গ্রেপ্তার হচ্ছে না কেন ইয়াবা সম্রাটরা?

ফরিদুল মোস্তফা খান: কয়েকদিন ধরে প্রকাশিত ইয়াবার সংবাদে সীমান্ত জনপদ টেকনাফসহ জেলার সর্বত্রে তোলপাড় চলছে। সংশ্লিষ্ট ইয়াবা ব্যবসায়ীরা আবারো গা ঢাকা দিতে শুরু করেছে। তবে সীমান্তের বেশ কয়েকটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, গণমাধ্যমে ইয়াবা ব্যবসার খবর ফাঁস হয়ে যাওয়ায় এবার ব্যবসায়ীরা কৌশল পরিবর্তন করে বাণিজ্য চালাচ্ছে। তারা সাম্প্রতিক সময়
হ্নীলা ফুলের ডেইল এলাকাকে ইয়াবা পাচারের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করছে। ফলে ওই এলাকায় বর্তমানে রাতদিন সমানতালে মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা নিষিদ্ধ এই ট্যাবলেটটি জমজমাট ক্রয়-বিক্রয় চলছে। এলাকাবাসি জানান, বাঘা বাঘা ইয়াবা ব্যবসায়ীর চেয়ে এখন হ্নীলা এলাকায় ছোটখাট অনেক ইয়াবা ব্যবসায়ীর উত্থান ঘটেছে। যারা প্রতিদিন মুঠো মুঠো ইয়াবা ছড়িয়ে দিচ্ছে জেলা শহরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে। সূত্র জানায়, সংবাদপত্রে দফায় দফায় সীমান্তের ইয়াবা সম্রাটদের বস্তুনিষ্ঠ ফিরিস্তি তুলে ধরার পরও প্রশাসন এখনো তাদের গ্রেপ্তার করতে না পারায় সংশ্লিষ্ট জনপদে গণঅসন্তোষ বিরাজ করছে। সচেতন লোকজন কানাঘুষা করে বলছেন, এসব ইয়াবা ব্যবসায়ীদের এত শক্তির উৎস কোথায়? পুলিশের খাতায় পলাতক থাকলেও এলাকায় দিব্যি অবস্থানরত এসব ইয়াবা ব্যবসায়ীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার জন্য সচেতন মহল আবারো প্রশাসনের আন্তরিক হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।
কারণ এই অঞ্চলে ছোট-বড় অগণিত ইয়াবা ব্যবসায়ীদের মধ্যে নিম্নে উল্লেখিত ইয়াবা ব্যবসায়ীরা, শুধু ব্যবসায়ী নয়, তারা একেকজন ভয়ংকর এই মাদকের গোডাউন। কাজেই সময়মত এদের প্রতিহত করা না গেলে প্রশাসন যতই তৎপর হোক না কেন, ইয়াবা ব্যবসা কোন অবস্থায় বন্ধ হবে না। 
নুরুল হুদা, লেদা এলাকার আরেক আলোচিত ইয়াবা ব্যবসায়ী। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যাওয়ার পথে রঙ্গিখালীর পর লেদা এলাকায় রাস্তার পাশে নব-নির্মিত যেসব রাজকীয় বাড়িগুলো চোখে পড়ার মত সেগুলোর মালিক সে নিজে ও তার ভাই নূর মোহাম্মদ, আবু তাহের ও কয়েকজন নিকটাত্মীয়। 
জানা গেছে, এই নুরুল হুদার ডজন ডজন গাড়িসহ হাজার কোটি টাকার সহায় স¤পত্তি হয়েছে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে। অথচ কয়েক বছর আগে সে ছিল এলাকার অতিনগন্য একজন সাধারণ মানুষ। অ™ভুত ব্যাপার হচ্ছে, বৈধ উপার্জন ছাড়া ইয়াবা ব্যবসা করে ধর্নাঢ্য হয়ে উঠা উক্ত নুরুল হুদার বাড়ির প্রবেশপথে এখন ৫/৬টি সিসিটিভি ক্যামেরা, চব্বিশ ঘন্টা ইউনিফর্ম পড়া পাহারাদার আছে ৪/৫ জন। 
টেকনাফ বড় হাবিব পাড়ার ছিদ্দিক, হাসান এবং আমিন এখন কোটিপতি। তাদের বাড়িঘর দেখলে মনে হবে এ যেন রাজপ্রাসাদ। অথচ কিছুদিন আগেও তাদের খুব একটা বেশিকিছু ছিল না। মৌলভীপাড়ার বাসিন্দা হাজী ফজল আহমদের ছেলে আবদুর রহমানের বয়স এখনও ২৭ পার হয়নি। বছর দুয়েক আগেও তিনি কর্মহীন বেকার হয়ে এলাকায় ভবঘুরে ছিলেন। এখন তিনি চড়েন নতুন মডেলের ঝকঝকে একটা নোয়া মাইক্রোবাসে। তাদের থাকার জায়গায় রাতারাতি গড়ে তোলা হচ্ছে দোতলা বিলাসবহুল বাড়ি। এলাকার বাসিন্দা জানায়, আবদুর রহমান এরমধ্যে এলাকায় প্রচুর আবাদী জমিও কিনেছেন। টেকনাফের নাফ কুইন মার্কেটে ২০ লাখ টাকা দিয়ে কিনেছেন ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। অভিযোগ, ইয়াবা ব্যবসার কাঁড়ি কাঁড়ি কাঁচা টাকাই আবদুর রহমানকে রাতারাতি বিত্তবৈভবের মালিক বানিয়ে দিয়েছেন। বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও অর্থ বিনিয়োগ করছেন। 
এছাড়া কিছুদিন আগে আবদুর রহমান তার এক বোনের বিয়ের অনুষ্ঠান করেছেন। এলাকাবাসী জানিয়েছে, জাঁকজমকপূর্ণ ওই বিয়েতে অন্তত ৫০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। বিয়েতে বোনের জামাইকে উপহার হিসেবে দিয়েছেন ২৫ লাখ টাকা দামের গাড়ি। টেকনাফের মৌলভীপাড়ায় আবদুর রহমানের আরেক ভাই একরামও প্রাসাদোপ্যম বাড়ি নির্মাণ করছেন। অথচ তাদের পিতা ফজল আহমদ একসময় ক্ষুদ্র ব্যবসা ও কৃষিকাজে জড়িত ছিলেন। আবদুর রহমান ও একরাম দুজনের বিরুদ্ধেই ইয়াবা চোরাচালানের মামলা রয়েছে। প্রকাশ্যে সবসময় ঘোরাফেরা করলেও পুলিশের খাতায় তারা পলাতক আসামি। তাদের সাথে যোগাযোগ করা হলে আবদুর রহমান বলেন, তিনি ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নন। এতবেশি ধনস¤পদও তার নেই। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তার বিরুদ্ধে কয়েকটা মামলা দেয়া হয়েছে।
লেইট্যা আমির : মৌলভীপাড়ার আরেক কোটিপতি আমির আহমদ ওরফে লেইট্যা আমির। এলাকাবাসী জানায়, ৫/৬ বছর আগেও তার পরিবার রাস্তার পাশে পিঠা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু হঠাৎ করে তারা যেন হাতে আলাদীনের চেরাগ পেয়েছেন। হাবিব উল্ল¬াহর ছেলে আমির আহমদ বিপুল পরিমাণ জমিজমার মালিক। চলাফেরা করেন দামি গাড়িতে। টেকনাফ বাজারে বড় বড় কয়েকটি পাইকারি দোকানের মালিকও তিনি। আমির আহমদের বিরুদ্ধেও একাধিক ইয়াবা পাচারের মামলা রয়েছে। কিন্তু সেও অধরা। অমির আহমদ বলেন, তার লবণ চাষের ব্যবসা আছে। তিনি কোটিপতি নন। তার বিরুদ্ধে কোন মামলাও নেই। 
ইয়াবা পাচার মামলার অন্যতম পলাতক আসামি আবদুল গনি। বছর দুয়েক আগেও তারা বাঁশ ও বেতের ব্যবসা করতেন। কিন্তু এখন দৃশ্যপট বদলে গেছে। সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামে একাধিক ফ্ল্যাট ও প্ল¬ট কিনেছেন তিনি। চড়েন দামি গাড়িতে। এলাকায় প্রচুর জমিও হয়েছে। বিজিবির উদ্ধার করা ইয়াবা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি হলেও তিনি প্রকাশ্যেই ঘোরাফেরা করছেন। আর পুলিশের খাতায় তিনি পলাতক। অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্যের জন্য নূরুল হকের ছেলে গনির মোবাইল ফোনে বারবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। 
মোহাম্মদ আলী : এ গ্রামের আরেক কোটিপতির নাম মোহাম্মদ আলী। তার পিতা হাজী কালা মিয়া। তার বিত্তবৈভব নিয়ে এলাকায় নানা কথা প্রচলিত আছে। কেউ বলেন, মোহাম্মদ আলী টাকার বালিশে ঘুমায়। কেউ বলে মোহাম্মদ আলীর বাড়িতে টাকার বস্তা আছে। তবে মোহাম্মদ আলী জানান, তিনি মোটেও কোটিপতি নন। কৃষিকাজ করে তার সংসার চলে। বৃহ¯পতিবারও নাফ নদী থেকে সাড়ে ৫ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করেছে বিজিবি। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে এ ইয়াবা চালানের মালিক মোহাম্মদ আলী। পরে মোহাম্মদ আলীকে আসামি করে মামলা করা হয়। মোহাম্মদ আলী বলেন, উদ্দেশ্যমূলকভাবে তার বিরুদ্ধে এ মামলা করা হয়েছে। 
ফরিদুল আলম ঃ সম্প্রতি মৌলভীপাড়ায় কোটি টাকা দামের জমি কেনা নিয়ে আলোচনা চলছে। যিনি জমি কিনেছেন তার নাম ফরিদুল আলম। তার পিতার নাম মৃত আমীর হোসেন। স্থানীয় বাসিন্দা জানায়, একসময় ফরিদুলের পরিবার লবণ চাষ করে সংসার চালাত। কিন্তু রহস্যজনক আয়ের বদৌলতে ফরিদুল বর্তমানে কোটি টাকার স¤পদের মালিক বনেছেন। ফরিদুলের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় একাধিক ইয়াবা পাচার মামলা রয়েছে। সম্প্রতি বিজিবি ও পুলিশের দায়ের করা ইয়াবা পাচার মামলায় আবুলকে আসামি করা হয়েছে। অবশ্য আবুল ও স্থানীয় বিএনপির তরফে বলা হচ্ছে, শাসক দলের ইশারায় হয়রানির উদ্দেশ্যে এসব মামলায় তাকে জড়ানো হয়েছে। এ গ্রামের আরও যারা অল্প সময়ের মধ্যে অবিশ্বাস্যভাবে বিত্তশালী হয়ে উঠেছেন তাদের মধ্যে উলে¬খযোগ্য হলেন লাল মিয়ার ছেলে আবুল কালাম ওরফে কালা। তিনি একসময় পিতার লবণ ব্যবসা দেখাশুনা করতেন। তিনি অল্প সময়ে গাড়ি, বাড়ি ও প্রচুর পরিমাণ জমিজমার মালিক হয়েছেন। 
মৌলভীপাড়ার পাশের গ্রাম নাজিরপাড়া। সরজমিনে ঘুরে এ গ্রামেও বেশ কয়েকজন কোটিপতির নাম জানা গেছে। অথচ এরা অল্প কিছুদিন আগেও ছিলেন সহায়-সম্বলহীন। নাজিরপাড়ার কোটিপতি হিসেবে যাদের নাম জানা গেছে তারা হলেন-
জিয়াউর রহমান : ৭ বছর আগেও বেকার যুবক ছিলেন জিয়াউর রহমান। তার পিতার নাম মোঃ ইসলাম। কিন্তু এখন তার দুর্দিন নেই। তিনি চলাফেরার জন্য এখন একাধিক নোয়া মাইক্রোবাস ব্যবহার করেন। গ্রামেই আলিশান বাড়ি বানিয়েছেন। তার মালিকানায় রয়েছে কয়েক ডজন সিএনজি অটোরিকশা। তার বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অনেক পুরনো। পুলিশের খাতায় তিনি ইয়াবা পাচার মামলার আসামি। তার নিজস্ব সিএনজি অটোরিকশা ও নোয়া মাইক্রোবাসগুলো ইয়াবা পরিবহনের কাজে ব্যবহার হয় এমন তথ্য দিয়েছে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র। 
জানা গেছে, নোয়া মাইক্রোবাসগুলোতে একাধিক নাম্বারপ্লে¬ট ব্যবহƒত হয়। সুবিধামতো নম্বরপ্লে¬ট বদল করে ইয়াবা পরিবহন করা হয়। 
ছাগল হাসু : এক সময় ছাগলের ব্যবসা করতেন হাসু। এজন্য এলাকায় তিনি ছাগল হাসু নামে পরিচিতি। তবে ছাগল হাসু এখন এলাকার অন্যতম কোটিপতি। থানা সূত্র জানিয়েছে, তার বিরুদ্ধে ইয়াবা চোরাচালানের একাধিক মামলা রয়েছে। তবে শুধু ইয়াবা ব্যবসা নয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি নাজিরপাড়া ও মৌলভীপাড়ার কয়েকটি চোরাচালান ঘাটও নিয়ন্ত্রণ করেন। মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালানের পাশাপাশি তিনি অবৈধ মদ-বিয়ার বাংলাদেশে আনেন। আবার বাংলাদেশ থেকে ফেনসিডিল-গাঁজা ও সুখিবড়ি (সরকারি জš§বিরতিকরণ পিল) মিয়ানমারে পাচার করেন। ছাগল হাসু বলেন, তিনি মোটেও ইয়াবা ব্যবসায়ী নন। তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।
চাঁন মিয়া ওরফে পোয়া চাঁন মিয়া : নাজিরপাড়া এলাকায় আগে চাঁন মিয়া নামের একজন বয়স্ক চোরাকারবারী থাকত। চেনার সুবিধার জন্য এলাকাবাসী তার নাম দেয় পোয়া চাঁন মিয়া। স্থানীয় ভাষায় ‘পোয়া’ অর্থ ছোট। এই পোয়া চাঁন মিয়ার কত টাকা আছে তা নিয়ে এলাকাবাসীর কৌতূহলের শেষ নেই। টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপ সড়কের পাশে তার বিলাসবহুল বাড়ির নির্মাণকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। অথচ পোয়া চাঁন মিয়ার বৈধ কোন আয়ের উৎস নেই। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ নাজিরপাড়া সীমান্ত দিয়ে ‘সুখী বড়ি’সহ বিভিন্ন ধরনের দেশীয় মূল্যবান ওষুধ পাচার করেন তিনি। তার বিরুদ্ধে ইয়াবা চোরাচালানের অভিযোগে একাধিক মামলা থাকলেও তাকে পুলিশ ¯পর্শ করে না। চলবে...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন