থামানো যাচ্ছেনা সমুদ্রপথে আদম পাচার

ডেস্ক রিপোর্টঃ একের পর এক ট্রলার ডুবির ঘটনায় প্রাণহানির পর কক্সবাজারের বিভিন্ন উপকুল থেকে সাগর পথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় যাত্রা থেমে নেই। সংঘবদ্ধ প্রভাবশালী দালাল চক্র নানা কৌশলে পুরোদমে এ মানব পাচার অব্যাহত রেখেছে।
গত সোমবার কোস্টগার্ড সদস্যরা ৬ দালালসহ ২২০ জনকে আটক করেছে। আটককৃত ২২০ মালয়েশিয়াগামী যাত্রীকে মঙ্গলবার বিকাল ৪টায় সেন্টমার্টিন থেকে এনে টেকনাফ থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছে কোস্টগার্ড। এদিকে রাত ১১ টায় পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ২০৯ কে মুছলেকা নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।
উখিয়া-টেকনাফের সার্কেল অফিসার ফারুক আহমদ জানান, মালয়েশিয়াগামী ২০৯ জনকে মানবিক সহায়তা প্রদানের পর জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মুছলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়।
কোস্টগার্ড টেকনাফ ষ্টেশনের কমান্ডার লে. হাবিবুর রহমান জানান, সোমবার বিকেলে সেন্টমার্টিনস্থ কোষ্টগার্ড সদস্যরা পশ্চিম বঙ্গোপসাগর থেকে একটি ট্রলার সহ ২২০ মালয়েশিয়াগামী যাত্রীকে আটক করে সেন্টমার্টিনদ্বীপে নিয়ে আসে। মঙ্গলবার ৯ জুলাই বিকাল ৪টায় আটককৃতদের ৪টি ট্রলার যোগে টেকনাফ স্থল বন্দরের ঘাটে এনে টেকনাফ থানা পুলিশের কাছে করা হয়। তিনি আরো জানান, এব্যাপারে জড়িতদের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় মামলা করা হচ্ছে।
এদিকে আটককৃতদের মধ্যে ৬ রাখাইন মাঝিমাল্লাসহ ১১ জন মিয়ানমারের নাগরিক, অন্যান্যরা নরসিংদীর জেলার ৬৫, যশোর জেলার ৫২, কুমিল্লার ১৮, সাতক্ষীরার ১০, নারায়নগঞ্জের ৮, বগুড়ার ৭, মেহেরপুরের ৬, চুয়াডাঙ্গার ৬, রাজশাহীর ১, সিরাজগঞ্জের ২, ময়মনসিংহের ১, জামালপুরের ১, গাইবান্ধার ১, ব্রাহ্মনবাড়িয়ার ৩, টাঙ্গাইলের ১, কুড়িগ্রামের ১, বান্দরবানের ১ ও কক্সবাজার জেলার ১৬ জন সহ মোট ২০৯ জন বাংলাদেশের নাগরিক।
পুলিশ হেফাজতে থাকা আটক নরসিংদীর জাহেদ, সাইফুল ও কালাম জানান, শুক্রবার রাতে কক্সবাজারের চকরিয়া, লোহাগাড়ার পদুয়া ঘাট থেকে শতাধিক যাত্রী নিয়ে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেও পথিমধ্যে উখিয়ার ইনানী, বাহারছড়া, টেকনাফ, সাবরাং ও শাহপরীর দ্বীপ থেকে আরও দেড় শতাধিক লোক বোটে তোলা হয়। সোমবার ভোররাতে কার্গোবোটের চালক ও দালালরা মিলে সাগর উত্তাল থাকায় মিয়ানমারে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করলে আমরা সকলে মিলে মাঝিসহ ছয় দালালকে রশি দিয়ে বেঁধে ফেলি এবং চলন্ত বোট নিয়ে সেন্ট মার্টিনের কাছাকাছি সাগরে ঘুরতে থাকি। পরে জ্বালানি তেল শেষ হয়ে যাওয়াই এক পর্যায়ে দুপুরের দিকে কয়েকটি মাছ ধরার নৌকা দেখতে পেয়ে তাদের কাছ থেকে সহযোগিতা চাইলে কেউ এগিয়ে আসেনি। পরে কোস্টগার্ড সদস্যরা আমাদের উদ্ধার করে সেন্টমার্টিনের কূলে নিয়ে আসে।
দালালের খপ্পরে পড়ে সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে সব হারাচ্ছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সাধারণ মানুষ। মিথ্যা আশ্বাসে এসব দালাল মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে অসহায় দরিদ্র মানুষকে। আর এমন অনিশ্চিত যাত্রা থেকে এদের কেউ ফিরে আসছেন আর কারো ভাগ্যে ঘটছে সলিল সমাধি।
আটক কুমিল্লার রশিদ আহমদ (৪০) জানান, ২ লাখ টাকার বিনিময়ে দালাল কামাল বিমান করে মালয়েশিয়া নিয়ে যাবে বলে পাসপোর্ট করায়। পরবর্তীতে বিমানে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে বলে কক্সবাজার থেকে ট্রলার যোগে মালয়েশিয়ায় পাঠাবে নিয়ে আসে।
সাতক্ষীরার শুক্কুর (৩০) জানান, মালয়েশিয়া নিয়ে যাবে দালালরা ট্রলারে গত ৪ দিন যাবৎ কিছু খেতে না দিয়ে উপুস রেখেছে। এছাড়াও আমাদের মোবাইল, ঘড়ি ও টাকা পয়সা যা ছিল সবকিছু দালালরা নিয়ে ফেলে। চুয়াডাঙ্গা করিম উল্লাহ (৫০) জানান, দেশে খেতে না পেয়ে মারা যাবো। কিন্তু এভাবে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে আর জীবনেও সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাবার চিন্তাও করবো না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টেকনাফ স্থলবন্দরের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, মালয়েশিয়া মানব পাচারকাজে ব্যবহৃত কার্গো বোটটি গত ২৩ জুন মিয়ানমার থেকে কাঠ বোঝাই করে টেকনাফ স্থল বন্দরে স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর কাছে এসেছিল। গত ৫ জুলাই শুক্রবার সকালে মাল খালাস করে মিয়ানমারের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায়। কিন্তু এ কার্গো ট্রলারটি মিয়ানমারে না গিয়ে পূর্বে পরিকল্পিতভাবে কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন ঘাট থেকে মালয়েশিয়া গামী যাত্রী বোঝাই করে অবশেষে সেন্টমার্টিনে গিয়ে কোস্টগার্ডের হাতে আটক হয়।
টেকনাফ মডেল থানার ওসি (তদন্ত) দিদারুল ফেরদৌস বলেন, আটক মিয়ানমারের নাগরিক, দালালদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা করা হচ্ছে।
টেকনাফ ৪২ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্ণেল জাহিদ হাসান জানান, বিচার কার্যক্রম যর্থাথ না হওয়া এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তাদের কারণে মালয়েশিয়া মানবপাচার বন্ধ করা যাচ্ছে না।
প্রসঙ্গত, ২০১২ ও ১৩ সালে বঙ্গোপসাগরে পৃথক ৩টি ট্রলার ডুবির ঘটনায় ২৭০ যাত্রীর মধ্যে ৮৬ জনকে উদ্ধার করে নৌ-বাহিনী, কোষ্টগার্ড, বিজিবি ও স্থানীয় জেলেরা। এছাড়াও উদ্ধার করা হয় ৬ জনের মৃতদেহ। বাকী ১৭৮ জনের আর কোন খোঁজ মেলেনি।