জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ, রায়ের বিরুদ্ধে আপিল

ডেস্ক রিপোর্ট : সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় জামায়াতে ইসলামীকে দেয়া নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। এদিকে নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। নিবন্ধন বাতিল চেয়ে করা রিট আবেদনের রায়ে বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটার দিকে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এর এক ঘণ্টার মধ্যেই সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিশির মোহাম্মদ মনির জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে আপিল করেন।


এরআগে বৃহস্পতিবার বিকেল পৌনে তিনটায় এ সংক্রাšত্ম গঠিত বেঞ্চের তিন বিচারপতির মধ্যে দুজন এ ব্যাপারে একমত হয়ে এ রায় দেন। তিন বিচারপতি হলেন এম মোয়াজ্জেম হোসেন, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কাজী রেজাউল হক। তারা সুপ্রিম কোর্টের অ্যানেক্স ২৪ বিচারকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা মতের ভিত্তিতে রায় প্রদান করেন।

রায়কে কেন্দ্র করে আদালত চত্বরে নেয়া হয় বাড়তি নিরাপত্তা। এমনকি সুপ্রিম কোর্টের অ্যানেক্স ২৪ নম্বর বিচারকক্ষের সামনে আর্চওয়ে বসানো হয়।

গত ১২ জুন জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দাখিল করা রিট আবেদনের ওপর শুনানি শেষ হওয়ার পর আদালত রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রেখে দেন।

আদালতে শুনানিকালে ইসির পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মহসীন রশিদ, রিট আবেদনকারীরপক্ষে ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর ও জামায়াতের পক্ষে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক যুক্তি উপস্থাপন করেন।

বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, আমরা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান এর সভাপতি হুমায়ূন কবির, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ ব্যক্তি ২০০৯ সালে রিট আবেদনটি করেন।

এ আবেদনে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক (পরবর্তীতে প্রধান বিচারপতি) ও বিচারপতি মো. আবদুল হাইয়ের হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি রুল জারি করেন। রুলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০বি(১)(বি)(২) ও ৯০(সি) অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চাওয়া হয়।

এরপর গত ফেব্র“য়ারি মাসের শেষ দিকে ওই রুলের চূড়ান্ত শুনানির জন্য একটি বেঞ্চ নির্ধারণ করে দিতে প্রধান বিচারতির কাছে আবেদন করেন ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর। এ আবেদনে বিচারপতি এম. মোয়াজ্জাম হোসেনের নেতৃত্বাধীন দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চকে এ আবেদনটি শুনানির জন্য দেয়া হয়। গত ১০ মার্চ এই রিট আবেদনটির সঙ্গে সাংবিধানিক ও আইনগত প্রশ্ন জড়িত থাকায় বৃহত্তর বেঞ্চ গঠনের জন্য বিষয়টি প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠান এ আদালত। এ অবস্থায় প্রধান বিচারপতি ওইদিনই তিন সদস্যের একটি বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করেন।

শুনানিতে আদালতে ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর বলেন, যে গঠনতন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে জামায়াতে ইসলামীকে নিবন্ধন দেয়া হয়েছিল, তা ছিল নিবন্ধনের অযোগ্য। তাই নিবন্ধনের পর ওই গঠনতন্ত্র সংশোধনের সুযোগ নেই। জামায়াতের নিবন্ধন সংবিধানের ৭ ও ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদ পরিপন্থী।

তিনি বলেন, সংবিধানে রাজনৈতিক দল করার মৌলিক অধিকার দেয়া হয়েছে। তবে কোনো দলের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে, দলের নীতিতে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ বৈষম্য থাকলে সংগঠন বা রাজনৈতিক দল করা যাবে না।

তিনি আরো বলেন, গণতন্ত্রের মূল বক্তব্য হচ্ছে সকল ক্ষমতার মালিক জনগন। কিন্তু জামায়াতের গঠনতন্ত্র সংবিধানের এই ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

তানিয়া আমীর বলেন, জামায়াতের জন্ম হয়েছে ভারতে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দলটির শাখা রয়েছে। তাই ইসি দলটিকে নিবন্ধন দিতে পারে না।

অন্যদিকে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, ইসি এখনো নিবন্ধনের বিষয়ে পরিপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্তে আসেনি। তারা কোনো সিদ্ধান্ত না দেয়া পর্যন্ত রিট আবেদন অপরিপক্ক।

তিনি বলেন, ২০১২ সালে ইসি একটি মেমো তৈরি করে। সেখানে মাত্র দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও জাসদ ছাড়া বাকি সকল দলের গঠনতন্ত্র ছিল ত্রুটিপূর্ণ। তাই জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করতে হলে বাকি ১০টি রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল করা প্রয়োজন হবে। এটা করা ঠিক হবে না।

রাজ্জাক বলেন, যারা জামায়াতের নিবন্ধন চ্যালেঞ্জ করেছে তাদের গঠনতন্ত্রে জিহাদ ও ইসলামের কথা রয়েছে। কিন্তু জামায়াতের গঠনতন্ত্রে জিহাদের কথা নেই।

অসৎ উদ্দেশ্যে রিট করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বিষয়ে ২০০৮ সালে আইন হয়। এ আইন পরিপূর্ণ নয়।

ইসির আইনজীবী মহসীন রশিদ বলেন, ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীকে সামিয়ক নিবন্ধন দেয়া হয়। সে সময় সংবিধানে আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম ও রাষ্ট্র ধর্ম ইসলামের কথা ছিল। তখনকার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সাময়িক নিবন্ধন দেয়া হয়। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য সকল দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার লক্ষ্য নিয়েই তখন ইসি সিদ্ধান্ত নেয়। তখন ইসির সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।

জামায়াতকে সাময়িক নিবন্ধন দেয়ার অনেক পরে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী করা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

এদিকে নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণার পর ঢাকা-পাবনা মহাসড়ক এবং সিরাজগঞ্জে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পাশ অবরোধ করেছে বিক্ষুব্ধ জামায়াত কর্মীরা। এছাড়া ঢাকায় কমলাপুর রেলস্টেশন এলাকায় ঝটিকা মিছিল ও গাড়ি ভাংচুর করেছে দলটির নেতা-কর্মীরা। 

একই ঘটনায় চট্রগ্রাম নগরীর মিস্ত্রিপাড়া থেকে নাশকতা পরিকল্পনার অভিযোগে ১০ শিবির কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। 

বৃহস্পতিবার জামায়াতকে নির্বাচন কমিশনের দেয়া নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট। এর পরপরই সারাদেশে জামায়াত কর্মীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তবে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বেশ সজাগ রয়েছে।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন