কোন পথে দেশ : উথাল-পাথাল রাজনৈতিক সমীকরণ



সিবিএন: বিজ্ঞানসূত্রমতে, রাসায়নিক বিক্রিয়াকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে তরান্বিত করার শক্তি হচ্ছে অনুঘটক। বরফ আগুনের সংস্পর্শে গলতে শুরু করে। আবার আগুন ও আগুন কিংবা বরফ ও বরফ এর মধ্যে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেনা। কারণ দুইয়ের মধ্যে কোন অনুঘটক অনুপস্থিত। আগুন ও বরফের মধ্যে লড়াইটা উত্তাপ ও শীতলতার প্রতিবিরুদ্ধ। রাজনৈতিক মনস্তাত্তিক দৌড়ে শীতল বা উত্তপ্ত যুদ্ধে প্রধান দু’দলই একদিকে আগুন কিংবা অন্যদিকে বরফ।
দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকটের সমস্ত মেঘ সরে গিয়ে অন্ধকার সুড়ঙ্গের প্রান্তরেখায় দেখা মিলেছিল আলোক রোশনী। দেশের মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিল। সবাই ভেবেছে এবার বুঝি ঠান্ডা লড়াই শেষ হচ্ছে। রাজনীতির জমাট বরফ হয়তো গলবে।
চলমান রাজনৈতিক সংকটে বাড়ছে অস্থিরতা, সংঘাত ও সহিংসতা। ওই সংকট থেকে উত্তরণের উপায় কারো জানা নেই। দিন দিন ঘনীভুত হচ্ছে সংকটের বাতাবরণ। দেশের সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন, উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে খেটে খাওয়া মুটেমজুরসহ সকল শ্রেণি পেশার মানুষ। দেশের দুই প্রধান দলের অনড় ও অবিচল অবস্থান এবং বিরোধ যেন “বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সুচাগ্র মেদিনি”।
ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের ভু-খন্ডে ছড়িয়ে পড়েছে রাজনৈতিক হানাহানি, পারস্পারিক আস্থাহীনতা, নিজ নিজ স্বার্থ ও ইগো’র তলে পদপিষ্ট হচ্ছে কোটিজনতার গণতান্ত্রিক অধিকার। “সংলাপ” নামের ঝিলিক রাজনৈতিক অঙ্গনে আশার আলো হিসেবে উদ্ভাসিত হলেও শেষমেশ তা’ও অন্ধকারের ছায়াপথে মিলিয়ে গেছে।
হরতালের বিভীষিকাময় ও সর্বগ্রাসী আতংক গ্রাস করেছে দেশের অর্থনীতির চাকা। স্থবির ব্যবসাবাণিজ্য, আমদানীরপ্তানী ও শিল্পকারখানা। নৈরাজ্যের শিকার শিক্ষাঙ্গন। স্বার্থের বলয়ে সন্তরিত দলবাজী ও দলীয়পনার যাতাকলে পদদলিত দেশের বৃহত্তর গণমানুষের স্বার্থ।
সরকারীদল কিংবা বিরোধীদল কে শোনে কার কথা। ক্ষমতার মোহে কিংবা দূর্নিবার আকর্ষনে তারা ভুলে গেছে ষোলকোটি মানুষের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব-নিকাশ। প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার পৌণপুনিক আত্মশ্লাঘায় দলীয় পতাকায় ঢাকা পড়েছে বাংলার লাল সবুজের পতাকাটি। আওয়ামীলীগ মানে দেশের ষোলকোটি মানুষের পতাকা নয়, কিংবা বিএনপি মানেও ষোলকোটি মানুষের পতাকা নয়। তারা কেবল ষোল কোটি মানুষের একটা অংশ মাত্র। সে হিসেবে হরতাল নামের অভিশপ্ত কর্মসূচি বা বিরোধীদলীয় দাবী কোনটাই দেশের ষোল কোটি মানুষের চাওয়া পাওয়া বা ইচ্ছার প্রতিফলন নয়। “হরতাল” প্রচলিত রাজনীতির অঙ্গনে আন্দোলন বা দাবী আদায়ের সনাতনী পদ্ধতি বলে ধরে নিলেও গণতান্ত্রিক দেশের সকল সংকট ও সমস্যার সমাধানের কেন্দ্রবিন্দু কেবল এবং কেবলমাত্র জাতীয় সংসদ। আক্ষরিক বা প্রচলিত অর্থে সরকারী দল কিংবা বিরোধীদলের ইতিবাচক বা নেতিবাচক কর্মকান্ডের ফলে সেটাও একপ্রকার গণতন্ত্রের শ্বেতহস্তী’তে পরিণত হয়েছে।
হরতাল আহবান বা ডাকা যদি কোন দলের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যম বা গণতান্ত্রিক অধিকার হয় তবে হরতাল পালন করা বা পালন না করাও গণমানুষের সাংবিধানিক অধিকার। হরতাল আহবানের দাবী জনগণ সমর্থন করলে জনগণকেই স্বতঃস্ফুর্তভাবে হরতাল পালন করার অধিকার দেয়া উচিত। জালাও পোড়াও, ভাংচুর, বোমাবাজি, চোরাগুপ্ত হামলার মাধ্যমে আতংক ও ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে জনগণের অধিকারহরণ করা বা জনগণকে হরতাল পালনে বাধ্য করা সাংবিধানিক অধিকার ও মানবাধিকার লংঘনের শামিল। গণমানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারহরণের অধিকার বিরোধীদল বা সরকারীদলের নেই। আহুত হরতাল পালন করা বা সমর্থন করার এখতিয়ার শুধুই নালায়েক নাখান্দা, খেটে খাওয়া গণমানুষের। আতংক, সন্ত্রাস বা ভীতি সঞ্চার করে হরতাল পালনে বাধ্য করার অধিকার যেমন কোন রাজনীতিদলের নেই, তেমনি প্রজাতন্ত্রের নাগরিক হিসেবে জানমালের নিরাপত্তাবিধান করাও শাসকের দায়িত্ব।
বিরোধীদল বা শাসকদল কোন দলেই গণতন্ত্রায়নে বিশ্বাসী নয়। আর বিশ্বাসী নয় বলে গণমানুষকে তাদের নৈতিক বা অনৈতিক, সাংবিধানিক কিংবা অসাংবিধানিক চাওয়া-পাওয়ার পাপেট বানিয়ে ক্ষমতায়ন কিংবা ক্ষমতার দীর্ঘস্থায়ী বন্দোবস্তী অর্জনের পথে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতে কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। সুষ্ঠু নির্বাচন বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তরে নাগরিক অংশগ্রহণ সকল নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। সেই অধিকার সমুন্নত রাখতে শাসকদল এবং বিরোদীদল উভয়কে পারস্পারিক আস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে সহনশীল মনোভাবে এগিয়ে আসার কোন বিকল্প নেই।
চলমান রাজনৈতিক সংকট ও ঘণয়ামান অন্ধকার দেশের সকল শ্রেণিপেশার মানুষকে একপ্রকার রাজনীতির মনস্তাত্তিক ক্রীড়ানকে পরিণত করেছে।
বাংলার ভাগ্য আকাশে আজ দূর্যোগের ঘনঘটা, তার শ্যামল প্রান্তরে আজ রক্তের আল্পনা, জাতির সৌভাগ্য সূর্য আজ অস্তাচলগামী। শুধু সুপ্ত সন্তান শিয়রে রোরুদ্যমনা জননী নিশি অবসানের প্রতীক্ষায় প্রহর গণনায়রত। কে তাকে আশা দেবে, কে তাকে ভরসা দেবে, কে তাকে শুনাবে জাগরণের অভয়বানী।
বাংলার স্বাধীন শেষ নবাব সিরাজদৌলা পলাশীযুদ্ধের অবশ্যাম্ভাবী পরাজয় আঁচ করতে পেরে সভাসদে বাংলার করুণ পরিস্থিতি সম্পর্কে যে সংলাপ উচ্চারণ করেছিল সেটাই যেন আজকের বাংলাদেশের ষোল কোটি জনতার কন্ঠে প্রকম্পিত হচ্ছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন