টেকনাফে বর্ষা মৌসুমে পরিত্যক্ত লবণমাঠে ধান চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা

পরীক্ষামূলক চাষে সফলতা

জাফর আলম
সীমান্ত উপজেলা টেকনাফের লবণ মাঠে বর্ষা মৌসুমে ধান চাষের উজ্জ্বল সম্ভানা থাকলেও গ্রামীণ কৃষকদের অজ্ঞতা ও সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে প্রতি বছর ৮/৯শ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে এসব মাঠে গ্রীষ্ম মৌসূমে লবনের সফল চাষ হলেও বাকী মৌসূম
সমূহে কোন চাষাবাদ ছাড়া ধু ধু প্রান্তরে পরিণত হয়। বাংলাদেশ ধান গবেষনা ইনস্টিটিউট লবণাক্ত জমিতে ধান চাষের পদ্ধতি উদ্ভাবন করলেও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পরীক্ষা মূলকভাবে লবণ মাঠে ধান চাষ করে বেশ ভালই ফল পাওয়া গেছে।
সরেজমিন পরিদর্শন ও প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, টেকনাফ উপজেলার ভূমিরূপ পাহাড়-টিলা-উপতক্যা ও উপকূলীয় জলাভূমি বিশিষ্ট। এর মধ্যে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ মাত্র সাড়ে ৮শ হেক্টর। এতে কেবল ধান চাষ-ই হতো। তাও বর্ষা মৌসূমে। অন্যান্য মৌসূমে পানির প্রাপ্যতা না থাকায় এসব জমি পতিত হয়ে পড়ে থাকতো। অন্যদিকে আদিম পদ্ধতিতে চাষাবাদের কারণে ফলন হতো এমনিতেই কম, তার উপর ফি বছর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও পাহাড়ী ঢলে নষ্ট হতো হাজার হাজার টন ফসল। এদিকে কুসংস্কার ও অজ্ঞতার কারণে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বসতঘর নিমার্ণ এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের শিবির স্থাপনের ফলে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমে গিয়ে সাড়ে ৫শ হেক্টরে এসে দাঁড়ায়। আদিম পদ্ধতিতে উৎপাদন কম হওয়ায় কৃষকেরা ধীরে ধীরে ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে লবণ চাষে এগিয়ে আসে। ১৯৯৭ সালে সর্ব প্রথম কুতুবদিয়ার লবণ চাষী শব্বির আহমদ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের নয়াপাড়া এলাকায় কৃষক মিয়া হোছনের ৩ হেক্টর ধানী জমি বর্গা নিয়ে লবনের চাষ শুরু করে। প্রথম বছর আশাতীত উৎপাদন না হলেও তৃতীয় বছর কল্পনাতীত উৎপাদন হওয়ায় উপজেলার কৃষকদের মাঝে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এরপর দেখাদেখি উপজেলার বাহারছরা ইউনিয়ন ছাড়া হোয়াইক্যং, হ্নীলা, টেকনাফ সদর/পৌর, সাবরাং ইউনিয়নের প্রায় ২.৪১ হেক্টর ধানী জমিতে লবণের চাষ শুরু হয় এবং কল্পনাতীত উৎপাদন হতে থাকে। এরফলে লবণ চাষীদের মুখে হাসি ফুটে উঠলেও ধান চাষে অভ্যস্ত চাষীদের মাথায় হাত উঠে। আগে বর্ষা মৌসূমে পুরো উপজেলা ধান গাছের সবুজের ছন্দ দোলায় চিত্ত বিমোহিত হতো আর শরৎ মৌসূমে সোনালী ধানের মৌ মৌ গন্ধে ভরে উঠতো চাষীদের উঠান আর বাকী মৌসূমে পড়ে থাকত পতিত জমি হিসাবে। এখন তার উল্টো দৃশ্য বিরাজ করছে। গ্রীষ্ম মৌসূমে লবণ মাঠের চিকচিক দৃশ্য আর বর্ষা মৌসূমে ধু ধু প্রান্তর। সম্প্রতি বাংলাদেশ ধান গবেষনা ইনষ্টিটিউট লবণ সহিঞ্চু জাতে ধান বিরি-৪০, বিরি-৪১ উদ্ভাবন করলেও টেকনাফের কৃষকেরা এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। তবে সরকারীভাবে গ্রীষ্ম মৌসূমে লবণ এবং বর্ষা মৌসূমে ধানের চাষে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলেও এনজিও সংস্থা সোসাইটি ফর হেল্্থ এক্সটেনশন (শেড)-এর ডিআরআর প্রকল্পের আর্থিক সহযোগিতায় এবং কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কারিগরি সহায়তায় ২০০৮ সালে বর্ষা মৌসূমে উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের মোচনী এলাকার কৃষক নুরুল আমিন চৌধুরী তাঁর ২ হেক্টর লবণ মাঠে লবণ সহিঞ্চু জাতের ধান বিরি-৪০, বিরি-৪১ চাষ করে কল্পনাতীত ফসল ঘরে তুলে পুরো কক্সবাজার জেলায় রীতিমতো হৈ চৈ ফেলে দেয়। এরপর দেখা দেখি অন্যান্য কৃষকেরাও এগিয়ে আসে। চলিত বর্ষা মৌসূমে শেড-এর ডিআরআর প্রকল্পের সার্বিক সহযোগিতায় হ্নীলার কৃষক আবুল কালাম, মোচনী এলাকার নুরুল আমিন চৌধুরীসহ উপজেলার হ্নীলা, সাবরাং ও টেকনাফ সদর ইউনিয়নে ২ জন করে প্রকৃত লবণ চাষী কৃষককে লবণ সহিঞ্চু জাতের ধানের বীজ, কীটনাশকসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু সরবরাহের মাধ্যমে উৎসাহ প্রদান করেছে। চলিত সনে উপজেলার বেশ কিছু এলাকায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কোন প্রকার সহযোগিতা ছাড়াই নিজেরাই নিজেদের কৃষি জ্ঞান দিয়ে চাষ করে ধানের বাম্পার ফলন ঘটিয়েছে। ২০১০ সালের ১৪ জুনের পাহাড়ী বন্যায় উপজেলার শত শত লবনীয় ভূমিতে পলি পড়ে ধান চাষের জন্য উপযোগী হয়ে পড়ে। কিন্তু কৃষি সম্প্রসারণ তথা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কৃষক সমাজের মাঝে পালি পড়া লবন মাঠে ধান চাষের জন্য সচেতনতামূলক কৃষি জাগরণ করতে পারলে এ বছর ৮/৯শ মে: টন ধান কৃষি খাতে যুক্ত হয়ে দারিদ্রতা বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারতো বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকার কৃষক লবণ সহিঞ্চুজাতের ধান বিরি-৪০, বিরি-৪১ লবন মাঠে চাষের উপযোগিতা সম্পর্কে কিছুই জানে না। তবে কিছু কিছু কৃষক লবন সহনশীল জাতের ধান না লাগিয়ে বিরি-২৮, বিরি- ২৯ রোপন করেও ভাল ফল পাবে বলে মনে করছে। অন্যদিকে কৃষকদের পরিচিত লাল জাতের ধান এ বছর চাষে বাম্পার ফলন হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কৃষকদের অভিজ্ঞতা হলো, বর্ষা শেষের দিকে বৃষ্টি একটু কম হলে লবনের প্রভাব বেশী থাকে। সেক্ষেত্রে লাল ধানই ভাল ফলন দিতে পারে। অপরদিকে বৃষ্টি বেশী হলে মিঠা পানির প্রভাবে বিরি-৪০, বিরি-৪১ ভাল ফলন দেয়।
উপজেলার হ্নীলার রঙ্গিখালী-আলীখালীতে প্রায় ১শ একর লবণ মাঠের চাষীরা কোন প্রকার পূর্ব অভিজ্ঞতা না নিয়ে পলি পড়া জমিতে শুধুই বীজ ধান ছড়িয়ে দিয়ে  কৃষক তথা সর্বস্থরের মানুষকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এসব লবণ মাঠে রোপা ধানের অভূতপূর্ব ফলনে কৃষকদের কোন প্রকার কীটনাশক বা সার দিতে হয়নি বলে কৃষকেরা জানান।

চলতি বছরে হ্নীলা ইউনিয়নের রঙ্গিখালী, আলীখালী, লেদা, মোচনী, জাদিমোরা, দমদমিয়া, নাটমুরাপাড়া, ফুলের ডেইল, মৌলভীবাজার এবং হোয়াইক্যং ইউনিয়ন, সাবরাং ইউনিয়ন ও টেকনাফ সদর ইউনিয়নের কিছু কিছু এলাকায় লবণ চাষী কৃষক লবণ মাঠে বিরি-৪০, বিরি-৪১ ধান রোপন করে আশাতীত ফলন পেতে শুরু করেছে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কারিগরি সহযোগীতা ও প্রয়োজন মতো জমিতে সার দিতে পারলে কৃষির বাম্পার ফলনে কোন সমস্যাই হবে না বলে মনে করেন। সাবরাং এলাকার কৃষক আবদুল গফুর জানান, এ বছর ডিআরআর প্রকল্পের আর্থিক সহযোগিতায় ৪০ শতক লবনীয় জমিতে ভাল ফলন পাওয়া গেছে। এতে আমার এলাকার কৃষককেরা এখন লবণ মাঠে ধান চাষের বিকল্প চিন্তা মাথায় নিতে শুরু করেছে। মোচনী এলাকার কৃষক রশিদ আহমদ জানান, কৃষি সম্প্রসারণ ওা ডিআরআর প্রকল্পের সহযোগিতায় লবণ সহিঞ্চুজাতের ধান বিরি-৪০, বিরি-৪১ রোপন করে বাম্পার ফলন হয়েছে। পাশাপাশি এলাকার কৃষকেরাও লবণ মাঠে ধান রোপন করেছে। যাতে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে। রঙ্গিখালী এলাকার কাশিম ও মুফিদুল জানান, কোন প্রকার সহযোগিতা ছাড়াই লবণ মাঠে বিরি-৪০, বিরি-৪১ ধান রোপন করে ভাল ফলন পাওয়া গেছে। এ বছর লবণ মাঠের বিরি-৪০, বিরি-৪১ বাম্পার ফলন অন্যান্য জমিতে আমনের ফলনকে হার মানিয়েছে। ডিআরআর প্রকল্পের ফিল্ড ট্রেইনার জানান, উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় কৃষকদের উৎসাহ প্রদানের লক্ষে ডিআরআর প্রকল্প প্রতি ইউনিয়নে ২/৩টি করে লবণ সহিঞ্চু জাতের বিরি-৪০, বিরি-৪১ ধান চাষের প্লট প্রদর্শনী করা হয়েছে। যাতে ডিআআর প্রকল্প আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে থাকে। প্রজেক্ট ম্যানেজার জানান, উৎসাহমূলক প্রদর্শনী করে কৃষকদের মাঝে সচেতনতাবোধ সৃষ্টির মাধ্যমে কৃষি জাগরণ ঘটানো সম্ভব। তিনি আরো জানান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে সাথে নিয়ে আগামীতে ইউনিয়ন ভিত্তিক কৃষি সমাবেশ ঘটিয়ে বর্ষা মৌসূমে উপজেলার পতিত লবন মাঠে লবণ সহিঞ্চু ধান বিরি-৪০, বিরি-৪১ চাষে কৃষি বিপ্লব ঘটিয়ে কৃষি ফসলী উৎপাদন বৃদ্ধি করা হবে। কৃষকদের মাঝে লবণ সহিঞ্চু জাতের বিরি-৪০, বিরি-৪১ ধানের ব্যাপারে প্রয়োজনে গ্রামে গ্রামে বৈঠকখানা করা হবে। তিনি আরো বলেন, সরকারের ভিশন ২০২১ বাস্তবায়নে কৃষকদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। কৃষি ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়ে সোনার সোনার কৃষকেরাই পারে দিন বদলের সনদ বাস্তবায়ন করতে। উপজেলা কৃষি অধিদপ্তরের সহযোগিতায় কৃষকেরা যাতে কৃষি বিপ্লব ঘটাতে পারে সে জন্য প্রয়োজনীয়তার উপর তিনি কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেন।