ইতিকাফ: মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের সোপান

হাফেজ মাওলানা রিদওয়ানুল কাদির উখিয়াভী: 
ইতিকাফের গুরুত্ব:  মাহে রমজান  আত্মশুদ্ধি, মানসিক উৎকর্ষ সাধন ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাস। এ মাসেই মুমিন ব্যক্তি আধ্যাত্মিক সাধনায় চরম উৎকর্ষ লাভ করেন। এ মাসেই রয়েছে এমন একটি রাত, যা হাজার মাস থেকে উত্তম। সেই রাতের পূর্ণ সওয়াব অর্জন করার জন্য ইতিকাফের গুরুত্ত্ব ও উপকারিতা অপরিসীম। 

ইতিকাফ কী?  ইতিকাফ আরবী শব্দ। এর অর্থ, অবস্থান করা, বসা, ইবাদত করা ইত্যাদি। ইবাদতের নিয়তে মসজিদ বা নির্জন স্থানে বসা বা অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে। ইসলামী শরীয়াতের পরিভাষায়, আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে, আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে, আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের জন্য মাহে রমজানে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ( ২০ রমজান সূর্যাস্তের আগেই ইতিকাফ শুরু করতে হবে এবং শাওয়াল মাসের চাঁদ উঠার পর ইতিকাফ শেষ করবে) পুরুষরা মসজিদে, মহিলারা নিজ গৃহের অভ্যন্তরে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে। যিনি ইতিকাফ করেন তাকে মু’তাকিফ বলে। ইতিকাফ যে কোন দিন করা যায়। তবে রমজানের শেষ দশ দিন ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। ইতিকাফের মাধ্যমে রোজাদার ব্যক্তি আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ পেয়ে থাকেন। এজন্যেই মদিনায় অবস্থানকালীন সময়ে রাসুলুল্লাহ সা. কখনো ইতিকাফ ছাড়েননি। দাওয়াত, তালীম, তারবীয়াত, শিক্ষা এবং জিহাদে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও রমজানে প্রতিবছর তিনি ইতিকাফ করতেন। ইতিকাফ ঈমানী ট্রেনিং এর একটি ইনস্টিটিউশন এবং রাসূলুল্লাহ সা. এর হেদায়েতি আলোর একটি প্রতীক। ম’ুতাকিফ ঐকান্তিকভাবে মশগুল হয়ে পড়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের নিরন্তর সাধনায়। ইতিকাফ ঈমান বৃদ্ধির একটি মুখ্য সুযোগ। 
ইতিকাফের উদ্দেশ্য: দুনিয়ার সব সম্পর্ক ছিন্ন করে আত্মশুদ্ধি, নামাজ, তারাবীহ, কুরআন তেলাওয়াত, জিকির-আজকার, দোআ-দরুদের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে আল্লাহ  তাআলার নৈকট্য লাভ করার জন্য সুসম্পর্ক স্থাপন করা, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করা, আল্লাহর দিকে আকৃষ্ট হওয়া, আল্লাহ কেন্দ্রীক ব্যতিব্যস্ততা, অন্তর সংশোধন, ঈমানী দৃঢ়তা অর্জন। পাশবিক প্রবণতা এবং অহেতুক কাজ থেকে দূরে থাকা, মসজিদে অবস্থানের অভ্যাস গড়ে তোলা, দুিনয়া ত্যাগ ও বিলাসিতা থেকে দূরে থাকা। লায়লাতুল কদরের পূর্ণ ফজীলত পাওয়ার উদ্দেশ্যে মূলত মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করা হয়। এ উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে রাসুল সা. মাহে রমজানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করেছেন। লায়লাতুল কদর কোন রাতে, তা নির্দিষ্ট নয়। বিশেষ করে রমজানের শেষ দশকের যে কোন বেজোড় রাতেই হতে পারে। ইতিকাফকারীরা ইবাদাতে বিশেষ মনোযোগী হন। ফলে ইতিকাফকারী তার পূর্ণ ফজীলত পেয়ে যাবেন। 
ইতিকাফের প্রকারভেদ:  ইতিকাফ তিন প্রকার। যথা-১. ওয়াজিব ইতিকাফ, ২. সুন্নাতে মুয়াক্কাদা কেফায়া ইতিকাফ, ৩. নফল ইতিকাফ। 
১. ওয়াজিব ইতিকাফ, কোনো কারণবশত যদি কেউ ইতিকাফের নিয়ত বা মানত করে, তা আদায় করা ওয়াজিব। রোজাসহ এইরূপ ইতিকাফ পালন করা আবশ্যক। 
২. সুন্নাতে মুয়াক্কাদা ইতিকাফ, যা মাহে রমজানের শেষ দশ দিন করা হয়। মসজিদ এলাকার কিছুসংখ্যক লোক ইতিকাফ করলে সবার পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু কেউ যদি আদায় না করে তবে সবাই গুনাহগার হবে। 
৩. নফল ইতিকাফ, নফল ইতিকাফের জন্য কোনো মাস বা  নির্ধারিত সময়ের প্রয়োজন হয়না । যে কোন মাসে, যে কোনো সময় নফল ইতিকাফ করা যায়। 
ইতিকাফের ফজিলত: ইতিকাফের ফজিলত সংক্রান্ত অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। 
হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. আমৃত্যু রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করেছেন। এরপর তাঁর স্ত্রীগণ ইতিকাফ করেছেন। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
হযরত আনাছ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. প্রতি রমজানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করতেন। এক বছর কোনো বিশেষ কারণবশত ইতিকাফ করতে পারেননি তাই পরবর্তীৃ বছরে শেষ ও মধ্যবর্তী দশকসহ মোট বিশদিন ইতিকাফ আদায় করে নিয়েছেন । (তিরমিযী শরীফ) 
হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন রমজানের শেষ দশ রাত আসত, তখন নবী করীম সা. কোমরে কাপড় বেঁধে নামতেন (বেশী বেশী ইবাদতের প্রস্তুতি নিতেন ) এবং রাত জেগে থাকতেন ও পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন। (সহীহ বুখারী শরীফ)
অপর একটি হাদিসে বর্ণিত আছে,  রাসূল সা. বলেন, যে ব্যক্তি রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করবে, তার আমলনামায় দুটি হজ্জ ও দুটি ওমরার সওয়াব লিখে দেয়া হবে। (বায়হাকি শরীফ)
অন্য একটি হাদিসে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি সারাজীবনে একদিনের জন্য হলেও ইতিকাফ করবে, কিয়ামতের দিন তার নিকট থেকে দোযখ ১৫ শ বছরের পথ দূরে থাকবে। একদিনের ইতিকাফের ফজীলত যদি এমন হয়, তবে দশ দিন, বিশ দিন, ত্রিশ দিন ও চল্লিশ দিনের ফজীলত কতুটুক হতে পারে তা একমাত্র আল্লাহ তাআলা ব্যতীত অন্যকেউ অবগত নন। (আল-হাদিস)
রাসূল সা. বলেন, ) ইতেকাফকারী সবগোনাহ থেকে বেঁচে থাকে। মসজিদের বাইরে যত মানুষ যত ইবাদত ও নেক আমল করে থাকে, ইতিকাফকারীর আমলনামায় আল্লাহ তাআলা দয়া করে ওইসব নেক আমলের সওয়াব লিখে দেন। 
ইতিকাফের শর্তাবলী: ইতিকাফের নিয়্যত করতে হবে। কেননা, মসজিদে অবস্থান হয়তোবা ইতিকাফের নিয়্যতে হবে অথবা অন্য কোন নিয়তে । আর এ’দুয়ের মাঝে পার্থক্য করার জন্য নিয়্যতের প্রয়োজন। রাসূল সা: বলেছেন, ইতিকাফ মসজিদে হতে হবে। এ ব্যাপারে সকল আলেম একমত । তবে জামে মসজিদ হলে উত্তম। কেননা, এমতাবস্থায় জুমার নামাজের জন্য মুতাকীফকে মসজিদ থেকে বের হতে হবে না।  ইতিকাফ অবস্থায় মসজিদের এক কোণে স্থান নিধারণ করে পর্দা করে একটি কামরা তৈরী করে নিতে হয়, যা জামাতের সময় সরানো সম্ভব হয়। এখানেই তার পানাহার, শয়নসহ যাবতীর কর্ম সম্পাদন করতে হবে। প্রস্্রাব-পায়খানা এবং গোসলেন প্রয়োজন ব্যতীত বাইরে যাওয়া নিষেধ। আর বিশেষ করে ওই কাজগুলো মসজিদ এলাকার মধ্যেই হতে হবে। মহিলাদরে গৃহের অভ্যন্তরে ইতিকাফ করা নফল।  
মসজিদ থেকে বের হওয়ার বিধান: মু’তাকিফ যদি বিনা প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হয় তাহলে তার ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে। আর যদি প্রাকৃতিক প্রয়োজন মিটানোর জন্য বের হয়, তাহলে ভাঙ্গবে না। বাহক না থাকার কারণে ইতিকাফকারীকে যদি পানাহারের প্রয়োজনে বাইরে যেতে হয় অথবা মসজিদে খাবার গ্রহণ করতে লজ্জাবোধ হয়, তবে এরূপ প্রয়োজনেও বাইরে যাওয়ার অনুমতি আছে। যে মসজিদে ইতিকাফ বসেছে, সেখানে জুমার নামাজের ব্যবস্থা না থাকলে জুমার নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়া ওয়াজিব। কোন নেকীর কাজ করার জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়া বৈধ নয়। যেমন, রোগী দেখতে যাওয়া, জানাযায় উপস্থিত হওয়া ইত্যাদি।
ইতিকাফকারীর জন্য যা কিছু বিধিবদ্ধ: ইবাদত, নামাজ, কুরআন তেলাওয়াত, দোআ, জিকির-আজকার ইত্যাদি। ইতিকাফকারী তার প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র সঙ্গে নেবেন, যাতে নিজের কাজে তাকে বারবার বাইরে যেতে না হয়। যেমন, এলার্ম ঘড়ি, বালিশ, চাদর, বিছানোর কম্বল, তেল, সাবান, শ্যাম্পু, লোশন, মিসওয়াক, ওষুধ-পত্র, দশদিন ব্যবহারের কাপড়-চোপড়, পড়াশোনার জন্য কুরআনের অর্থসহ তাফসীর, ফাজায়েলে আমাল, হেকায়াতে সাহাবাসহ অন্যান্য ইসলামী বইপত্র।
ইতিকাফকারী যা থেকে বিরত থাকবেন; ওজরছাড়া ইতিকাফকারী এমন কোন কাজ করবেনা, যা ইতিকাফের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে। যথা, বেশী কথা বলা, বেশী মেলামেশা করা, অধিক ঘুমানো, ইবাদতের সময়কে কাজে না লাগানো, টেলিফোনে গল্পগুজব করা, বিনা কারণে ইন্টারনেট ব্রাউজ করা, চ্যাটিং করা, মসজিদে অবস্থানরত অন্যান্যদের সাথে হাসি-ঠাট্টা করা, ঝগড়া করা,অন্যের পরনিন্দা করা ইত্যাদি। 
উপসংহার: ইতিকাফ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ও ফজীলতময় ইবাদত, যার মাধ্যমে আল্লাহ সঙ্গে বান্দার গভীর সুসম্পর্ক গড়ে তোলা যায়। যার ফলে সারা বিশ্বের পীর, অলী-আওলিয়া, গাউছ-কুতুবগণসহ তাদের মুরীদ ও উলামায়ে কেরাম মাহে রমজানের শেষ দশককে নিজের জন্য ঠিকানা বা স্থান নির্ধারণ করে নেয়, আল্লাহর পবিত্র ঘর মসজিদকে। তারা দুনিয়ার সব সম্পর্ক ছিন্ন করে আল্লাহর ধ্যানে গভীরভাবে আত্মনিয়োগ করে। আসুন আমরাও ইতিকাফের মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের সাধনায় আত্মনিয়োগ করি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন