারণে পর্যটকরা কক্সবাজারে আসতে না পারায় তার হোটেলে প্রায় শতাধিক কক্ষ অগ্রিম বুকিং দেওয়ার পরও বাতিল করা হয়েছে। এ ছাড়া কয়েকদিনের জন্য এসে প্রায় ৫০ জন পর্যটক রুম ভাড়া দিতে না পেরে হোটেল থেকে স্বেচ্ছায় নেমে গেছেন।

কক্সবাজার হোটেল-মোটেল মালিক গ্রুপের সাধারণ স¤পাদক নুরুল আবছার জানান, শুধু লং বিচ নয়, এরকম কক্সবাজারে প্রতিটি হোটেলে হরতালের কারণে রুম বুকিং বাদ দিয়েছেন পর্যটকরা।

পর্যটকদের বিনোদন সেবায় নিয়োজিত কক্সবাজার ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের (টুয়াক) সভাপতি এস এম কিবরিয়া বলেন, টানা কয়েক দিনের হরতালের কারণে হঠাৎ করে সেন্টমার্টিন কিংবা সোনাদিয়ায় পর্যটক যাতায়াত কমে গেছে। অথচ হরতালের আগে কক্সবাজারে দিনে ৫০ থেকে ৬০ হাজার পর্যটক অবস্থান করেছেন। পাশাপাশি দৈনিক ৫ হাজার পর্যটক জাহাজে করে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন ভ্রমণে গেছেন।

কক্সবাজার বোট মালিক সমিতির সহ-সভাপতি নুরুল ইসলাম জানান, জেলেরা সাগর থেকে মাছ আহরণ করে আনলেও হরতালের কারণে পরিবহন ও যাতায়াত বন্ধ থাকায় বর্তমানে কক্সবাজার মৎস্য অবতরণকেন্দ্রে পড়ে আছে  কোটি কোটি টাকার মাছ।

কক্সবাজার সৈকত কিটকট মালিক সমিতির সভাপতি হাসান উল্লাহ জানান, হরতালের কারণে হঠাৎ করে সৈকতে পর্যটকের উপস্থিতি কমে গেছে। তিনি আরও বলেন, দেশের স্বার্থে অšত্মত পর্যটন শিল্পের বিকাশের ধারাবাহিকতা অক্ষুণœ রাখতে পর্যটন শহর কক্সবাজারকে সব সময় হরতালের আওতামুক্ত রাখা প্রয়োজন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন