
যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এখনো সহাবস্থানে পৌঁছতে পারেনি কক্সবাজারের দুই চর এলাকা মহেশখালীর সোনাদিয়া ও টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ। শিক্ষা, চিকিৎসা, যাতায়াত সহ মানুষের সব ধরণের প্রয়োজনে এখনো পর্যাপ্ত পরিমাণ সুযোগ-সুবিধা গড়ে উঠেনি। ফলে চরের বাসিন্দারা রয়েছে নানান ভোগান্তিতে।
শাহপরীর দ্বীপ চর:
দেশের সর্ব দক্ষিণ সীমান্ত উপজেলা টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ। এর পরে বঙ্গোপসাগর ও নাফনদী। যা মিয়ানমারের সীমান্তে গিয়ে মিলিত হয়েছে। প্রায় দেড়শ’ বছর আগে গড়ে উঠা এই চরে ৪০ হাজার মানুষের বসবাস। ধান, মৎস্য, লবণ মাঠ, পানের বরজ-ই চরের মানুষের জীবন-জীবিকার প্রধান উৎস। শাহপরীরদ্বীপ হয়ে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন যাওয়ার জন্য অত্যাধুনিক একটি জেটিঘাট রয়েছে। রয়েছে পর্যটকদের যাত্রা বিরতির জন্য ‘রেস্ট হাউজ’। শাহপরীরদ্বীপ চরের প্রবীণ বাসিন্দারা নুরুল হক (৮৯) জানিয়েছেন, ঐতিহ্যবাহী শাহপরীরদ্বীপে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের ছেলে শাহ সুজা তৎসময়ে অবস্থান নেয়। তার মেয়ে পরীবানু ও তাঁর নামানুসারে শাহপরীরদ্বীপের নামকরণ হয়। এ সময় শাহপরীরদ্বীপ ছিল আলাদা একটি দ্বীপ। স্বাধীনতার পূর্বে এ অঞ্চল ছিল একটি বাণিজ্যিক বন্দর এলাকা। তখন পান ছিল এ এলাকার একমাত্র ফসল। ইরানী অন্যতম ধর্ম প্রচারক বদর শাহ এ এলাকার একটি জায়গাতে অবস্থান নেয়ায় উক্ত এলাকাকে বদর মোকাম নামে পরিচিত হয়ে উঠে।
এদিকে গত কয়েক বছর ধরে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় এটি দিন দিন ছোট হয়ে আসছে। স্বাধীনতার পূর্বে শাহপরীরদ্বীপের আয়তন ছিল দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১০ কিলোমিটার। বর্তমানে তা ছোট হয়ে দৈর্ঘ্য ৪ কিলোমিটার ও প্রস্থ ৩ কিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। এভাবে সাগরের করাল গ্রাসে হারিয়ে যাচ্ছে শাহ পরীর দ্বীপের একের পর এক গ্রাম। ১৯৯৩-৯৪ এর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে বদর মোকাম সংলগ্ন সাগর তীরে বিশাল বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে বিলীন হয়ে যায়। পাশাপাশি দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকার বেশ কিছু গ্রাম সাগর গর্ভে তালিয়ে যায়। বিগত বিভিন্ন সনে সরকার উক্ত এলাকার উপকূলীয় মানুষের জান মাল রক্ষার্থে একাধিকবার উপকূলীয় রক্ষাবাঁধ নির্মাণের বরাদ্ধ দেয়। কিন্তু বাঁধ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম, দূর্নীতি ও টেকসই বাঁধ নির্মাণ না করায় অদ্যবধি শাহ পরীরদ্বীপের ভূখন্ড দিন দিন তলিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে শাহপরীরদ্বীপের ভয়াবহ ভাঙ্গনের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে। মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় এখানে অপরাধ কর্মকান্ড স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। মাদক, চোরাচালান সহ বিভিন্ন ভাবে আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি প্রায় সময় ঘটে থাকে। শাহপরীরদ্বীপের ইউপি সদস্য মোহাম্মদ ইসমাইল জানিয়েছেন, চরের বাসিন্দাদের জন্য শিক্ষা ও যাতায়াত ব্যবস্থা একেবারেই নিন্ম অবস্থায়। ভাঙ্গা বেড়িবাঁধ দিয়ে দিনে দুবার করে প্লাবিত হচ্ছে শাহপরীরদ্বীপ চর এলাকা। গত এক সপ্তাহ ধরে মানুষের আগুন জ্বলছেনা। খেয়ে না খেয়ে অতি কষ্টে দিনাপাতিপাত করছে লোকজন। তিনি আরো জানান, শাহপরীরদ্বীপ চরের বাসিন্দাদের একমাত্র যাতায়াতের পথ ‘প্রধান সড়ক’। সড়কটি ভেঙ্গে বিশাল এলাকা পুকুর হয়ে গেছে। কর্মসৃজনের টাকা দিয়ে অপ্রয়োজনীয় কাজ করলেও স্থানীয় চেয়ারম্যান রাস্তাঘাটের কোন উন্নয়ন করেনি। ফলে টেকনাফ তথা পুরো দেশের সাথে এখন শাহপরীরদ্বীপ চরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। রাস্তার উপর নৌকায় চড়েই মানুষকে চলাচল করতে হয়। সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হামিদুর রহমান জানিয়েছেন, যখন কর্মসৃজনের কাজ চলছিল তখন রাস্তাঘাট ঠিক ছিল। তারপরও যেখানে গর্ত হয়েছিল সেখানে সংস্কার করা হয়েছে। জোয়ারের পানির তোড়ে তা আবার ভেসে গেছে।
তিনি আরো জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ আঘাত পেয়েছে শাহপরীরদ্বীপ চর। একদিকে বেড়িবাঁধ নেই। অন্যদিকে জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক ফুট উঁচুতেই প্রবাহিত হচ্ছে। যার ফলে পুরো চর এলাকা এখন পানির নিচে।
এদিকে স্থানীয়রা দাবী করেছেন, শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্য ইত্যাদির সেবা দেয়ার আগে ক্ষতিগ্রস্থ বেড়িবাঁধটি যেন সংস্কার করা হয়। অন্যথায় দেশের মানচিত্র থেকে শীঘ্রই হারিয়ে যাবে শাহপরীরদ্বীপ চর।
সোনাদিয়া চর:
কক্সবাজার জেলার অপূর্ব সৌন্দর্য্য বেষ্টিত মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়নের একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ সোনাদিয়া। সোনাদিয়া দ্বীপের আয়তন ৪৯২৮ হেক্টর। এ দ্বীপটি পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা। সৃষ্টির শৈল্পিক আদলে গড়া কক্সবাজার জেলার পর্যটন শিল্পের আরেক সম্ভাবনাময় চরের নাম ‘সোনাদিয়া’। এখানের বালিয়াড়ি কাছিমের প্রজনন, চামচ ঠোঁটের বাটন পাখি এবং অতিথি পাখিদের অভয়ারণ্য। ব্যক্তি মালিকানাধিন জমির পরিমাণ ০৩.১৫ একর। শুটকি মহাল ০২টি, চিংড়ি চাষ যোগ্য জমির পরিমাণ ৯৮.০০ একর। বন বিভাগের জমির পরিমাণ ২১০০ একর। বাকী সব প্রাকৃতিক বনায়ন ও বালুময় চরাঞ্চল। দুষণ ও কোলাহল মুক্ত সৈকত, লাল কাকড়ার মিলন মেলা, বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক কাছিম, পুর্ব পাড়ার মারহা আউলিয়ার মাজার ও তার আদি ইতিহাস, জেলেদের সাগরে মাছ ধরার দৃশ্য, সুর্যাস্থের দৃশ্য দেখতে অপরূপ লাগে এখানে।
ব্রিটিশ আমল থেকে এ চরে মানুষের পা পড়া শুরু করেছে। বতর্মানে এখানে সহস্রাধিক নারী পুরুষের বসবাস। উপকূলীয় এলাকা সাগরের জলদস্যু কর্তৃক চরবাসী বিভিন্ন সময় হয়রানির শিকার হন। তবে চরের অভ্যন্তরীণ আইনশৃংখলা পরিস্থিতি এখনো প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। চরের বাসিন্দাদের খাবারের প্রয়োজনীয় রসদপাতি সংগ্রহ করতে হয় মহেশখালী ও কক্সবাজার থেকে। ফলে অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে তাদের খাদ্য সামগ্রী কিনতে হয়। দ্বীপের বাসিন্দারা মাছ আহরণ, শুটকী মহাল, লবণ মাঠ, চিংড়ি চাষ ও ধান চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। চরে শিক্ষা ও যাতায়াত ব্যবস্থা এখনো আধুনিকভাবে গড়ে উঠেনি।