ইয়াবা নেশায় জড়িয়ে পড়ছে যুবসমাজ, পিছিয়ে নেই তরুণীরা

কক্সবাজারবাণী ডেস্ক
কমলা রঙের ছোট ট্যাবলেট । খুব সহজেই লুকিয়ে রাখা যায়। দামেও অন্যান্য নেশার চেয়ে কম। খেলে গন্ধ টের পায় না আশপাশের লোকজন। তাই ইয়াবার কদর কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গামী ছাত্রছাত্রীদের কাছে বেশি। মাদক ব্যবসায়ীরা এ সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছে।
শুধু আসক্তিই নয়, পরে ইয়াবা বিক্রেতায় পরিণত করছে তাদের। এ বিক্রেতারা প্রথমে তাদের বন্ধুদের কাছে এ মাদক বিক্রি করে। এক বন্ধু আসক্ত হলে আরেক বন্ধুর কাছে বিক্রি হয় ইয়াবা। এভাবে ক্রমাগত জালের মতো ছড়িয়ে পড়ছে ইয়াবা ব্যবসা। ইয়াবা নামের এ বিষে ক্রমেই গিলে খাচ্ছে তরুণ সমাজকে।

রাজধানীতে মারাত্মক আকারে বাড়ছে ইয়াবা আসক্তের সংখ্যা। সেই সঙ্গে বাড়ছে ব্যবসায়ীর বহর। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নজরদারির কারণে প্রতিনিয়িত ধরনও পাল্টানো হচ্ছে ইয়াবা ব্যবসার। ব্যবসার সুবিধা এবং পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে ইয়াবা উচ্চারণ না করে দেওয়া হয়েছে সাংকেতিক বিভিন্ন নাম। বর্তমানে আলোচিত মাদক হচ্ছে ইয়াবা। এর আগে ফেনসিডিল ও গাঁজার ব্যবহার এবং ব্যবসার কথা শোনা গেলেও এখন ইয়াবাই প্রধান মাদক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এ ব্যবসায় যোগ দেওয়া এবং এ নেশায় আসক্ত করানোর প্রধান টার্গেট এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। 

এদিকে আসন্ন ঈদসহ বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবকে সামনে রেখে রাজধানীজুড়ে মাদক ব্যবসায়ীরা মাদকের মজুদ গড়ে তুলছে। ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইনসহ নানা ধরনের মাদকদ্রব্য রাজধানীতে মাদকের ডিলারের মাধ্যমে প্রবেশ করে আবার তা চলে যাচ্ছে সেবীদের কাছে। ডিবি পুলিশের ইতিহাসে সর্বোচ্চসংখ্যক ৩০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার ডিবি পুলিশের হাতে ধরা পড়া মাদকের রানী হিসেবে পরিচিত তিতুমীর কলেজের ফিন্যান্স বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ম্যানিলা চৌধুরীকে আটকের পর গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কাছে এমন তথ্য দিয়েছেন তিনি। এসময় তার চার সহযোগীও ডিবির জালে ধরা পড়ে।

অপরদিকে বিভিন্নসময় ইয়াবাসহ গ্রেপ্তারকৃতদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ধরা হচ্ছে তাদের সহযোগীদের। কিন্তু কমছে না এর ব্যবহার ও ব্যবসা। নিত্যনতুন কৌশলে মাদক ব্যবসায়ীরা এ ব্যবসা চালাচ্ছে রাজধানীতে। তাদের কৌশল পরিবর্তন করে শিশু-কিশোরদের এখন ইয়াবার বাহক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর আগে মসজিদের ইমাম মোয়াজ্জিনও ধরা পড়েছে ইয়াবাসহ। ডিবি পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর তারা স্বীকার করেছেন তারা এ ব্যবসায় জড়িত। প্রশাসন ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের কর্মকর্তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা এ ব্যবসা করে যাচ্ছে।

অভিযোগ রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের কর্মকর্তাদের মোটা অঙ্কের অর্থের মাধ্যমে ম্যানেজ করে এ চক্রের মূল হোতারা থাকছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। রাজধানীর অভিজাত এলাকা হিসেবে খ্যাত গুলশান-বনানী-বারিধারা-ধানমন্ডি-উত্তরায় ইয়াবা ব্যবসা জমজমাট। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি কম হওয়ায় ব্যবসায়ীরা এসব এলাকাকেই বেছে নেয় মাদক ব্যবসার জন্য। এছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক হোটেল, গেস্ট হাউস, ফ্লাট বাড়িতেও দেদারসে কেনা-বেচা হয় ইয়াবা ট্যাবলেট। তবে ফেনসিডিলের মতো কোনো নির্ধারিত স্পট নেই। এখন ইয়াবা বিক্রি হয় মোবাইলের মাধ্যমে। বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষসহ বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা নিয়মিত এ ট্যাবলেটের সেবক।

জানা গেছে, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌনে চার লাখ মাদকসেবী আছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে। সম্প্রতি র‌্যাব ও পুলিশের হাতে কয়েকজন কিশোর মাদক ব্যবসায়ী গ্রেপ্তারের পর তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায় চাঞ্চল্যকর তথ্য। 

যেসব রুটে আনা হয় ইয়াবা : মাদক ব্যবসায়ীরা টেকনাফ, যশোর, সাতক্ষীরা, বি-বাড়িয়া, সিলেট, সুনামগঞ্জ, ফেনীর ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া, মুন্সীরহাট, বিলোনিয়া, কালীরহাট, পাঠাননগর, রানীরহাট, কুমিল্লা, সুয়াগাজী, চৌদ্দগ্রাম, হিলি সীমান্তসহ আরও কয়েকটি সীমান্ত এলাকা দিয়ে অনায়াশেই ফেনসিডিল, হেরোইন, আফিমের পাশা-পাশি ইয়াবার বড় বড় চালান আনা হচ্ছে। এসব স্থানে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে মাদকের চালান আনা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। 

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, রাজধানীতে ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে ৪০ থেকে ৪২ জন মাদক ব্যবসায়ী। আগে যারা ফেনসিডিল ব্যবসা করতো তারাই অধিক মুনাফা এবং কম ঝুঁকির কারণে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে শুরু করে অভিজাত এলাকার অনেক তরুণ-তরুণী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। 

সম্প্রতি কুমিল্লার দাউদকান্দির চেকপোস্টে ৩১ হাজার পিস ইয়াবাসহ তিনজন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরা হলেনÑ টেকনাফের মাদক সম্রাট আব্দুর রহমান, শরিয়তপুরের সেলিম এবং টেকনাফের জোবায়ের। দুলাখ টাকার বিনিময়ে মূলহোতা আব্দুর রহমানকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সেলিম ও জোবায়েরের বিরুদ্ধে মাদক আইনে মামলা হয়েছে বলে জানা গেছে। সম্প্রতি গোয়েন্দাদের পাতানো জালে আটক মনির হোসেন জানিয়েছে, ঢাকার পুরস্কারঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালের ছোট ভাই রাজুর নির্দেশে মাদক ব্যবসায় নামতে হয়। একবছর ধরে ওই ব্যবসা চলছে। তার নিয়ন্ত্রণে ২০ থেকে ২৫ কিশোর জহুরী মহল্লা, তাজমহল রোড, আসাদগেট, নোয়খালী পট্টি ও কুমিল্লা বস্তিসহ আরও কয়েকটি এলাকায় নিয়মিত ইয়াবা বিক্রি করে আসছে। 

এবিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইয়াবা আকারে খুবই ছোট ও সহজে বহন করার সুবিধার্থে শিশুদের এ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। ইয়াবা সেবনে মুখে গন্ধ না হওয়ায় এদের চিহ্নিত করাও কষ্টকর হয়ে পড়ে। তারপরও গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানান তারা। 

সাংকেতিক নামে চলছে মাদক ব্যবসা : রাজধানীতে সাংকেতিক নাম ব্যবহার করছে মাদক ব্যবসায়ীরা। গ্রেপ্তার এড়াতে মাদক ব্যবসায়ীরা কৌশল পাল্টিয়েছে। আগের মতো কোনো মাদকের নাম উচ্চারণ না করেই তারা কথোপকথনে সাংকেতিক নাম ব্যবহার করে থাকে বলে জানা গেছে। মূলত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধোঁকা দিতেই তারা মোবাইল ফোনে ওইসব নাম ব্যবহার করে। মাদক ব্যবসায়ীদের এটা নতুন কৌশল কিনা তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। গত কদিনে ডিএমপির বিভিন্ন থানা এলাকায় মাদকদ্রব্যসহ বেশকজন মাদক ব্যবসায়ী গ্রেপ্তারের পর তাদের জিজ্ঞসাবাদে এসব সাংকেতিক নাম ব্যবহারের কথা বের হয়ে এসেছে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, ১টা ইয়াবা ট্যাবলেটের প্রয়োজন হলে এক গাড়ি ইট বলা হয়। এভাবেই বিভিন্ন প্রকার ইয়াবার নামও পরিবর্তন করেছে ব্যবসায়ীরা। যেমন চম্পার বর্তমান নাম সিটিসেল, আর সেভেন হলো গ্রামীণ, জিপির বদলে বাংলালিংক, কয়জন? উত্তর ১ জন হলে ১টা ফেনসিডিল, ১ হাজার টাকার ১ টাকার নোট অর্থ ১টা ফেনসিডিল- এসব সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার করছে মাদক বিক্রেতারা।

শেরেবাংলা নগর থানার এএসআই কামাল হোসেন জানান, গত মাসে আগারগাঁও এলাকায় এক অভিযানে মামুন নামের এক মাদক ব্যবসায়ী মোবাইলে কথা বলছেন। তার কথাগুলো হলোÑ ‘কয় গাড়ি ইট লাগবে ভাই। সিটিসেল না গ্রামীণ? না না, ১ হাজার টাকার নোট এখন নেই’। সে ওই এলাকায় মোবাইলে যোগাযোগ করে এভাবেই মাদকদ্রব্য বিক্রি করে আসছিল। একই সময়ে আশুলিয়া থানার এসআই সায়েদ ওই এলাকায় আটক করেন আরও কয়েকজনকে। এছাড়া গত সপ্তাহে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের হাতে ১২ মাদক ব্যবসায়ী ধরা পড়ে। তারা প্রত্যেকেই ওইসব সাংকেতিক নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন মাদকদ্রব্য বিক্রি করে আসছিল বলে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে। একই অবস্থা চলছে ধানমন্ডি, গুলশান, মহাখালী, বাড্ডা ও রামপুরা এলাকায়।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, গেপ্তার এড়াতে ধরন পাল্টিয়েছে মাদক ব্যবসায়ীরা। তারা এখন আর আগের মতো কোনো মাদকের নাম উচ্চারণ করে না। ওইসব সাংকেতিক নাম ব্যবহার করে ব্যবসা করে থাকে। জনসমক্ষে মোবাইলে কথা বলার সময় ওইসব নাম উচ্চারণ করলে সাধারণত কারো বোঝার কথা নয়। তাই মাদক বিক্রেতারা সাংকেতিক নাম ব্যবহার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ধোঁকা দেয়। তবে গ্রেপ্তারকৃতদের তথ্য যাচাই-বাছাই করে তাদের আরও নতুন কোনো কৌশল রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। 

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, একসময় রাজধানীর বিভিন্ন স্পটে মাদক ব্যবসায়ীরা আত্মগোপনে থেকে লোক দিয়ে ব্যবসা করাত। স্পট ভেঙে দেওয়ায় মোবাইলে যোগাযোগ করে ব্যবসা করছে এরা। সময়ের বিবর্তনে আরও কোনো কৌশল নেবে। এসব মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে সীমান্ত এলাকায় নজরদারি জোরদারের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের রমনা সার্কেলের পরিদর্শক আব্দুল আজিজ এসব সাংকেতিক নামের বিষয় নিশ্চিত করে বলেছেন, তারাই মূলত এসব অভিযানে নেমে থাকেন। তবে শুধু ওয়াকিটকি দেখিয়ে ভয়-ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে মাদক ব্যবসায়ীদের আটক করা হয়। অনেক সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়েও অনেক এলাকায় অভিযান চালানো হয়। মাদক ব্যবসায়ীরা দুর্ধর্ষ হওয়ায় এবং বৈরী পরিবেশে অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ছোট অস্ত্র থাকলে হয়তো তাদের কাজ আরও সহজ হতো বলে তাদের ধারণা। সরকারের কাছে এ দাবি দীর্ঘদিনের হলেও তা শুধু ফাইল চালাচালির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে বলে জানান তিনি। গুলশান সার্কেলের পরিদর্শক কামরুল ইসলামও একই কথা জানিয়ে বলেছেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ করতে সমাজের সকলের সচেতনতা ও সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বৃদ্ধি এবং মাদক আইন আরও কঠোর করার আহবান জানান তিনি। এছাড়া অধিদপ্তরের গুলশান সার্কেলের পরিদর্শক একেএম কামরুল ইসলাম বলেন, তাদের যানবাহনসংকট রয়েছে। অধিদপ্তরের আগে গাড়ি ছিল তিনটি। কিন্তু একটি গাড়ি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় অভিযানে ব্যাঘাত ঘটছে। শিগগিরই এ সমস্যার সমাধান হবে বলে জানান তিনি। তিনি আরও জানান, মাদকের বিরুদ্ধ তাদের অভিযান আগের মতোই জোরালো আছে। যানবাহনসংকট থাকলেও অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা তাদের অভিযান অব্যাহত রেখেছেন বলে দাবি করেন তিনি। অবৈধ উৎকোচের বিনিময়ে মাদক ব্যবসায়ীদের ছাড়া হচ্ছেÑ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, যদি এমন কোনো কর্মকর্তার বিষয়ে এমন তথ্য পাওয়া যায় তাহলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি আরও জানান, যানবাহনের পাশাপাশি তাদের আরও কিছু সমস্যা আছে। এগুলোর মধ্যে পর্যাপ্ত জনবলসংকট, কর্মকর্তাদের কাছে অস্ত্র না থাকা অন্যতম। অনেক সময় কর্মকর্তারা অভিযান চালালে মাদক ব্যবসায়ীরা অস্ত্র প্রদর্শন করে। তখন কর্মকর্তারা পিছুটান দেয়। তবে এসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরা হয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন