চকরিয়ায় প্রভাবশালীদের দখলে ১০টি বালু মহাল, অর্ধকোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার


সিবিএন: চকরিয়া উপজেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রনাধীন ১০টি বালু মহাল গত তিনবছর ধরে অবৈধভাবে দখলে নিয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তারা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে বালু মহাল গুলো নিয়ন্ত্রনে রেখে প্রতিমাসে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। ফলে সরকার প্রতিবছর বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে । বর্তমানে প্রভাবশালীদের নিয়োজিত লোকজন এসব বালু মহালের ছড়াখাল ও শাখা নদীতে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে প্রতি দিন রাতে লাখ লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলন পাচার করলেও দেখার কেই নেই বললেও চলে।
প্রতিযোগিতামুলক ভাবে বালু উত্তোলনের কারনে শাখা নদী ও ছড়াখাল লাগোয়া এলাকায় শত শত জনবসতি ও বনাঞ্চল চরমভাবে হুমকির মুখে পড়ায় স্থানীয় লোকজনের মাঝে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অপরদিকে প্রতিনিয়ত ভাঙ্গনের কবলে পড়ে সংরক্ষিত বনাঞ্চল সমুহ ফি বছর নদী গর্ভে বিলিন হয়ে যাচ্ছে।
উপজেলা প্রশাসন সুত্র জানিয়েছে, ইতোপুর্বে জড়িত প্রভাবশালীরা বালু মহাল গুলো যাতে প্রশাসন ইজারা দিতে না পারে সেই জন্য উচ্চ আদালতে একটি পরিবেশ আইনে রিট মামলা দায়ের করেছে। ওই মামলার কারনে গত তিন বছর ধরে সরকারি ১৪/১৫টি বালু মহালের মধ্যে মাত্র গুটি কয়েক বালু মহাল ইজারা দেওয়া হলেও বৃহৎ আকারের ১০টি বালু মহাল ইজারা দিতে পারছেনা প্রশাসন। উপজেলা ভুমি অফিস সুত্র জানায়, বালু মহাল গুলো ইজারা দিতে না পারার কারনে সরকার প্রতিবছর প্রায় অর্ধ কোটি টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তিনবছর ধরে মহাল গুলো বেহাত হলেও প্রশাসন গত ১৪১৯ ও ১৪২০ বাংলা সনের দুই বছরে অন্তত কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে।
জানা গেছে, ২০১২সালে পাহাড় ও ভুমি ধ্বসের অভিযোগে উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউপি চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী উচ্চ আদালতে (হাইকোর্টে) একটি রিট মামলা দায়ের করেন। এসময় আদালত বালু মহাল গুলো ইজারা প্রদানে ও বালু উত্তোলনে ৬মাসের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। তবে আদালতের দেয়া ৬মাসের নিষেধাজ্ঞা মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক আগে। সুত্র জানায়, আদালতে রিট মামলার কোন কুল-কিনারা না হওয়ায় জেলা প্রশাসন এসব বালু মহাল ইজারা দিতে পারছেনা। ফলে এ সুযোগে জড়িতরা এসব বালু মহালে ভাড়াটে লোক ব্যবহার করে নিত্যদিন বালু লুটের মহোৎসবে মেতেছে। সচেতন এলাকাবাসীর অভিযোগ, পরিবেশ আইনে উচচ আদালত (হাইকোর্টে) যারা মামলা করেছে তাদের সিন্ডিকেটের ভাড়াটে লোকজন দিয়ে প্রতিদিন শত শত ট্রাক বালু উত্তোলন করে ঢাকা-চট্রগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভবন নির্মাণ কাজে বিক্রি করা হচ্ছে। প্রতি ট্রাক বালি থেকে সিন্ডিকেটের লোকজন (সরকারী টোল-টেক্স) হিসেবে আদায় করা হচ্ছে ২শত টাকা থেকে ১হাজার টাকা পর্যন্ত। এভাবে ১০টি বালু মহাল থেকে প্রতিদিনের আয় লাখ টাকা হলেও তার কানাকড়িও সরকারের রাজস্ব খাতে জমা হয়না। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাশালী ৫ রতি-মহারতিদের কাছে গ্রেড অনুযায়ী পৌছেঁ দিতে হয়। ক্ষমতাসীন দলের এসব প্রভাবশালী লোকজনের সহযোগিতায় সরকারী বনাঞ্চল থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হলেও সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের লোকজন রহস্যজনক নিরব ভুমিকা পালন করে যাচ্ছে।
সুত্র জানায়, উপজেলার খুটাখালী ইউনিয়নে তিনটি, ডুলাহাজারা ইউনিয়নে দুটি, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নে দুটি ও হারবাং ইউনিয়নের তিনটিসহ ১০ বালু মহাল থেকে সরকার গতবছরের মতো চলতি বছরও প্রায় অর্ধকোটি টাকা রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সরেজমিনে জানা গেছে, খুটাখালী, ডুলাহাজারা ও ফাঁসিয়াখালী এলাকার পাহাড়ি ছড়া থেকে দিনরাত মিলে শতশত শ্রমিক দিয়ে ২৪ঘন্টা বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। উচ্চ আদালত এসব বালু মহাল থেকে বালি উত্তোলনে নিষেধাজ্ঞা জারী করলেও তা কেউ মানছেন না। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় স্থানীয় প্রভাবশালী মহল এসব বালি উত্তোলন করে পরিবেশ আইন লঙ্গনের পাশাপাশি সরকারের লাখ লাখ টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, আগে সরকারকে রাজস্ব দিয়ে বালু উত্তোলন করা হলেও এখন বিনা বাধায় ইজারা না নিয়েও দিনরাত এসব মহাল থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। উপজেলার খুটাখালী বাজারের পুর্ব পাশে ছড়াখালে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে দিব্যি বালু উত্তোলন করছে স্থানীয় রফিকুল ইসলাম প্রকাশ বার্মাইয়া রফিক, শাহজাহান প্রকাশ শাহজাহান মাষ্টার, সামসুদ্দিন। ডুলাহাজারা ছড়াখাল থেকে পাহাড় ও ছড়া কেটে বালু উত্তোলন করছে ইনো বাহিনীর প্রধান ইনো ডাকাত, ফখরুল, আবদুল করিম, সৈয়দ হোসেন, পুতিয়া, জামাল হোসেন, মেহের আলী, জয়নাল, জমির ও সৈয়দ আকবর প্রমুখ। এছাড়াও খুটাখালী তিনটি ও ডুলাহাজারা ২টি বালু মহাল থেকে একই কায়দায় বালু উত্তোলনের মাধ্যমে সড়ক দখল করে ব্যবসা করছেন বেলাল উদ্দিন, সালাহ উদ্দিন, মিন্টু, রানা, শাহজাহান, আবদুর রহমান, জসিম উদ্দিন ও আবু তাহের। অপরদিকে মালুমঘাট পুলিশ ফাড়ির সামনে আবদুল করিম, ডুলাহাজারা কলেজের সামনে শিক্ষার্থীদের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এমরান, ইউনুছ, আবদুল কাদের, শওকত, পুতিয়া, পাগলির বিল সেতুর পাশে নুরুল কবির, মো.হোসেন প্রকাশ পুতুন্যা, বাবুল, আবদুল মান্নান, মিন্টু ও সাবেক মেম্বার নুরুল কবিরসহ তাদের সহযোগিরা উত্তোলনকৃত বালু সড়কের ওপর মজুদ করে প্রশাসনের নাকের ডগায় দিব্যি ব্যবসা করে আসছেন।
খুটাখালী ইউপি চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুর রহমান বলেন, সরকারি বালু মহাল গুলোর নির্ধারিত পয়েন্ট কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কয়েক কিলোমিটার ভেতরে। কিন্তু বালু উত্তোলন ও ব্যবসায় জড়িতরা দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে সড়ক দখল করে উত্তোলনকৃত বালু মজুদ করছে বিভিন্ন মোকামে। তিনি বলেন, নতুন ইউপি ভবনের ফটক দখল করেও অনেকে বালু মজুদ করছেন। সড়ক সংকুচিত হয়ে পড়ার কারনে প্রায় সময় এলাকায় ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে বেশির ভাগ ঝুঁিকর মধ্যে রয়েছেন স্কুল-মাদরাসা ও কলেজগামী শিক্ষার্থী ও বাজারমুখী জনগনসহ পথচারীরা।
এ প্রসঙ্গে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মনোয়ারা বেগম বলেন, বালু মহাল ইজারা দেয় জেলা প্রশাসন। কিন্তু রিট মামলার কারনে কিছু মহাল ইজারা হয়নি এমনটাই জানি। তবে বালু উত্তোলন করে সড়কের উপর মজুদ করার এখতিয়ার কারো নেই। তিনি বলেন, ব্যাপারটি পর্যবেক্ষন করা হচ্ছে। অবৈধ পন্থায় বালু উত্তোলন ও মজুদে জড়িত কাউকে ছাড় দেয়া হবেনা। তাদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অপরিকল্পিত ও অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকে নিয়ে প্রভাবশালী মহল ও স্থানীয় লোকজনের মধ্যে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে ক্ষোভ ও আক্রোশ। যে কোন মুহুর্তে দু‘পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশংকা প্রকাশ করছে এলাকাবাসী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন