ইমরুল শাহেদ :
১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর দোসর হিসেবে বাংলাদেশে যারা যুদ্ধাপরাধ করেছেন তাদের বিচারের জন্য গঠিত যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল আবার কার্যক্রম শুরু করেছে।
বলতে গেলে পুরনো ক্ষত নতুনভাবে জাগিয়ে তোলা হয়েছে। যদিও বেশি-কম প্রত্যেকেই মনে করেন এই বিচার হওয়া উচিত, কিন্তু বড় দুটি রাজনৈতিক দল তাদের নিজেদের স্বার্থে এই বিচারকে কাজে লাগাতে চায় বলেই যত সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। দি হিন্দু
বাংলাদেশের জনগণ এখন বিবদমান দুই বেগমের কাকে বেছে নেবেন সেই সংকটে আছেন। তারা দুজনেই দলের প্রধান। গত দুই দশক ধরে ঘুরেফিরে তারাই ক্ষমতায় আছেন। সফল সরকার হিসেবে তারা একে অপরের বিকল্প। কিন্তু উভয় দলই দুর্নীতির দায়ে জনগণের কাছে অভিযুক্ত। এ ব্যাপারে জনগণের অবস্থান এতো সুদৃঢ় যে তারা কিছুতেই দুর্নীতির বিষয়ে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি অন্য খাতে প্রবাহিত করতে পারছে না।
আওয়ামী লীগের কারণে স্বাধীনতার পক্ষে ও বিপক্ষে দুটি শক্তি তৈরি হয়েছে। সেই শক্তি এখন আর রাজনৈতিকভাবে হাতের মুঠোয় থাকছে না। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ইসলাম রক্ষার শ্লোগান তুলেছে এবং জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগিয়ে তোলার কাজে নিয়োজিত হয়েছে। এই অর্থে দুটি দলই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে চার বছর অতিবাহিত করেছে। বিশ্ব ব্যাংক-পদ্মা সেতু কেলেংকারি, শেয়ার বাজারের পতন, ব্যাংক ঋণ নিয়ে কেলেংকারি সরকারকে বিব্রত করেছে। এসব কিছুর মাঝখানে গুজব রটেছিল যে সরকার জামায়াতে ইসলামের সঙ্গে একটা গোপন চুক্তিতে যাচ্ছে। এই চুক্তির লক্ষ্য হলো প্রতিদ্বন্দ্বী দল বিএনপিকে দুর্বল করে তোলা। যখন জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন দেয়া হয়, তখন সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়ে ওঠে।
এই ঘটনার প্রতিবাদে শহুরে তরুণরা ঢাকার শাহবাগে সমবেত হয়। তাদের দাবি ছিল যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে ঝুলানো। এই সমবেত তারুণ্যের মধ্যে সরকার-বিরোধী আন্দোলনের সকল উপকরণই বিদ্যমান ছিল। আন্দোলন শুরুর প্রথম দিকে কোনো মন্ত্রী তাদের মধ্যে যেতে চাইলে তার দিকে পানির বোতলও ছুঁড়ে মারা হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ শাহবাগ আন্দোলনকে নিজের রাজনৈতিক স্বার্থে সুকৌশলে আয়ত্তে নিয়ে গেছে। প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবি শ্রেণী শাহবাগ আন্দোলনকে এমন খাতে প্রবাহিত করেছে যাতে সরকার যা চাইছে তা বিঘিœত না হয়। এভাবেই ক্ষমতাসীন দল একটি সম্ভাবনাময় আন্দোলনকে ছিনতাই করে নিয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারা অনুসারে আওয়ামী লীগ যখন শাহবাগ আন্দোলনকে নিজের পক্ষে নিয়ে যায় বিএনপি তখন বিপক্ষে অবস্থান নেয়। দৈনিক আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমান শাহবাগ আন্দোলনকে ইসলাম বিরোধী আখ্যা দিয়ে প্রচার চালাতে থাকে। একজন নাস্তিক ব্লগার নিহত হওয়ার পর এই সুযোগ তৈরি হয়।
এরপর জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাইদীর বিষয়ে অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আরেকবার ফুঁসে উঠে সংশ্লিষ্টরা। সাইদী জামায়াত নেতা হলেও তার ব্যক্তিগত একটা প্রভাব রয়েছে। তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ মাহফিলে অংশগ্রহণ করতেন। তাকে ফাঁসির আদেশ দেয়ায় গোটা দেশ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। তারা সরকারি অফিস পুড়িয়ে দেয়। হত্যা করে পুলিশের লোকদের। পুলিশের গুলিতেও অনেকে নিহত হন। একদিকে মহানবীর অবমাননা, আরেক দিকে দেলোয়ার হোসেন সাইদীর মৃত্যুদণ্ড দেশে একটা অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।
পরে ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিতে শুরু করে। মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার এবং তার পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া, ইসলামপন্থীদের খুশি করার জন্য কয়েকজন ব্লগারকে গ্রেপ্তার এবং সর্বশেষ ঘটনা হলো হেফাজতে ইসলামের নামে নতুন ইসলামী আন্দোলনের উত্থান।
সাধারণভাবে মনে করা হয়, ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের কারণে তৃণমূল পর্যায়ে জামায়াতের হারানো জনপ্রিয়তা তারা ফিরে পাবে না। জামায়ত ইসলামকে টিকে থাকার জন্য সাধারণত বিএনপি বা আওয়ামী লীগের উপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু কওমী মাদ্রাসার ছাত্রদের নিয়ে সৃষ্ট হেফাজতে ইসলামকে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিও বলা যাচ্ছে না। আদর্শগত দিক থেকেও তারা জামায়াতে ইসলাম থেকে ভিন্ন। তারা শাহবাগ আন্দোলন বিরোধী, কিন্তু ইসলামপন্থী। তারা ব্যাপক পরিমাণ সমর্থক পান। তবে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলেছেন, হেফাজত হচ্ছে জামায়াতের একটি পিঠ। মাঝ রাতে শাপলা চত্বরে পুলিশ ও প্যারামিলিটারি হেফাজত কর্মীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুটি টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া হয়। ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে তাদের ট্রান্সমিশন মেশিন। সেই একই রাতে সরকার শাহবাগ চত্বরের আন্দোলনও ভেঙ্গে দেয়।
এসব কারণে একটা গুজব বেশ ডালপালা গজিয়ে উঠে। সেটা হলো দৃশ্যপটে তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব হতে পারে। হতে পারে সেটা সেনা বাহিনী বা সিভিল সোসাইটির একটি গ্র“প যাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিবে ভারত বা পাকিস্তান। তিনি মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রামীন ব্যাংকের ড. মোহাম্মদ ইউনূসও হতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, নির্বাচনের বছরে এসবই হচ্ছে স্রোতের বিপরীত ঘটনা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে টানাপোড়েন চলছে। অথচ ২০১৩ সালের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে।
এই সংকট থেকে কিভাবে রেহাই পাওয়া যাবে তা কেউ বলতে পারছেন না। সাধারণ মানুষ এখন আছেন এক চরম অনিশ্চয়তায়। নিরাপত্তাহীনতা ও অজানা শঙ্কা কিছুতেই যেন তাদের পিছু ছাড়ছে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন