কক্সবাজার সিভিল সার্জন অফিসে মাসে ৫০ লাখ টাকা ঘুষের লেনদেন

খবর তরঙ্গ ডটকম: ভ্রাম্যমান আদালতের হুমকি ও মানব স্বাস্থ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় জড়িতদের কাছ থেকে মাসোহারা তুলেই মাসে নগদ ৫০ লাখেরও বেশি টাকার উৎকোচ বাণিজ্যে জড়িত রয়েছে কক্সবাজার সিভিল সার্জন অফিস।
সিভিল সার্জন কাজল কান্তি বড়–য়ার নেতৃত্বে এ কারনে উক্ত দপ্তরের সরকারী চিকিৎসক ডাক্তার আব্দুস ছালাম সহ আরো কয়েকজনের সম্পৃক্ততায় শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। শুধু তাই নয়, জেলা সিভিল সার্জনের প্রত্যক্ষ ইন্দনে এই চক্রের অধীনে ৮ উপজেলায় রয়েছে উপজেলা ভিত্তিক আরো বেশকিছু চাঁদা উত্তোলনকারী দালাল চক্র।
যারা প্রতিনিয়তই কক্সবাজার জেলার ৮ উপজেলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় ৫ শতাধিক পল্লী চিকিৎসক, অ-অনুমোদিত ঔষুধের দোকান, ইউনানী, হারবাল, আর্য়ুবেধী, লতা-পাতার ঔষুধ বিক্রেতা এমনকি ঝাঁড়ফোঁক (বৈদ্য) চক্রের কাছ থেকে দৈনিক-মাসিক ও সাপ্তাহিক চুক্তিতে এসব টাকা তুলে ভাগ-বাটোয়ারায় লিপ্ত। বছরের পর বছর ধরে সিভিল সার্জন অফিস নিজেদের সরকারী দায়িত্বের অন্তরালে এই অপকর্মে লিপ্ত থাকলেও বিষয়টি বরাবরই অদৃশ্য থেকে যাচ্ছে।
তাই এ ব্যাপারে প্রতিবেদকের পক্ষ থেকে গত একমাস ধরে জেলার ৮ উপজেলা ও বিভিন্ন স্থান সরেজমিন পরিদর্শন এবং ভূক্তভোগীদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে জানা গেছে উল্লেখিত তথ্য।
তথ্যদাতারা জানান, সিভিল সার্জন অফিসের উক্ত দুষ্ট চক্র শুধু চাঁদাবাজিতে জড়িত নয়, তাদের ঘুষ খাওয়ার প্রবণতা আরো বিভিন্ন ভাবে বিস্তৃত। পিলে চমকানো তথ্য হচ্ছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ উক্ত সিভিল সার্জন অফিসের দুর্নীতিবাজরা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বরত নিজেদের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, জেলা প্রশাসনের অধিনস্থ ভ্রাম্যমান আদালতের ম্যাজিষ্ট্রেট ও পুলিশ বাহিনীর নাম ভাঙ্গিয়েও মাসের শেষে ঘুষের টাকা বেশি পেতে জেলা শহর সহ বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক, প্যাথলজি ও ভূঁইফোড় ঔষুধ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও গাণিতিক হারে চাঁদাবাজিতে লিপ্ত রয়েছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, অনৈতিক এই কাজে পারদর্শী কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার হলদিয়া পালং ইউনিয়নের বত্তাতলী এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা রশিদ আহমদের ছেলে বর্তমানে সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার ডাঃ আব্দুস ছালামকে ঘুষ সিন্ডিকেটের প্রধান করা হয়। ফলে ডাঃ আব্দুস ছালাম কক্সবাজারে যোগদানের পর থেকেই খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে স্বনামে-বেনামে জেলার বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ধন সম্পত্তির মালিক বনে গেছেন। শুধু তাই নয়, সরকারী চাকুরীরত উক্ত মেডিকেল অফিসারের বিরুদ্ধে পাহাড় দখল, কাটা, পরের জমি জবর দখল সহ কক্সবাজারের বিভিন্ন থানা এবং আদালতে ডজন খানেক মামলা থাকলেও বিসিএস স্বাস্থ্য (সরকারী কর্মকর্তা) হওয়ায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আদৌ তার বিরুদ্ধে কার্যকর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
অভিযোগ উঠেছে, আব্দুস ছালাম কিছুদিন আগে কারা হাসপাতালের সহকারী সার্জনের অতিরিক্ত দায়িত্বে ছিলেন। সেখানে টাকার বিনিময়ে সুস্থ ব্যক্তিকে অসুস্থ দেখানোর পাশাপাশি প্রকৃত অসুস্থদের সুস্থ দেখিয়ে অমানবিক ঘুষ কেলেংকারীতে জড়িত থাকায় সাম্প্রতিক সময়ে তাকে সেখানকার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে অন্য একজন চিকিৎসক নিয়োগ করা হয়। এ অবস্থায় উক্ত দুর্নীতিবাজ আব্দুস ছালাম বর্তমানে জেলা পুলিশ হাসপাতালের ভিজিটিং মেডিকেল অফিসারের দায়িত্বে থাকায় জেলা পুলিশের চক্ষু লজ্জার সুযোগটি কাজে লাগিয়ে হরদম বে-আইনী কর্মকান্ডে লিপ্ত রয়েছে।
ওয়াকিবহাল সূত্র জানায়, তিনি (ডাঃ আব্দুস ছালাম) পুলিশ হাসপাতালের ডাক্তার হওয়ায় তার অপকর্মের বিরুদ্ধে থানায় গিয়েও আইনগত প্রতিকার পাওয়াতো যায়না, বরং তিনি নিজেই প্রতিবাদকারীদের বিভিন্ন মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে দেন। এছাড়া সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার ডাঃ আব্দুস ছালাম ও সিভিল সার্জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, চুক্তি মতো তাদেরকে কেউ টাকা না দিলে, আকষ্মিকভাবে চক্রটি জেলা প্রশাসনের কর্মরত ম্যাজিষ্ট্রেটদের ভুল বুঝিয়ে সহযোগিতা আদায় করে ভ্রাম্যমান আদালত করে যখন যাকে ইচ্ছা তার প্রতিষ্ঠানে হানা দেয় এবং প্রতিশোধ হিসেবে আর্থিক জরিমানা কিংবা জেল জুলুমের মতো ঘটনার সৃষ্টি করে। শুধু তাই নয়, উক্ত দুষ্ট চক্রের কারনে বর্তমানে কক্সবাজার জেলা শহর সহ বিভিন্ন স্থানে কথিত ডাক্তার, কবিরাজ, বৈদ্য ও লতা-পাতা চিকিৎসকদের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় পুরো জেলার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা খুব নাজুক হয়ে পড়েছে। এ কারণে গ্রামে মা ও শিশু মৃত্যুর হার বৃদ্ধির পাশাপাশি অপচিকিৎসার ছোবলে পড়ে সাধারণ লোকজন প্রতিনিয়তই ফতুর হয়ে পড়ছেন।
সূত্র মতে, সিভিল সার্জন অফিসের এই দুষ্ট চক্রকে তুষ্ঠ করে বর্তমানে কক্সবাজার জেলার ৮ উপজেলায় প্রায় ৫শ’ এর বেশি হাতুড়ে ডাক্তার নিয়মিত রোগি দেখছেন। তারা প্রতিদিনই চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্রের পাশাপাশি ঔষুধের নামে সাধারণ রোগীদের অখাদ্য-কুখাদ্য লিখে একদিকে মানব স্বাস্থ্যের যেমন ক্ষতি করছেন, অন্যদিকে নিজেরা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সূত্রটি আরো জানায়, সিভিল সার্জন অফিসের এই দুষ্ট চক্রকে মাসিক নগদ টাকা দিয়ে ডাক্তার না হয়েও চটকদারী ভিজিটিং কার্ড ও সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে জেলায় গাইনী বিশেষজ্ঞ ভূঁয়া মেডিকেল অফিসার এমনকি ভুঁয়া এমবিবিএস ডাক্তারের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। এ রকম একজন গাইনী চিকিৎসকের সন্ধান পাওয়া গেছে, যিনি বহুল আলোচিত, সমালোচিত চকরিয়ার কথিত ডাক্তার ইসরাত জাহান শিল্পী। অভিযোগ উঠেছে, উক্ত ডাক্তার শিল্পী সহ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের অসংখ্য হাতুড়ে ডাক্তারের বিরুদ্ধে কক্সবাজার সিভিল সার্জন অফিসে ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে কেউ লিখিত অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার পাননা, বরং জানা গেছে, চক্রটি এ রকম অভিযোগ পেলে অভিযুক্ত উক্ত ডাক্তারকে নোটিশ দিয়ে কক্সবাজার সিভিল সার্জন অফিসে এনে দফারফা করে ছেড়ে দেন। আর যারা সিভিল সার্জন অফিসের ডাকে সাড়া না দেন কেবল তাদের বিরুদ্ধেই প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে উক্ত দপ্তর আইনের প্রয়োগ করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বর্তমানে জেলা শহর কক্সবাজারের প্রাণ কেন্দ্রে অগণিত হারবাল, ইউনানী ও লতা-পাতা বিক্রেতা দিন-রাত বৈধ কোন কাগজপত্র ছাড়াই ব্যবসা চালিয়ে আসলেও নাকের ডগায় থাকা সিভিল সার্জন অফিসের ভ্রাম্যমান আদালতের টিম তাদেরকে দেখেও না দেখার ভান করে চলছে। অপরদিকে তাদের চুক্তির বাইরে যারা রয়েছে সিভিল সার্জন ডাঃ কাজল কান্তির নির্দেশে মেডিকেল অফিসার আব্দুস ছালাম তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দীর্ঘ তালিকা করে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনার জন্য জেলা প্রশাসক বরাবরে আবেদন করেন। রাষ্ট্রীয় স্বার্থে জেলা প্রশাসক মহোদয় সরল বিশ্বাসে যখনই সিভিল সার্জন অফিসের উক্ত ঘুষখোর চক্রকে ম্যাজিষ্ট্রেট দিয়ে সহায়তা করেন তখন ডাঃ আব্দুস ছালামরা ফুটপাতে লোক দেখানো অভিযান চালিয়ে রাস্তার পাগল ধরে সাজা দিয়েছেন, এ রকম অনেক নজির সৃষ্টি করলেও একজন সত্যিকার অপচিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন না।
সূত্র জানায়, বর্তমানে সদর উপজেলা বাজারে এস.এ মেডিকোতে ডাঃ গিয়াস উদ্দিন, পাওয়ার হাউজ তাশফী মেডিকোতে ডাঃ এম.এস কুতুবী, উপজেলা বাজারে ডাঃ এস.কে মল্লিক, চকরিয়া হারবাং এলাকায় ডাঃ ইসরাত জাহান শিল্পী, বাস টার্মিনাল আরোগ্য নিকেতনে ডাঃ সুমন বড়–য়া, এস.আর.বি মেডিকোতে ডাঃ দিপংকর বড়–য়া, সমিতি পাড়া রানা ফার্মেসীতে ডাঃ প্রদীপ পাল, শ্রাবন্তী ফার্মেসীতে ডাঃ তাপস পাল, মা-মনি ফার্মেসীতে ডাঃ রাজিব পাল, সুবর্ণা ফার্মেসী ডাঃ তুষার পাল, খুরুস্কুল গ্রামীণ ফার্মেসীতে ডাঃ মোর্শেদ আলম, রামু কলঘর বাজাড়ে ডাঃ সাধন কৃষ্ণ সুশীল, লিংকরোড শিল্পী মেডিকোতে ডাঃ হিরণ শর্মা, বাংলাবাজার ফারুক মেডিকোতে ডাঃ আহমুদুর রহমান, বাংলাবাজারে ডাঃ সুব্রত কুমার বিশ্বাস, চেরাংঘাটা বাজারে ডাঃ শহীদুল্লাহ হক, আলিরজাঁহাল সিকদার মেডিকোতে ডাঃ শাফায়েত উল্লাহ, আলিরজাঁহালে ডাঃ পীযুষ, পিএমখালী আল মদিনা মেডিকোতে ডাঃ হারুন রশিদ, শহরের বিমানবন্দর রোডে মোজাম্মেল মেমোরিয়াল স্কুলের পাশে ডাঃ সাবেরা বেগম, গাড়িরমাঠের ডাঃ ডেইজি সোলতানা, আল ফুয়াদের সামনে ডাঃ বেবী, টেকনাফ ড্রাগ হাউজে ডাঃ শংকর রায়, ডাঃ অভিজিত রায়, ডাঃ কৃষ্ণপদ দাশ, ডাঃ অপুশীল, ডাঃ কে.বি দাশ, মহেশখালীতে ডাঃ মহিউদ্দিন সেলিম, ডাঃ সিরাজুল হক ও ডাঃ মোস্তাক সহ জেলার ৮ উপজেলার আনাচে-কানাচে আরো শত শত ডাক্তার পরিচয়ী হাতুড়ে ডাক্তার রয়েছে, যারা প্রতিনিয়ত সিভিল সার্জন অফিসের সংশ্লিষ্ট ঘুষ সিন্ডিকেটকে মাসিক নগদ টাকা দিয়ে মানব স্বাস্থ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় লিপ্ত রয়েছে। কাজে এই ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসক ও গোয়েন্দা সংস্থাসহ সংশ্লিষ্টদের আন্তরিক ভূমিকা প্রত্যাশা করে ভূক্তভোগীরা জানান, এসব অপচিকিৎসকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়কারীসহ জড়িত সকলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত কক্সবাজারের সিভিল সার্জন কাজল কান্তি বড়–য়ার সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমাদের ম্যাজিষ্ট্রেসি পাউয়ার নেই। তবুও আপনারা তো দেখছেন আমরা ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে ইতিপূর্বে কয়েকজনকে জেলেও পাঠিয়েছি। ডাঃ আব্দুস ছালামও অনুরূপ ভাবে নিজের সমস্ত কুর্কীতি অস্বীকার করে এ প্রতিবেদককে জানান, টুকটাক দুর্নীতি সবাইতো করে। আমরা অল্প স্বল্প না করলে বাঁচবো কিভাবে। কিন্তু সিভিল সার্জন ও ডাঃ আব্দুস ছালামের দেয়া এসব বক্তব্য নাকচ করে দিয়ে কক্সবাজারের বেশ কয়েকজন সচেতন জনগণ জানান, ডাঃ আব্দুস ছালাম ও সিভিল সার্জন কাজল কান্তি বড়–য়াকে এখান থেকে সরিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত কক্সবাজারের স্বাস্থ্য বিভাগের অন্তরালে চলমান এই দুর্নীতি বন্ধ হবে না। তাই ভুক্তভোগীরা বিষয়টি নিয়ে দেশের স্বার্থে গোয়েন্দা বিভাগ ও জেলা প্রশাসনের তড়িত হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন