সমন্বয় জটিলতায় বিএনপি, ক্ষুব্ধ তৃণমূল

আমাদের সময় ডটকম: বিএনপির সমন্বয়হীনতা নিয়ে দলটির নেতাকর্মীদের অভিযোগ বেশ আগের। সম্প্রতি এটি প্রকট আকার ধারণ করেছে। তৃণমূলের নেতাকর্মী দূরে থাক স্বয়ং দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ফোন করে অনেক নেতাকে পাচ্ছেন না। এতে করে খালেদা জিয়া দলের কর্মপন্থা সঠিকভাবে নেতাকর্মীদের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না। অন্য নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব ঠিক করতে যার ওপর আস্থা রেখে খালেদা জিয়া দায়িত্ব দিচ্ছেন তিনিও নিজের স্টাইলে গুলিয়ে ফেলছেন। আর সরকারবিরোধী আন্দোলন কর্মসূচিতে সমন্বয়হীনতা চরম আকার ধারণ করায় দলটির তৃণমূলে ক্ষোভ বিরাজ করছে।


ক্ষুব্ধ তৃণমূলের নেতারা বলছেন, ‘চেয়ারপারসনকে সরকার অবরুদ্ধ করে রাখে। তার ওপর নজরদারি আমরাও মেনে নিয়েছি। কিন্তু বাকিদেরও তো আমরা পায় না। তাহলে দলে তাদের কাজটা কী?’

তারা বলেন, ‘একেকজন একেক সময় কর্মসূচি দেন। এতে আমরা বিভ্রাšত্ম হচ্ছি। কর্মী-সমর্থকদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত করাতে সমস্যা হচ্ছে।’

নির্বাচনের আগে থেকে নির্দলীয় সরকারের দাবিতে তৃণমূলে শক্ত আন্দোলন গড়ে তোলে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোট। এর ফলে সারা দেশে পুলিশের মামলায় হাজারো নেতাকর্মী এখন ফেরারি। বাড়িঘরে যৌথ বাহিনীর বুলডোজার। দিশেহারা তাদের পরিবার।

এরপর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঠিক দিক-নির্দেশনা নেই। পুলিশের সঙ্গে এখন সারা দেশেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ক্ষমতাসীনরা। তাদের হাতে নিয়মিত মার খেতে হচ্ছে। ক্ষুব্ধ নেতারা এ থেকে পরিত্রাণ পেতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার হ¯ত্মক্ষেপ কামনা করেছেন।

চেইন অব কমান্ড ঠিক করে আন্দোলন জোরদার, না হয় অন্য পন্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন তারা। এ ধরনের সমন্বয়হীনতা বিপর্য¯ত্ম নেতাকর্মীদের জীবন বিপন্ন করে তুলবে বলেও মত দিয়েছেন তারা।

বিএনপির সমন্বয়হীনতা ধরা পড়ে সর্বশেষ লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি নিয়ে। দলের ভাইস চেয়ারম্যান ড. ওসমান ফারুক ভিডিও বার্তায় এই কর্মসূচি অব্যাহর রাখার ঘোষণা দেন। পরে তা স্থগিত করা হয়। তবে কে স্থগিত করেছে, তা রীতিমত তালাশের ব¯ত্মুতে পরিণত হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব ও দপ্তরের দায়িত্বে রুহুল কবীর রিজভী গ্রেপ্তারের পর এই সমন্বহীনতা প্রকট আকার ধারণ করে। রিজভীর পর এ দায়িত্ব দেওয়া হয় আরেক যুগ্ম-মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে। তিনি সরাসরি না এসে ভিডিও বার্তার আশ্রয় নিলে ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, মেজর (অব.) হাফিজকে দলীয় মুখপাত্রের কাজ করতে বলা হয়।

সেলিমা রহমান ও মেজর হাফিজ গ্রেপ্তার হলে কর্মসূচির জন্য দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা তার উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনকে দায়িত্ব দেন। তিনিও গ্রেপ্তার হন। এর পরই দায়িত্ব পান ভাইস চেয়ারম্যান ওসমান ফারুক। তবে তিনি এখন আশ্রয় নিয়েছেন ভিডিও বার্তার।

জানা গেছে, বিএনপি চেয়ারপারসন যাদের দায়িত্ব দিয়েছেন, তাদের বলেই দিয়েছেন অন্য জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা আর নিজ প্রজ্ঞা খাটিয়ে চলমান কর্মসূচি ঘোষণা করতে। তবে ওসমান ফারুক আগের কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় টানা অবরোধ ঘোষণা করেন। তিনি এই সপ্তাহের ১৪ জানুয়ারি পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবীর (সা.) কথা বেমালুম ভুলে যান। পরে বিষয়টি খালেদা জিয়া টের পেয়ে কর্মসূচি স্থগিত করান।

এছাড়া সম্প্রতি চেয়ারপারসনকে অবহিত না করেই তার বাসার সামনে শতাধিক সাংবাদিককে জড়ো করেন তার প্রেস উইংয়ের সদস্যরা। পরে রাতে এসে তারাই ক্ষমা চেয়ে বলেন, ‘অনিবার্য কারণে আজকের এই ‘দেখা করা’র কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে।’

এসবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তারা মনে করেন, ঢাকার বাইরে রাজপথ দখল করে রাখলেও রাজধানীর একটি গলিও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেনি ডাক সাইটে নেতারা। গোপন ভিডিও বার্তা আর সংবাদ বিবরণীতে সীমাবদ্ধ রেখেছেন নিজেদের রাজনৈতিক পরিম-ল।

বিএনপির এমন নিষ্ফল অবস্থানের কারণেই একতরফাভাবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে ক্ষমতাসীন হয়েছে আওয়ামী লীগ। ইতোমধ্যে জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলের আসন এবং মন্ত্রিত্ব দিয়ে গঠিত হয়েছে অভিনব এক সরকার। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, ‘এই সরকার ২০১৯ সাল পর্যšত্ম ক্ষমতায় থাকবে।’

সরকারের এমন হার্ড-লাইনে বিএনপি হঠাৎ করেই আন্দোলন স্থগিত করে। এতে সারা দেশে আন্দোলনরত বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। একপক্ষ মনে করছে, এটি চালিয়ে যাওয়ায় উচিত। আরেক পক্ষের মত, জনগণের জন্য আন্দোলন। সুতরাং জনগণকেও কিছুটা সময় দেওয়া উচিত। এতে আন্দোলনে নতুন গতি পাবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বগুড়া জেলা বিএনপির এক নেতা আরটিএনএন- কে বলেন, ‘আমরা আমাদের এলাকায় যে আন্দোলন শুরু করেছিলাম, তার দশ ভাগের এক ভাগও ঢাকায় হলে শেখ হাসিনা একতরফা নির্বাচনের সাহস দেখাতেন না।’

কেন্দ্রীয় নেতাদের দালালির কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও  আওয়ামী লীগের হাতে তৃণমূলে মার খেতে হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।

ক্ষোভ প্রকাশ করে ওই নেতা বলেন, ‘নির্বাচনের আগে খন্দকার মাহবুব হোসেন অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সেই অনুযায়ী আমরা মাঠে ছিলাম। শনিবার হঠাৎ করে টিভিতে দেখলাম সোম ও মঙ্গলবার অবরোধ স্থগিত। ঠিক দুই ঘণ্টা পর দেখলাম সোমবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ স্থগিত।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ওই ছাত্রদল নেতা বলেন, ‘মঙ্গলবার পবিত্র মিলাদুন্নবী (সা.) নেতাদের না জানার কথা নয়। তাহলে সেভাবে কেন কর্মসূচি দেওয়া হলো না। আর দিলে তা আবার কেন প্রত্যাহার হলো? আমরা এখন কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না। কেন্দ্রীয় কোনো নেতাকে ফোনে পাই না। কর্মসূচি নিয়ে এমন বিভ্রাšিত্ম দূর না হলে তৃণমূল আন্দোলন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।’

লক্ষ্মীপুর জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের এক নেতা বলেন, ‘বিএনপিতে এখন আর কোনো কমান্ড নেই। সমন্বয়হীন হয়ে পড়েছে গোটা নেতৃত্ব। কেউ কারো সঙ্গে যোগাযোগ করছে না, যে যার মত করে কর্মসূচি দিচ্ছেন, আবার স্থগিতও করছেন। জেলের বাইরে এত জ্যেষ্ঠ নেতা থাকতে সহ-দপ্তর সম্পাদকদের কর্মসূচি ঘোষণা করতে হচ্ছে, এটি লজ্জাজনক।’

প্রায় অভিন্ন মত ব্যক্ত করেন চাঁদপুর, দিনাজপুর, নোয়াখালী, হবিগঞ্জ, রাজশাহীসহ বিভিন্ন জেলার নেতারা।

তবে এ অবস্থা খুব শিগগিরই কেটে যাবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা। তারা মনে করেন, দীর্ঘ ১৫ দিন অবরুদ্ধ থাকার পর শনিবার নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আসতে পেরেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। আর এখন তিনি দল ও জোটের শরিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে দ্রুত সব ঠিক করে ফেলতে পারবেন।

খালেদা জিয়া কার্যালয়ে আসার পরই শনিবার রাত ৮টার দিকে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব এক বিবৃতিতে জানান, ‘ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে সোম-মঙ্গলবার দুদিন অবরোধ স্থগিত থাকবে। বুধবার থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যšত্ম অবরোধ চলবে। রাত ঠিক ১০টায় বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে দুদিন নয়, পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা না করা পর্যšত্ম অবরোধ স্থগিত।’

কিন্তু কে কিভাবে কাকে এ সিদ্ধাšত্ম জানালো এ নিয়ে সেখানে অবস্থানরত গণমাধ্যম কর্মীসহ উপস্থিতি নেতাকর্মীদেরও বিভ্রাšত্ম হতে দেখা যায়। কেউ বলেন, মহাসচিব জানিয়েছেন। কেউ বলেন দলের সহ-দপ্তর সম্পাদক শামীম একথা জানিয়েছেন।

কিন্তু তাদের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো উপায় নেই। দুজনের মুঠোফোন বন্ধ। এক পর্যায়ে বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয়ের কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকর্মীদের পরিষ্কার জানান, ‘নতুন সিদ্ধাšেত্মর কথা তারা জানেন না।’

এমন সময় সেখানে উপস্থিত বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবিহউদ্দিন আহমেদের কাছে কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে, তিনি ‘না’ সূচক উত্তর দেন। এক পর্যায়ে তিনি নিজেই ফোন করে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করেন এবং ব্যর্থ হন।

তবে রাত ১১টায় গণমাধ্যকে পাঠানো এক সংশোধিত বিবৃতির মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত করেন চেয়ারপারসনের কার্যালয়। ততক্ষণে দেশের বেশিরভাগ জাতীয় পত্রিকার প্রথম সংস্করণ এলাকার পথে। অবরোধের মত একটি কর্মসূচি স্থগিতের বিষয়ে দলের দায়িত্বশীল নেতাদের এমন আচরণে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।

এতে প্রশ্ন উঠেছে, কে বিএনপির মুখপাত্র? মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নাকি শামীমুর রহমান? কার সিদ্ধাšেত্ম চলছে কর্মসূচি? মির্জা আলমগীর, নাকি শামীমের?

এদিকে, গত বৃহস্পতিবার বিএনপি চেয়ারপারসনকে না জানিয়েই তার প্রেস উইং সদস্যরা বিএনপি বিটের অšত্মত দেড়শতাধিক সংবাদকর্মীকে মতবিনিময়ের কথা বলে গুলশানে খালেদার বাসভবনে ডাকেন। শীতের মধ্যে দীর্ঘ দুই ঘণ্টা রা¯ত্মায় দাঁড় করিয়ে রেখে রাত ১০টায় বলা হয় অনুষ্ঠান অনিবার্য কারণে স্থগিত। এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান সাংবাদিকরা।

দলের এই সমন্বয়হীনতা প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান আরটিএনএন- কে বলেন, ‘বিএনপি সেনাবাহিনী নয়, এটি একটি বড় রাজনৈতিক দল। এখানে মতের অমিল থাকবেই।’

তবে তিনি বলেন, ‘কর্মসূচি স্থগিত নিয়ে যা হয়েছে, সেটা অনাকাক্সিক্ষত এবং বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আ¯েত্ম আ¯েত্ম সব ঠিক হয়ে যাবে। এটিকে দলের ভেতরের সমন্বয়হীনতা বলে চালানোর কোনো সুযোগ নেই।।’

এক প্রশ্নের জবাবে মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘জেলা পর্যায়ের নেতারা কীভাবে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে? কেন্দ্রীয় নেতারা তো সব জেলে। যোগাযোগ করতে হলে জেলে যেতে হবে বা তীব্র আন্দোলন গড়ে সরকারের পতন ঘণ্টা বাজাতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন