সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে , জলবায়ু পরিবর্তনে অস্তিত্ব সংকটে উপকূলীয় জীবন

নুরুল আমিন হেলালী
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কক্সবাজার সমুদ্র উপকুলবর্তী মানুষের জীবন ও জীবিকা অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কক্সবাজার সদর, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন, শাহপরীরদ্বীপ
, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া ও চকরিয়াসহ বঙ্গোপসাগরের উপকুলীয় নিম্নাঞ্চল ও দ্বীপাঞ্চল সমূহে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও নানামুখি সামাজিক এবং প্রতিবেশগত মিথষ্ক্রিয়ায় ওই সকল অঞ্চলের জনগোষ্ঠির অস্তিত্ব বিপন্ন হতে চলেছে। 
বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, চলতি বছরের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে কালবৈশাখী, টর্ণেডো, ঘূর্ণিঝড় মহাসেন দক্ষিণ-মধ্য বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপ ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে বিপুল ক্ষয়ক্ষতিসহ অতিবৃষ্টি ও অস্বাভাবিক জোয়ারের প্রভাবে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে জেলার ৫ লক্ষাধিক জনগোষ্ঠি।
জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে ঘনঘন নিম্নচাপ, ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, খরা, বন্যা, টর্ণেডো, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধি, ভূমিক্ষয়, লবণাক্ততা, ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদী-নালা-খাল-বিল ও জলাশয়, নিচে নেমে যাচ্ছে ভূ-গর্ভস্থ পানিস্থর, বিপন্ন হচ্ছে জীববৈচিত্র্যতা। 
এছাড়া বৈশ্বিক উষ্ণতাবৃদ্ধির ফলে প্রতিবেশের স্বাভাবিক খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙ্গে পড়ছে এবং মানুষের আচরণগত অভ্যাস পরিবর্তন হয়ে দেখা দিচ্ছে শারীরিক ও মানসিক জটিলতা। 
জার্মান ওয়াচ এর গ্লোবাল ক্লাইমেট ইন্ডেক্স ২০১১ অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝূঁকিপ্রবন ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষনা সংস্থা “নাসা”র তথ্যানুযায়ী চলতি শতকের শেষ নাগাদ বাংলাদেশ সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে বলে ইংগিত দিয়েছেন। 
আবার আন্তর্জাতিক জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক প্যানেল এর হুশিয়ারী হচ্ছে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ১৭ ভাগ ভূখন্ড সমুদ্রে তলিয়ে যাবে। যা শুধু উপকুলীয় নিম্নাঞ্চল ও দীপাঞ্চলসমূহের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সেই হিসেবে সমুদ্রশহর কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সোনাদিয়াদ্বীপ, কক্সবাজার সদরের উপকুলবর্তী খুরুস্কুল, পিএমখালী, ভারুয়াখালী, চৌফলদন্ডী, ইসলামপুর, পোকখালী, চকরিয়ার বদরখালী, পেকুয়ার মগনামাসহ সমুদ্র উপকুলের নিম্নাঞ্চল ও দ্বীপাঞ্চলসমূহ অস্তিত্ব সংকটের মুখে। যার কিছু কিছু পূর্বাভাষ ও প্রভাব ইতোমধ্যেই ওই সকল অঞ্চলে পড়তে শুরু করেছে। বৈশ্বিক উষ্ণতাবৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব কক্সবাজারসহ ওই সকল অঞ্চলের ঘাড়ে উষ্ণ নিশ্বাস ফেললেও এ সম্পর্কে কক্সবাজার জেলাসহ সমগ্রদেশে জনসচেতনতা ও মোকাবেলার প্রস্তুতি নেই বললেই চলে। 
২০০৭ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক প্রকাশিত ‘জীববৈচিত্র্য ও জলবায়ু পরিবর্তন’ বিষয়ক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, গত ১০০ বছরে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা বেড়েছে ১০-২০ সে.মি, বৃহৎজলাশয় ও নদীর পানির পরিমাণ কমেছে ৪০-৬০ ভাগ, বালুকাময় তটরেখার বিলুপ্তি ঘটেছে ৭০ ভাগ, জমাটবদ্ধ বরফের সামগ্রিক আয়তন কমেছে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধির ফলে ইতোমধ্যেই প্রশান্ত মহাসাগরীয় লেটি ও আলাস্কার সিসমারেফ জনগোষ্ঠি উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। 
পরিবেশ ও আবহাওয়া বিজ্ঞানীদের ধারণা ২১০০ সালের মধ্যে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১.৪ থেকে ৫.৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি পেতে পারে। ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে আরো ৯ থেকে ৮৮ সে.মি., বাড়বে বৃষ্টিপাত ও বন্যা, দাবদাহ ঘূর্ণিঝড়সহ আবহাওয়া বিপর্যয় এবং বৃদ্ধি পাবে বিপদজনক বাহকরোগ ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গুর প্রাদূর্ভাব। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনে হুমকির মুখে পড়বে জীববৈচিত্র্যতা ও প্রতিবেশ।
 পরিবেশবিদদের অভিমত জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে মারাত্মক ঝূঁকির কবলে পড়তে হবে কক্সবাজারের উপকুলীয় এলাকাসমূহে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত জটিলতারোধকল্পে ব্যাপক গণসচেতনতা এবং কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী।