ডেস্ক রিপোর্ট
কক্সবাজারের জেলেদের আগের সেই জৌলস নেই। সাগরে মাছের আকাল, অব্যাহত জলদস্যুতা, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণহানি, ট্রলারের তেল, বরফ সহ নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি সহ নানা কারণে মৎস্য শিল্পের জন্য চারণভূমি কক্সবাজার আগের সেই জৌলস নেই।
অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে জেলেদের আইডি কার্ড দেওয়াসহ আলাদা ভাতা ও সুযোগ সুবিধা প্রদানের বিষয়টিও ঝুলে আছে।
কক্সবাজার শহরের মাঝির ঘাট এলাকার মাছ ব্যবসায়ী ও ট্রলার মালিক জয়নাল আবেদীন ও মমতাজ আহামদ বলেন প্রায় ৩০ বছর সাগরের উপর নির্ভর করে ব্যবসা করছি। অর্থাৎ মাছের সাথে কেটেছে সারাজীবন আমাদের বাপ চাচারাও এই ব্যবসা করে জীবন চালিয়েছেন। তবে এখন আর আগের সেই জৌলস নেই। আগে একটি ট্রলার সাগরে মাছ ধরতে পাঠালে ১০ দিনের জন্য সব মিলিয়ে খরচ হতো ২৫/৩০ হাজার টাকা। আর এমন কোন টিপ ছিলনা যে কমপক্ষে দেড় থেকে ২ লাখ টাকার মাছ এনেছে। প্রতিবারই আত্মীয়স্বজনকে দিয়ে খরচ বাদ দিয়ে ৫০ হাজার টাকা লাভ হতো। আর বর্তমানে একটি ট্রলার সাগরে পাঠাতে ১ লাখ টাকার বাজার লাগে। আর ১০ বার পাঠালে বেশি হলে ১ বা ২ বার লাভের মুখ দেখা যায়। মূলত এখন সাগরে মাছ নেই। পোনা ধরার নামে সাগরে মাছের বংশ ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। ব্যবসায়ী ছৈয়দ আলম বলেন সবচেয়ে বড় কথা এখন সাগরে কোন শ্রমিক যেতে চায় না। ডাকাতদের ভয়ে গত কয়েক বছর ধরে যে হারে সাগরে ডাকাতি বেড়েছে তা উদ্বেগজনক। এ জন্য মাছের ব্যবসায় বড় ধরনের ধ্বস নেমেছে। আর বরফের দাম তেলের দাম সহ নিত্যপণ্যের দাম যে হারে বেড়েছে তাতে ট্রলারের ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। মোটকথা আগে মাছের ব্যবসার যে একটা জৌলস ছিল বর্তমানে তার কিছুই নেই। আলাপকালে সমিতি পাড়া এলাকার জেলে হামিদ উল্লাহ, আবদুল করিম বলেন মাছের সাথে খেলা করতে খুব ভাল লাগে। কিন্তু প্রাণের ভয়ে সাগরে যেতে ইচ্ছে করেনা। প্রতি মুহূর্তে টেনশনে থাকি কখন ডাকাত আক্রমণ করছে। কখন গুলি করে বসে। এত রিক্সা নিয়ে কে সাগরে যাবে। তার চেয়ে কূলে রিক্সা চালালেও অনেক ভাল। তার উপর ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসে তখন আরো প্রাণহানি হয় মানুষ মারা যায় সেসব দেখে কারো কি ইচ্ছা করে যে সাগরে গিয়ে মাছ ধরতে।
তারা আরো বলেন সরকারের কাছে প্রায় আমরা আবেদন করি সাগরে ডাকাত প্রতিরোধ করার জন্য। শুধু বক্তব্য দিয়ে শেষ। আমাদের কথা কেউ চিন্তা করে না। এখনো সাগরে সুযোগ বুঝে প্রায় ডাকাতি হয়। তার উপর জেলেদের আইডি কার্ড দেওয়ার কথাটি শুধু শুনে আসছি এ পর্যন্ত বাস্তবায়ন দেখিনি। তার উপর যখন আমরা ঘরে বসে থাকি তখন কোন আলাদা সুযোগ সুবিধা পাই না। তাই জেলে পেশা ছেড়ে দিয়ে এখনই ব্যবসা পরিবর্তন করে অন্যকিছু করছে। কক্সবাজার সদর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মঈন উদ্দিন বলেন বর্তমান সরকার মৎস্য শিল্পের সামগ্রিক উন্নয়নে খুবই আন্তরিক। কক্সবাজারেও এর আওতায় বহুমুখী উন্নয়ন কাজ চলছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফেরদৌস আহামদ বলেন জেলেদের আইডি কার্ড দেওয়ার বিষয়ে কাজ চলছে ইতোমধ্যে কুতুবদিয়া ও পেকুয়ায় গণনার কাজ শেষ হয়েছে। আর সাগরে জলদস্যুতা রোধে সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে। মূলত জনসংখ্যা বাড়ায় কিছুটা সমস্যা দেখা দিলেও জনগণ সচেতন হলে যে কোন জলাশয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু করলে আগের সেই জৌলস ফিরে আসবে বলে আশা করেন তিনি।
মিঠা পানিতে মৎস্য উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে ঃ
জেলায় মিঠা পানিতে মৎস্য উৎপাদন কমে আসতে শুরু করেছে। নির্ভর হয়ে পড়েছে সামুদ্রিক মৎস্যের উপর। যার ফলে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় জেলাব্যাপী মাছের তীব্র সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। এ জন্য আভ্যন্তরীণ মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে জেলা মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক কোন প্রচারণা না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানালেন জেলার মৎস্য উৎপাদনকারীরা।
মৎস্য অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে ২০১২ সালের হিসাব অনুযায়ী জেলায় মৎস্য উৎপাদনে সক্ষম পুকুর ও দিঘী রয়েছে ১৩ হাজার ৯৩০টি, বাণিজ্যিক মৎস্য খামার রয়েছে ৩৭৮টি, বাগদা চিংড়ি খামার রয়েছে ৪ হাজার ৩৯৮টি, গলদা চিংড়ি ও রুই এর মিশ্রিত চাষের পুকুর রয়েছে ৪০৫টি, খাল ৪৫টি, নদী ৫টি, বাগদা চিংড়ি হ্যাচারী ৫৮টি, কার্প হ্যাচারী ৩টি, মনোসেক্স তেলাপিয়া হ্যাচারী ১২টি, কার্প নার্সারী ৮টি, চিংড়ি ডিপো ৪৫৪টি, বরফকল ৭৯টি, মৎস্য ও চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা ৬টি, শুটকী রপ্তানী প্রক্রিয়াজাতকরণ স্থাপনা ১২টি, মৎস্য খাদ্য কারখানা ১টি, যান্ত্রিক নৌযান ৩ হাজার ৯৯৮টি, মৎস্য চাষী ৩৪ হাজার, তৎমধ্যে মহিলা ৪ হাজার। তবে সমুদ্র থেকে মৎস্য আহরণকারী মৎস্যজীবীর সংখ্যা ১ লাখ ১২ হাজার ৫০০ জন, তৎমধ্যে মহিলা ৪১ হাজার।
নির্ভরযোগ্য সুত্রে জানা যায় মৎস্য অধিদপ্তরে যে হিসাবটি রয়েছে তা অনেক দিন আগের জরিপ। ওই জরিপ দিয়েই তারা কোন প্রকার সংশোধন না করে মনগড়া তথ্য উপস্থাপন করে যাচ্ছেন। কক্সবাজার মৎস্য গবেষণা ইনষ্টিটিউট এর একজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বাস্তব সত্য কথা বলতে কোন বাধা নেই। জেলায় সব সরকারী অফিসের মধ্যে মৎস্য অফিস গুলো কর্মহীন। প্রতিমাসে বেতন উত্তোলন ও কাগজপত্র ঠিক রাখাই তাদের প্রধান কাজ। আভ্যন্তরীণ জলাশয় থেকে প্রতিবছর ৩৪ হাজার ১৫ মেট্রিক টন মৎস্য উৎপাদনের যে চিত্রটি মৎস্য অধিদপ্তর তুলে ধরেন তা স¤পুর্ণ অনুমান নির্ভর। কিভাবে পুকুর ও জলাশয়ে মাছের চাষ করবে তা অনেকেই জানেন না। বিভিন্ন উপজেলায় মৎস্য সমিতি নাম বয়ে বেড়ানো কিছু লোকের সাথে মৎস্য বিভাগের যোগাযোগ থাকলেও প্রকৃত মৎস্য চাষীদের সাথে কোন যোগাযোগই নেই।
রামুতে অবস্থিত একটি মনোসেক্স তেলাপিয়া হ্যাচারীর পরিচালক ওসমান সরওয়ার জানান, দীর্ঘ ১২ বছর যাবত মাছ চাষ করে আসলেও মৎস্য বিভাগের কোন লোক আমাদের কাছে আসেনি। উত্তরবঙ্গ থেকে মৎস্য চাষে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত লোকজন এনে আমাদের কাজ করতে হচ্ছে।
রামুর অপর একটি হ্যাচারীর পরিচালক আবু আহমদ জানান, মৎস্য বিভাগ মাছ চাষিদের প্রচারণার মাধ্যমে উৎসাহিত করলে আভ্যন্তরীণ খাত থেকে আরো বেশী মৎস্য উৎপাদন করা যেত। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সময় সাগরে ট্রলার না গেলে বাজারে সৃষ্টি হওয়া মাছের সংকট আভ্যন্তরীণ মৎস্য দিয়ে মোকাবেলা করা যায় না আমরা ব্যবসায়ীদের চাহিদামত মাছ সরবরাহ করতে পারিনা। জেলাব্যাপী আভ্যন্তরীণ মৎস্য উৎপাদন ব্যাপক ভাবে হ্রাস পেলেও মৎস্য অধিদপ্তর তা কোনদিনই স্বীকার করবে না।
তবে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফেরদৌস আহমদ জানান, প্রচারণা নেই তা সত্য নয়। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী সবকিছু বাস্তবায়িত হচ্ছে। দৈনন্দিনের সৌজন্যে