তামাকের আগ্রাসনে হুমকির মুখে কৃষি জমি

ডেস্ক রিপোর্ট : 
বান্দারবান জেলার কৃষি জমিতে এখন আর ধান বা শস্যের গন্ধে মৌ মৌ করে না। একসময় এখানকার উৎপাদিত রকমারি শস্যের বেচাকেনা চলতো স্থানীয় বাজারসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। দেড় দশকের ব্যবধানে বান্দরবানের প্রায় ৮০ শতাংশ কৃষি জমি দখল করে নিয়েছে পরিবেশ বিধ্বংসী আগ্রাসী তামাক চাষ। 

প্রতি বছর শস্য মৌসুমে তামাকের ঝাঁঝাঁলো গন্ধে বিষাক্ত হয়ে ওঠে বান্দরবানের পরিবেশ। দু-চোখ যেদিকে যায় শুধু তামাক আর তামাক। বেসরকারি হিসাব মতে, ২০১৩ সালে বান্দরবানে প্রায় লক্ষাধিক হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। তার মধ্যে লামা, আলী কদম, নাইক্ষ্যংছড়ি এবং সদর উপজেলায় তামাকের আগ্রাসন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। স্থানীয় সচেতন মহল জানান, গত ১৫-২০ বছরে বান্দরবান জেলার আবাদি কৃষি জমি ও সরকারি সংরক্ষিত বনভূমিতে তামাক চাষ এমন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে যে, এখানকার প্রাকৃতিক সবুজ পরিবেশ, পাহাড়-মাটি, নদী-খাল ও জীব বৈচিত্র্য হারিয়ে যেতে বসেছে। আদালতের নিষেধাজ্ঞার পরও বান্দরবানে কমেনি তামাক চাষ। অতিরিক্ত আয়ের লোভ দেখিয়ে তামাক কোম্পানিগুলো নিরক্ষর কৃষকদের তামাক চাষে আষ্টেপিষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। এক একর জমিতে ধান চাষ করে কৃষকরা প্রতি মৌসুমে আয় করে ১৫-২০ হাজার টাকা। ধান চাষে পরিশ্রম তুলনামূলক কম। কিন্তু, তামাক কোম্পানিগুলো অতি মুনাফার ফাঁদে ফেলে কৃষকদের হাতে তুলে দিয়েছে তামাক চাষ। যে জমিতে ধান চাষ করে ১৫-২০ হাজার টাকা পেত কৃষক, সেখানে তামাক চাষে পাওয়া যায় দ্বিগুণ অর্থ। ধান চাষের চেয়ে তামাক ক্ষেতে খাটুনির পরিমাণ বেশি হলেও দ্বিগুণ মুনাফার লোভে কৃষকের আগ্রহ তাই তামাক চাষে।
চিকিৎসকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তামাক চাষের কারণে বান্দরবানের অধিকাংশ কৃষকরা বার্জাসসহ নানা রোগে ভুগছে। তামাক ক্ষেতে অতিরিক্ত ইউরিয়া সার, নানা ধরনের কীটনাশক ও সার প্রয়োগ করতে হয়। এতে তামাক চাষিরা চর্মরোগ, হাঁপানিসহ নানা রোগে ভুগে থাকেন।
কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, একই জমিতে বার বার তামাক চাষের ফলে সে জমিতে অন্য ফসল উৎপাদন আশঙ্কাজনক হারে কমে যায়। তামাক চাষ মাটির প্রাণশক্তি একেবারেই নিঃশেষ করে দেয়।
কৃষি শস্য উৎপাদন বিশেষজ্ঞ আলতাফ হোসেন জানান, জেলার অধিকাংশ মাটি বেলে-দোঁআশ থেকে এটেল-দোঁআশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সুদীর্ঘকাল থেকে এখানকার মাটি পাহাড় ধসে, জৈব-রসায়নিক প্রক্রিয়া ও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে নানাবিধ খনিজ পদার্থের মিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছে। ফলে, বান্দরবানের মাটির উর্বরতা সন্তোষজনক নয়। গুণাগুণ সম্পন্ন মাটিতে কমপক্ষে শতকরা ২ ভাগ জৈব পদার্থের প্রয়োজন থাকলেও এখানকার কৃষি জমিতে রয়েছে মধ্যম মানের মাত্র ১.৭২-২.৪৩ ভাগ জৈব পদার্থ।
তার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, কৃষকরা কৃষি জমিতে উপযুক্ত শস্য বিন্যাস না করে তামাক চাষ করে চলেছে। ফলে জমির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে। তামাকের কারণে জমিতে অসম মাত্রায় ইউরিয়া সারের উদ্বেগজনক প্রয়োগ, বিষাক্ত ও নিষিদ্ধ বালাইনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার চলছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ও কোম্পানিগুলোর দৌরাত্ম্য কৃষকদের তামাক চাষে ঠেলে দিয়েছে।
অন্যদিকে, তামাকের করালগ্রাসে জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল ঘিরে থাকা সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও বাঁকখালী নদী নাব্যতা হারিয়েছে অনেক আগে। সেই সাথে এসব নদীর সুস্বাদু মাছও আশঙ্কাজনক হারে বিলুপ্ত হতে শুরু করেছে। তামাক ক্ষেতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও উদ্বেগজনক কীটনাশক ব্যবহারের ফলে নদী তীরবর্তী তামাক ক্ষেতের বিষাক্ত পানি সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও বাঁকখালীর পানি সাথে মিশছে। ফলে এসব নদীতে আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না।
প্রতি বছর লামা বন বিভাগের মাতামুহুরী রিজার্ভের বিস্তীর্ণ বনভূমিতে বন আইন উপেক্ষা উৎপাদিত হাজার হাজার মণ তামাক কিউরিং করতে সংরক্ষিত বনভূমির ভেতর নির্মাণ করা হয়েছে শত শত তন্দুর (চুল্লি)। এসব চুল্লিতে জ্বালানি হিসেবে পোড়ানো হয় কাঠ। জ্বালানি কাঠের বেশিরভাগ স্থানীয় বনভূমি থেকেই সংগ্রহ করা হচ্ছে। ফলে দিন দিন বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়ছে বনাঞ্চল।
আলী কদম উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম জানান, কোম্পানিগুলো দরিদ্র কৃষকদের লোভের ফাঁদে ফেলে তামাক চাষে নিয়োজিত করছে। বর্তমানে পরিবেশ বিধ্বংসী তামাক চাষ উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। তামাক চাষ বিস্তারে কোম্পানিগুলোর কৌশলগত প্রচারণাকেই দায়ী করেন তিনি।
স্থানীয় পরিবেশবাদী জসিম সরওয়ার ও কৃষক নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো জানান, তামাক চাষ সুস্থ পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য ক্ষতিকর। তামাক চাষের ফলে মাটির উর্বরতার নাশ ও নদীর নাব্যতা হ্রাস এবং বন-জঙ্গলের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।
বান্দরবান জেলা প্রশাসন সাঙ্গু, মাতামুহুরী এবং বাকখালী নদীর পাড়ে তামাক চাষ নিষিদ্ধ করলেও তামাক কোম্পানিগুলো তা মানছে না। চলতি বছরও নদীর তীরে অসংখ্য আবাদী জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। জেলায় তামাক চাষ বন্ধে সাংবাদিক আলাউদ্দিন শাহরিয়ার ও আইনজীবী জাফর ইকবাল-এর দায়ের করা মামলায় ২০১০ সালে জেলা জজ আদালত বান্দরবানে ১০ হাজার একর জমিতে তামাক চাষ সীমাবদ্ধ রাখার আদেশ দেন।
আদালতের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে তামাক কোম্পানিগুলো উচ্চ আদালতে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে জজ আদালতের আদেশ স্থাগিত করে।
২০১৩ সালে জেলায় কয়েকগুণ বেশি তামাক চাষ হয়েছে। এ বিষয়ে বান্দরবান বিভাগীয় বন কর্মকর্তা তসিবুল বারী খান জানান, তামাক চুলিগুলো গড়ে উঠেছে মানুষের বসতবাড়ি বা আঙিনার আশেপাশে । এসব তামাক চুল্লিতে গড়ে ২ থেকে ৩ হাজার মণ কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। তবে নিদিষ্ট কোনো আইন না থাকায় বন বিভাগ তামাক চুল্লিতে কাঠ পোড়ানো বন্ধে কোনো অভিযান চালাতে পারছে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন