অনুসন্ধানি প্রতিবেদন-২ :> চোরাচালানি ইয়াহিয়ার কুকীর্তির আরো কাহিনী

  • প্রথম পর্বে তোলপাড়
  • অনুসন্ধানে তৎপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
  • আপন সহোদর বললেন তার অপকর্মের প্রতিবাদ করলেই বিপদ!
  • বাংলাদেশে প্রথম মিয়ানমারের মাদক ঢুকান এই চক্র

ফরিদুল মোস্তফা খান, আমাদের সময় ডটকম: আন্তর্জাতিক চোরাচালানে বাংলাদেশের দাউদ ইব্রাহিম চট্টগ্রাম-টেকনাফের বহুল আলোচিত-সমালোচিত ইয়াহিয়ার অজানা কুকৃর্তির প্রথম পর্ব গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর দেশে-বিদেশে বিশেষ করে কক্সবাজার জেলা জুড়ে শুরু হয়েছে তোলপাড়। শুক্রবার ও এর আগের রাতে বিষয়টি ছিল টক অব দ্যা কান্ট্রি। কক্সবাজার থেকে প্রকাশিত দৈনিক কক্সবাজারবাণীতে তথ্য বহুল এই সংবাদটি প্রকাশিত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট চোরাচালানি গডফাদার ইয়াহিয়া গংদের আঁতে গা লাগে। ফলে তারা নিমিষেই জেলার সবকটি সংবাদপত্র স্টল ও হকারদের কাছ থেকে কক্সবাজারবাণীর বান্ডিল বান্ডিল কপি ক্রয় করে নিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কিন্তু দূর্ভাগ্য চোরাকারবারিদের ভোরের সাথে পাল্লা দিয়ে বেলা বাড়ার সাথে সাথেই কক্সবাজারের সচেতন পাঠকদের কাছে পৌঁছে যায় বাণী।
কেউ কেউ সংবাদপত্রের দোকানে পত্রিকা না পেয়ে নিজেরা নিজেদের মধ্যে চোরাকারবারি ইয়াহিয়ার সংবাদটি ফটোকপি করে সরবরাহ করে। এ কারনে ক্ষিপ্ত হয়ে ইয়াহিয়ার সাঙ্গপাঙ্গ তার প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য চোরাকারবারিরা প্রতিবেদককে দেখিয়ে নেবেন বলেও বিভিন্ন স্থানে হুমকি দিয়ে ক্ষান্ত হচ্ছে না, প্রয়োজনে তারা লেখার বদলে লেখা অথবা মামলা-হামলা যাই কিছু করার দরকার তাই করবে বলে শাসিয়ে বেড়াচ্ছে। এ অবস্থায় কক্সবাজার জেলার উখিয়া-টেকনাফ আসন থেকে উক্ত চোরাচালানি গডফাদারের সন্তান তাহা ইয়াহিয়া জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতিক নিয়ে নির্বাচন করায় বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট দু’উপজেলার আনাচে-কানাচে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া। সেখানকার ভোটাররা তাহা ইয়াহিয়ার পিতা চোরাচালানের গডফাদার ইয়াহিয়ার কুকৃর্তি ও তাদের প্রাক পরিচিতি পেয়ে যাওয়ায় দারুন মর্মাহত হয়ে বলাবলি করছেন, ছেলে তাহা ইয়াহিয়া এমপি হলে তো তাদের অপকর্ম আরো বেড়ে যাবে! কাজেই সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি মাথায় রেখে আগামী সংসদ নির্বাচনে উক্ত মাফিয়া চক্রদের বয়কট করারও দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে ইয়াহিয়াদের পূর্ব পুরুষ রোহিঙ্গা অধিবাসীসহ তাদের অপকর্মের অজানা আরো বেশকিছু নতুন নতুন তথ্য দিয়েছে, যা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সিনেমার ভিলেনকেও হার মানানো চোরাচালানি গডফাদার ইয়াহিয়া নয় শুধু, তার ভাই নিকট আত্মীয় সহ তাদের পুরো পরিবারই অন্ধকার জগতের বাসিন্দা। নিজেদের আখের গোছাতে এই চক্র শুধু অবৈধ ব্যবসা নয়, দেশের সম্পদ মিয়ানমারে পাচারের পাশাপাশি হরেক রাষ্ট্রদ্রোহিতায় জড়িত ছিলেন সবসময়।
জানা গেছে, রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানেজেশন (আর.এস.ও) সম্পৃক্তা সহ ইয়াহিয়ারা জোট সরকার আমলের আলোচিত সংগঠন জে.এম.বি তথা বাংলা ভাইদের মতো বড় বড় সন্ত্রাসীদের সাথে সম্পৃক্ত থেকে ধরাকে সরাজ্ঞান করেছেন। 
ইয়াহিয়ার সম্পদের বিবরণ:-
চট্টগ্রাম নগরীর খুলসি থানার সামনে ৪০ গন্ডার প্লট, খুলসি ৪/৫ নং রোডে ১০ কাটার প্লট (যেখানে রয়েছে নানা জীবযন্তুর চিড়িয়াখানা), খুলসিতে প্রায় ৩০ কাটা জায়গার উপর ২টি বাড়ি, রাশিয়ান দূতাবাসের পাশে ৭টি তলার আরেকটি বাড়ি (যা সিডিএ’র অনুমোদিত ছাড়াই নির্মিত হয়েছে), নগরীর লালখান বাজারের মূল সড়কের পাশে ৪ গন্ডা জায়গার উপর ৭ তলার শাহপরী টাওয়ার, লাভলেইন পেট্রোল পাম্পের পেছনে এক তলা বাড়ি, কর্ণফুলি ব্রীজের দক্ষিণ পাশে ৪শ’ গন্ডা জমি, ১ হাজার ২শ’ একর জমির উপর ইসলাম টি গার্ডেন, ঢাকা বাড়িধারায় পার্ক রোডে বিলাস বহুল এপার্টমেন্ট, গুলশান লেকের পাড়ে ৭ কাটা জমি, উখিয়া টিভি রিলে কেন্দ্রের পূর্ব পাশে বিশাল শাহপরী গার্ডেন, কক্সবাজার শহরের হোটেল নিরিবিলির পাশে দৈনিক আজকের দেশ বিদেশ পত্রিকা, ছাপাখানা ও তৎসংলগ্ন বিশাল ভূমিটি, কলাতলি রোডের হোটেল মোটেল জোনে ১০ গন্ডা সম্পত্তি, ৬শ’ গন্ডা জমির উপর হিমছড়ি ইউনানী হ্যাচারী, টেকনাফ গুদারবিলে শতাধিক গন্ডা  জমি, সাবরাং ইউনিয়নে ৪ হাজার গন্ডা লবণ মাঠ ও নাল জমি, শাহপরীরদ্বীপে ২টি বরফ কল ও টেকনাফে ২টি তেলের পাম্প এবং প্রাসাদসম কয়েকটি বাড়ি উল্লেখযোগ্য। (তথ্যটি ১৬ মে ২০০৮ইং দৈনিক সমকালে প্রকাশিত সংবাদের)
ইয়াহিয়ার যত গাড়ি:-
বিলাস বহুল জীবনে অভ্যস্ত আনিসুর রহমান ইয়াহিয়ার রয়েছে অত্যাধুনিক সব গাড়ির ভান্ডার। লেটেস মডেলের এমন কোন গাড়ি নেই যা তিনি ব্যবহার করেন না। তৎমধ্যে কয়েকটি গাড়ি বর্তমানে উখিয়া-টেকনাফ সংসদীয় এলাকায় তার ছেলের নির্বাচনী কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। নতুন মডেলের একটি গাড়ি কিনে কিছু দিন ব্যবহারের পর তা বাতিল করে ফের লেটেস্ট মডেলের আরেকটি গাড়ি কিনেন ইয়াহিয়া। সিক্সডোর লিমোজিন, জাগুয়ার, মার্সিডিস ব্যাঞ্চ, বিএনডব্লিউ, হোন্ডা কারের মতো আলিসান গাড়ি রয়েছে তার।
আপন সহোদর ড. হাবিবের দৃষ্টিতে ইয়াহিয়া:-
প্রবাসে বসে আমি দেশের জন্য অনেক কিছু করলেও চোরাচালানি ভাই ইয়াহিয়াদের জন্য আমি দেশে আসতে ভয় পাই। কারণ তারা আমার পেছনে লেগে আছে তা বড় কথা নয়, আপন সহোদর হয়েও তারা আমাকে মেরে ফেলতে চাই। সাংবাদিকদের সাথে একান্ত সাক্ষাতকারে এসব অভিযোগ করেন মাফিয়া ডন শফি ও আন্তর্জাতিক শীর্ষ চোরাচালানি ইয়াহিয়ার ভাই ড. হাবিব। তিনি আরো বলেন, আমার ভাই শফি ও ইয়াহিয়ারা দেশের শত্রু। তারা নানান দেশদ্রোহীতায় জড়িত এমনকি আমার জায়গা-জমি পর্যন্ত এরা জবর দখল করে আমাকে নিঃস্ব করার তৎপরতায় লিপ্ত। তাদের দেশদ্রোহী কর্মকান্ড আমি পছন্দ করিনা বিদায় তাদেরকে ভালো পথে ফিরে আসতে বললে তারা আমার প্রতি ক্ষিপ্ত। বিগত জোট সরকারের আমলে আমি প্রশাসনের উপর মহলে অনেক দেন-দরবার করেছি। কিন্তু কোন দিন ন্যায় বিচার পায়নি। আমার বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া একের পর এক মিথ্যা মামলা করে হয়রানি করেছে। চট্টগ্রাম খুলসিতে আমার জায়গাটিও সে জবর দখলে লিপ্ত ছিল।
ড. হাবিব প্রবাসে থেকে লিখেছেন কাতারের ইতিহাস। তিনি সেখানকার একজন বিখ্যাত ব্যক্তিও। ড. হাবিব আক্ষেপ করে বলেন, আমি আওয়ামী লীগ মাইন্ডেড। কক্সবাজারের একটি আসন থেকে তাই নৌকার মনোনয়ন চাইতে গিয়ে আমার ভাই ইয়াহিয়াদের রোষানলে পড়ি। কারন তারা জানে আমি নির্বাচিত হলে শুধু ভাই কেন, আমার বাপকেও চোরাচালান কিংবা কোন দেশদ্রোহী কর্মকান্ডে লিপ্ত থাকতে দিব না। ইয়াহিয়াদের চোরাই সম্রাজ্যে পতন নেমে আসবে বলেই তারা এতই হিংস্র হতে পেরেছে।
অস্ত্র ও চোরাচালানে ইয়াহিয়া:-
যুগের পর যুগ ধরে আন্তর্জাতিক চোরাকারবার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেছেন ইয়াহিয়ার ভাই মাফিয়া ডন শফি। আর এ কাজে তার দু’হাত হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন ইয়াহিয়া। শফির অস্ত্র ব্যবসার পুরো ভাগের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন তিনি। অপরদিকে সমানতালে চোরাকারবারি কর্মকান্ডের নেতৃত্বও দিয়েছেন তিনি। দেশে যে দলই সরকার গঠন করেন না কেন, দূর্ত চোরাকারবারি ইয়াহিয়া সেই দলের কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গে গভীর যোগাযোগ রক্ষা করেন। অভিযোগ উঠেছে রাজনৈতিক দলের দুঃচরিত্রবান নেতাদের মদ, পতিতা, টাকাসহ যাকে যা দিয়ে বসে আনতে হয় ইয়াহিয়া তার জন্য তাই করে খুব সহজে মন জয় করে ফেলেন। ফলে ক্ষমতাধর ওইসব অসাধুদের সহযোগিতায় তিনি সবসময় পার পেয়ে গেছেন।
অপকর্মে ইয়াহিয়া:-
আল আরাফা ইসলামি ব্যাংকের পরিচালকদের একজন উক্ত ইয়াহিয়া। এছাড়া শাহপরী হোল্ডিংস, ন্যাশনাল সিমেন্ট, রহমানিয়া বনস্পতি সহ বিভিন্ন মালিকানা রয়েছে তার। তবে এসব বৈধ ব্যবসার আড়ালে শত শত কোটি টাকার অবৈধ ব্যবসার নৈপথ্যে ছিলেন ইয়াহিয়া। চট্টগ্রাম কলেজে পড়ার সময় থেকেই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়া ইয়াহিয়া এমন কোন দেশদ্রোহী ব্যবসা নেই যা তিনি করেননি।
সিনেমার মতো জীবন কাহিনী:-
ভৌগোলিক ভাবে শাহপরী দ্বীপের অবস্থান এমনই যে, যার পূর্বে রয়েছে মিয়ানমার দক্ষিণে সেন্টমার্টিন ও বঙ্গোপসাগরের বিশাল জলরাশি। ফলে ভৌগোলিক এই অবস্থানের ফায়দা লুটেছেন সবসময় ইয়াহিয়ারা। টাকার নেশার মক্ত পরিবারের ছেলে বদিউর রহমান প্রথমে অন্ধকার জগতে পা বাড়ান। অবৈধ পথে মিয়ানমার থেকে পণ্য এনে বিক্রি করতেন চট্টগ্রামে। বার্মিজ ওই পণ্যগুলো কয়েক গুণ বেশি দামে বিক্রি করতেন তারা রিয়াজ উদ্দিন বাজারে। চোরাই পণ্যের মধ্যে বেশির ভাগই ছিল ইলেকট্রনিক্স ও কসমেটিকস সামগ্রি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসবের সঙ্গে মাদকদ্রব্য ও যৌন উত্তেজক ওষুধ মিয়ানমার থেকে নিয়ে আসতেন তারা। একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র দাবি করেছে, বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ভয়ংকর মাদক ইয়াবা ট্যাবলেট ঢুকিয়েছেন চোরাচালানি ইয়াহিয়ারা। তবে ওই সময় ট্যাবলেটটি এতো বেশি পরিচিত না হওয়ায় বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে আছে। কিন্তু সত্যটা ধামাচাপা পড়ে থাকলে কি হবে, এই ভয়ংকর মাদক ইয়াবা ট্যাবলেটই এখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনশ্রুতি আছে ওই সময় পুরো চট্টগ্রামে বার্মিজ পণ্যের নিয়ন্ত্রণ করতেন শফি ও তার ভাই বদি। চোরাই পথে বার্মিজ পণ্য আনলে কয়েক গুণ টাকা লাভ এই গুপ্ত খবর ফাঁস হয়ে পড়লে তৎকালীন সময় ইয়াহিয়াদের দলে ভীড়ে বেশ ক’জন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও প্রভাবশালী চক্র। তবে ততদিনেই টাকার পাহাড় গড়ে ফেলেছেন এই চোরাচালানি ইয়াহিয়া চক্র। যে টাকার স্বস্থিতে এখনো তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে আর স্বপ্ন দেখছেন জাতীয় সংসদ সদস্যের মতো পবিত্র জায়গায় প্রতিনিধিত্ব করার।
শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক চোরাচালানে বাংলাদেশের গডফাদার শিল্পপতি উক্ত আনিসুর রহমান ইয়াহিয়ার অজানা আরো চমকপ্রদ তথ্য এসেছে প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে। সেখানে তার অস্ত্র, মাদক, পতিতা ও চোরাচালানে তার অন্যতম সহযোগিদের তথ্য উপাত্ত, তার ভাই মাফিয়া ডন শফির সাকা-বাবর-তারেক কানেকশন রাজস্ব ফাঁকি, সন্ত্রাস লালন-পালন, রোহিঙ্গা কানেকশন সহ বিভিন্ন তথ্য রয়েছে। যা অনুসন্ধান শেষে প্রকাশিত করা হবে। চোখ রাখুন গণমাধ্যমে।
এদিকে ভয়ংকর উক্ত চোরাচালানি গডফাদার ইয়াহিয়াকে নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত অনুসন্ধানি প্রতিবেদনকে সাধুবাদ জানিয়েছে পাঠক সমাজ। অপরদিকে তৎপর হয়ে উঠেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীও। গোয়েন্দা সংস্থা, র‌্যাব, পুলিশ ও প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, ইয়াহিয়ার কুকৃর্তি নিয়ে প্রকাশিত সংবাদের সত্যতা খুঁজতে পৃথক পৃথক ভাবে তারা অনুসন্ধান চালাচ্ছে। সত্যতা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নাম প্রকাশে অনিশ্চুক দুদকের এক কর্মকর্তা জানান, জরুরী অবস্থায় ইয়াহিয়ার জন্য খোলা তার দপ্তরের ফাইলগুলো খুলে দেখার পাশাপাশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদগুলোও তার হাতে পৌঁছেছে। ফলে তিনি এ নিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। শিঘ্রই ইয়াহিয়া ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেন ওই দুদক কর্মকর্তা। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন