আরবে জীবন্ত ইসলামকে দেখেছি ( ৪র্থ পর্ব )

এ এম জি ফেরদৌস
ভাবতে ভাবতে চলে গেলাম জান্নাতুল বাকী কবরস্থান এর কাছে, যেখানে শুয়ে আছেন হযরত ফাতেহা (রা:), হযরত উসমান (রা:)সহ প্রায় দশ হাজার সাহাবী। কড়া পাহারা সেখানকার চতুর্দিকে দাঙ্গা পুলিশ সার্বক্ষণিক ঘিরে রেখেছে।
একটা নির্দিষ্ট সময়ে হাজীদের যিয়ারতের জন্য গেইট খুলে দেয়া হয়। ইচ্ছে করছিল কবর থেকে এক মুঠো মাটি নিয়ে পকেটে ভরি। কিন্তু পুলিশের ভয়ে তো সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আর পুলিশ এজন্য কড়া পাহারা দিচ্ছে অতি ভক্তিতে বেদাত বা শিরকের পর্যায়ে পড়ে এমন কোন কাজ যেন কেউ করতে না পারে। পরের দিন কিছু তথ্যের জন্য ছুটলাম। ইবাদত মুখ্য হলেও মনের খোরাক জোগাড় করতে করতে ইবাদত গৌন পর্যায়ে চলে গেল।
সম্মানিত পাঠকদের অবগতির জন্য কিছু তথ্য দেয়া জরুরি। মদিনার পূর্ব নাম ছিল ইয়াছরিব। হিযরতের পরে নাম হয়েছে মদিনাতুল রাসুল বা রাসুলের শহর বা মদিনা শহর। মসজিদুল হারাম, মসজিদে নব্বী ও মসজিদুল আক্বসা এই তিনটি স্থান ব্যতীত অন্য কোন স্থানে জিয়ারতের উদ্দেশ্যে নিয়ত করতে নিষেধ করা হয়েছে। মদিনা থেকে মক্কা শহর উত্তর দিকে অবস্থিত। তাই মদিনায় দক্ষিণমুখী হয়ে নামাজ পড়তে হয়। দক্ষিণ জেদ্দায় নামাজ পড়তে হয় পূর্বদিকে মুখ করে। উত্তর জেদ্দায় দক্ষিণ পূর্বদিকে মুখ করে নামাজ পড়তে হয়। 
আমাদের বাংলাদেশ যেহেতু পবিত্র মক্কা শরীফের পূর্বদিকে অবস্থিত, সেহেতু আমরা পশ্চিমদিকে মুখ করে নামাজ আদায় করি। মসজিদে নববীর চারপাশে মোট ৯ টি প্রধান দরজা এবং অনেকগুলো ছোট ছোট দরজা রয়েছে। মসজিদে নববীর ভিতরে ১২টি, বাহিরে নতুন সম্প্রসারিত অংশে ২৭টি মোট ৩৯ টি বৈদ্যুতিক ছাতা আছে। বর্তমানে মসজিদের ভিতরে  এক লক্ষ আটাত্তর হাজার মুসল্লী এবং মার্বের পাথর চত্বরে ও ছাদে ৬৭ হাজারসহ সর্বমোট ২ লাখ ৪৫ হাজার মুসল্লি একসাথে নামাজ পড়তে পারে। মসজিদে নববীতে মোট ১০ টি মিনার আছে। তার মধ্যে রাসুলুল্লাহ (স:) এর রওজা মোবারকের উপর গম্বুজের রং সবুজ আর অন্যান্যগুলো সাদা। এখনও মদিনাবাসীর আতিথিয়তা নজর কাড়ার মতো, যা আপনাকে অতীতের অনেক কিছুকে স্মরণ করিয়ে দেবে। মাগরিবের নামাজের পূর্বে পুরো মসজিদে দস্তরখানা বিছিয়ে খেজুর ও বিভিন্ন নাস্তা, চা কফি নিয়ে আপনার হাত ধরে টানা-টানি করবে। তাদের আন্তরিকতায় মনে হবে, আপনি যেন কত যুগ ধরে তাদের চেনা-জানা কাছের পরম বন্ধু। ভালবাসার এ এক বিরল দৃষ্টান্ত। 
আপনি ওহুদের যুদ্ধের স্থান যদি পরিদর্শনে যান, আর মুসলিম ইতিহাসে বর্ণিত ওহুদের যুদ্ধের বর্ণনা বা ধারণা যদি আপনার জানা থাকে, তাহলে আপনার শরীরে যতগুলো লোম আছে, তা সব খাড়া হয়ে যাবে। মনে হবে আপনি নিজেই যেন যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে ওহুদের ময়দানে হাজির হয়েছেন। আপনার চোখের সামনে যেন দেখতে পাচ্ছেন, কাফেরদের ৩০০০ সৈন্য বাহিনীর সাথে মুসলমানদের ৭০০ জন নওজোয়ান জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে চলছে। উল্লেখ্য যে, মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা ছিল ১০০০ জন, কিন্তু মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ৩০০ জন সৈন্য নিয়ে যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে যান। বীর সেনাপতি রাসুলুল্লাহ (স:) এর চাচা হযরত হামজা (রা:) বীর বিক্রমে কাফেরদের মোকাবিলা করে চলছেন। আর রাসুলুল্লাহ (স:) কে কতিপয় সাহাবি নিজেদের দেহের বেস্টনি দিয়ে, নিরাপদ স্থানে সরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেণ। মুসলমানদের সাঁড়াশি আক্রমণে কাফেররা পরাজিত হয়ে পালাচ্ছিল কিন্তু কমান্ডারের আদেশ অমান্য করলে যা হয়, তাই হল। 
আল্লাহর নবীর আদেশ অমান্য করে গিরিপথের মুখ পাহারারত কিছু জোয়ান গনীমতের মালের আশায় কাফেরদের পিছু নেওয়ায় খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে একদল কাফের সৈন্য পিছনের দিক দিয়ে মুসলমানদের ওপর চড়াও হল। (উল্লেখ্য যে, খালেদ বিন ওয়ালিদ (রা:) তখনও মুসলমান হননি)। বিজিত ময়দান পরিণত হল পরাজিত ময়দানে। ইতিহাসের জঘন্য অধ্যায় রচিত হল। প্রিয় নবীজির দন্ত মোবারক শহীদ হল, আরও শহীদ হলেন ৭০ জন মুসলিম নওজোয়ান। তৎমধ্যে নবীজির আমৃত্যু চোখের জলে বুক ভাসাতেন। হিন্দার ভ্রাতা জোবায়েরের গোলাম ওয়াশির পিছন থেকে ছুঁড়েমারা বল্লম হযরত হামজা (রা:) বক্ষভেদ করলে, গগন বদারী কণ্ঠে আল্লাহু আকবর বলে বীর সেনাপতি ভূমি শয্যা নিলেন। চতুর্দিক থেকে ঘিরে রাখা হামজা (রা:) শহীদ হওয়ার সে স্থানটা তীক্ষè দৃষ্টিতে চোখ বুলালে মনে হয়, জমিন যেন এখনও হামজা (রা:) এর পদদর্পে কম্পিত হচ্ছে। আরও হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটল তখন, যখন হিন্দা হামজা (রা:) এর বক্ষ বিদীর্ন করে কলিজা চর্বন করলেন। মানবতার ইতিহাসে এক জঘন্য ঘটনার জন্ম দিল ওহুদের যুদ্ধ, যার স্মৃতিচারণে আপনি হওয়া উঠবেন একজন তেজদীপ্ত নওজোয়ান। যার ঈমানের গন্ডি ছাড়িয়ে যাবে, আরবের গৌরবময় স্মৃতি বিজড়িত জীবন্ত ইসলামকে না দেখা মুসলমানদের চেয়ে অনেক অনেক উপরে।

চলুন তায়েফের পথে

মক্কা থেকে ৮০/৯০ কি.মি. দূরে আরবের সমভূমি হতে প্রায় ৫/৬ হাজার ফুট উঁচুতে বিশাল এক পাহাড়ি ভূমির নাম তায়েফ। তায়েফ ইসলামের ইতিহাসের এক গুরুত্ব জনপদ। যেখানে আল্লাহর রাসুল (স:) মক্কার মুশরেকদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে কিছু সাহাবি নিয়ে প্রথম হিজরত করেছিলেন। তায়েফের ইতিহাসে কমবেশি আমরা সকলেই জানি। রাসুলুল্লাহ (স:) এর চলার পথে কুটনী বুড়ির কাঁটা বিছানোর কাহিনী, উঁচু পাহাড় থেকে আমাদের নবীজিকে হত্যার জন্য পাথর ফেলার কাহিনী, মুশরিকগণ শয়তান ছেলেদের দিয়ে প্রিয় নবীজিকে পাথর মেরে রক্তাক্ত করার কাহিনীসহ আরও অনেক রক্তাক্ত ইতিহাসের ভূমি হলো এই তায়েফ।
হাজীদেরকে ঢুকতে দেয়া হয়না তায়েফে। আমরা নাছোড়বান্দা, যেভাবেই হোক তায়েফ যেতেই হবে, আমাদের পিএমখালীর কৃতি সন্তান মক্কার খুব বড় ব্যবসায়ী ফিরোজ মিয়ার একটি জিএমসি গাড়ি , কক্সবাজার মুহুরীপাড়ার মোহাম্মদ আলী সিকদারের একটি প্রাইভেট গাড়ি, পিএমখালীর আরেক কৃতি সন্তান আবদুর রহিম ভাইয়ের একটি প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে আমরা ওমরা হাজীগণ ভাগা-ভাগি করে উঠলাম। তায়েফের প্রবেশ পথে চেক পয়েন্টে পুলিশ হয়তো আমাদের দামি দামি প্রাইভেট গাড়ি দেখে আরব ভেবে চেক না করে চলে যাওয়ার ইশারা করায় সকলে আল্লাহর শুকুরিয়া আদায় করলাম। চলবে....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন