রমজানে পণ্যের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা

ডেস্ক রিপোর্ট : 
রমজানে পণ্যের দাম বাড়ানোর নানা কৌশল নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। কৌশলে ইতিমধ্যে টিসিবির চিনি কেনা ব্যর্থ করে দিয়েছে। ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো হয়েছে আগেই। আর এসব ঘটনা উদঘাটন হয়েছে ট্যারিফ কমিশন ও টিসিবির রিপোর্টে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রজমানের জন্য চিনি কিনতে দুই দফা দরপত্র দিয়েও টিসিবি স্থানীয় মিল মালিকদের কাছ থেকে কোন রকম সাড়া পায়নি। প্রথম দফায় দরপত্রে কেউ অংশ নেননি।

 দ্বিতীয় দফায় অংশ নিয়েছেন মাত্র একজন রিফাইনারি। অথচ দেশে মোট রিফাইনারির সংখ্যা পাঁচটি। অংশ নেয়া রিফাইনারি কর্তৃপক্ষ দর দিয়েছেন বাজার মূল্য থেকে কেজিতে প্রায় ৪ টাকা বেশি। কৌশলে বেশি দাম প্রস্তাব করায় চিনি কিনতে পারেনি টিসিবি। এভাবে স্থানীয় বাজার থেকে টিসিবিকে চিনি কিনতে ব্যর্থ করে দেয়া হয়। এছাড়া রোজার আগেই ভোজ্যতেলের লিটারে ১০ টাকা বেশি আদায় করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সর্বশেষ তৈরি করা দ্রব্যমূল্য মনিটরিং প্রতিবেদনে তেলের দাম বাড়ানোর কথা পরিষ্কার উল্লেখ করা হয়েছে। ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনটি বৃস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, আসন্ন রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ে সরকারের অনেক প্রস্তুতি কৌশলে ব্যর্থ করে দেয়া হচ্ছে। সরকারের প্রস্তুতি মোট চাহিদার মাত্র ৪ শতাংশ। এ চার শতাংশের প্রস্তুতিকে ব্যর্থ করে একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার পরিকল্পনা গ্রহণ করে অসাধু ব্যবসায়ীরা। ফলে টিসিবির চিনি সংগ্রহের উদ্যোগ হয়ে পড়ে ব্যর্থ। তাছাড়া ভোজ্যতেলের মূল্য বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক বাজারে কম থাকলেও দেশের বাজারে রমজানের আগেই দাম বাড়ানোসহ নানা অপচেষ্টা শুরু করেছে সিন্ডিকেট।
এদিকে আসন্ন রমজানে দ্রব্যমূল্য মজুদ, আমদানি, সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ে আগামীকাল রোববার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছে। ওই বৈঠকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে ডাকা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব মাহবুব আহমেদ যুগান্তরকে জানান, রমজানের প্রস্তুতি চলমান প্রক্রিয়া। টিসিবির মাধ্যমে পণ্যের মজুদ পরিস্থিতি ভালো। শিগগিরই আমরা নিজেরা বৈঠক করব। বাংলাদেশ ব্যাংকের এলসি পরিসংখ্যান পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের এলসি স্বাভাবিক রয়েছে। তিনি বলেন, অ্যাকশন প্লান তৈরি করা হয়নি। প্রয়োজন হলে আমরা তদারকি ও ব্যবস্থা নিতে বাজারে অভিযান পরিচালনা করব।
রোজার আগে চিনি ক্রয়ে ব্যর্থ করা হয় টিসিবিকে : রমজানে সাড়ে ১২ হাজার মেট্রিক টন চিনি স্থানীয়ভাবে ক্রয় করতে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) দরপত্র আহবান করে। প্রথম দফায় একজন রিফাইনারি অংশ নেয়নি। দ্বিতীয় দফায় দরপত্র আহবানের পর দেশে ৫ জন রিফাইনারির মধ্যে মাত্র একজন অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু দরপত্র খুলে দেখা হয় প্রতি কেজির চিনির দাম প্রস্তাব করা হয়েছে ৪৪.৯৫ টাকা। অথচ ওই রিফাইনারি নিজের ফ্যাক্টরিতে প্রতি কেজি চিনি ৪১ টাকায় বিক্রি করছেন। টিসিবির এক কর্মকর্তা বলেন, ৪৪.৯৫ টাকা দিয়ে ক্রয় করলে এর সঙ্গে ভ্যাট মিলে প্রায় ৪৭ টাকা হবে। এটি অবাস্তব বিষয়। যে কারণে স্থানীয়ভাবে সাড়ে ১২ হাজার টন চিনি কেনার পরিকল্পনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত টিসিবি চিনি ক্রয় করতে পারেনি। তবে টিসিবি আন্তর্জাতিক বাজারসহ বিভিন্নভাবে ১৭ হাজার মেট্রিক টন চিনি মজুদ করেছে
এ ব্যাপারে টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সারোয়ার জাহান তালুকদার যুগান্তরকে জানান, এক সময় রমজানে সব পণ্য কেনার ক্ষেত্রে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী প্রতিবন্ধবকতা তৈরি করত। এটি এখন নেই বললে চলে। রজমানে চিনিসহ সব ধরনের মজুদ ভালো রয়েছে।
ভোজ্যতেলের লিটারে এখনই ১০ টাকা বেশি আদায় : ট্যারিফ কমিশন মূল্য বিশ্লেষণ করে দেখতে পায় এক লিটার সয়াবিনে পরিবেশকরা মুনাফা করছে ১০ টাকা, খুচরা পর্যায়ে মুনাফা ১০ টাকা করার পরও প্রতি লিটার খোলা সয়াবিনে প্রকৃত মূল্য থেকে আরও ১০ টাকা বেশি মূল্য ধার্য করেছে কোম্পানিগুলো। 
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বোতলজাত সয়াবিনের ক্ষেত্রে আরও বেশি টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। এ জন্য ট্যারিফ কমিশনের পক্ষ থেকে সয়াবিনের মিলগেট ১০৬ টাকা ও পামতেলের দাম ৭৫ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি বেশি দাম আদায়ের জন্য সরকারকে ভোজ্যতেলের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন পণ্যের বাজারের নয়ছয় শনাক্ত : আন্তর্জাতিক বাজারে চিনি, ভোজ্যতেল ও শিশুখাদ্যের দাম নিুমুখী। যার কোন প্রভাব নেই দেশীয় বাজারে। ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, যেহতু বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম নিুমুখী, সে জন্য বাংলাদেশের মিলগেটে দাম বেঁধে দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। চিনির ব্যাপারে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দামও নিুমুখী। এজন্য রমজানকে সামনে রেখে সরকারকে চিনির মজুদ গড়ে তোলার জন্য সুপারিশ করা হয় সংস্থাটির পক্ষ থেকে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশে শিশুখাদ্যের দাম বাড়ছে। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে কমছে। এজন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়।
দ্রব্যমূল্য নিয়ে ট্যারিফ কমিশন আন্তর্জাতিক বাজার ও স্থানীয় বাজার মূল্য পর্যবেক্ষণ করে ব্যবসায়ীদের নয়ছয় শনাক্ত করেছে। 
অবশ্য গত বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনটি পাঠানো হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে ভোজ্যতেলের অযৌক্তিক দাম আদায়ের বিষয়টি তুলে ধরা হয়। ট্যারিফ কমিশন সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে। 
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জরুরি বৈঠক : এদিকে রমজান উপলক্ষে দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক রাখতে রোববার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছে। ওই বৈঠকে রমজানে দাম সহনীয় রাখতে পণ্যের আমদানি, এলসি খোলার হার, মজুদ, সরবরাহ ও বাজার মনিটরিং পরিস্থিতি নিয়ে প্রস্তুতিমূলক দিকনির্দেশনা দেয়া হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিশেষ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এনবিআর, টিসিবি, প্রধান নিয়ন্ত্রক আমদানি ও রফতানি, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা ওই বৈঠকে অংশ নেবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
প্রতি বছর রমজান আসার আগেই একশ্রেণীর ব্যবসায়ী অতিমুনাফার লোভে মরিয়া হয়ে ওঠে। এ বছর সরকারের শেষ বছর। রাজনীতি পরিস্থিতি নিয়ে উত্তাপ থাকায় প্রশাসন বাজারমুখী হতে পারছে না। এই সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা বাজার অস্থিতিশীল করার পরিকল্পনা নিয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন